ধারাবাহিক পতনের মধ্যে দিয়ে চলছে দেশের শেয়ারবাজারের লেনদেন। শুধু ঈদের পর মাত্র গত পাঁচ কার্যদিবসেই ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) প্রধান মূল্যসূচক হারিয়েছে ২১০ পয়েন্ট, যার মধ্যদিয়ে ডিএসইর প্রধান মূল্যসূচক গত তিন বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন অবস্থানে বা ৫ হাজার ৬৫৩ পয়েন্টে নেমে এসেছে। এর ফলে শেয়ারবাজার ঘনঘন বিরূপ আচরণ করছে। এতে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে অস্থিরতা বিরাজ করছে। রয়েছেন দ্বিধায়ও। এ অবস্থায় স্বল্পমেয়াদে শেয়ারবাজার থেকে লাভ খোঁজার দিন ফুরিয়ে আসছে। যারা এতদিন দৈনন্দিন শেয়ার কেনাবেচা থেকে লাভ পাওয়ার চেষ্টা করেছেন, বর্তমান শেয়ারবাজার তাদের জন্য উপযুক্ত নয়। এ ধরনের বিনিয়োগকারীদের বর্তমান পরিস্থিতিতে হা-হুতাশ না করে দীর্ঘমেয়াদে বিনিয়োগ করারও পরামর্শ দিয়েছেন পুঁজিবাজার বিশ্লেষকরা।
ডিএসইর তথ্য পর্যালোচনায় দেখা গেছে, তিন বছর আগে ২০২১ সালের ১১ মে সূচকের অবস্থান ছিল ৫ হাজার ৭২৪ পয়েন্ট। তবে ওই দিন লেনদেনের পরিমাণ ছিল ১ হাজার ৪০৩ কোটি টাকার বেশি। আর গতকাল রোববার লেনদেন হয়েছে ৪৭৮ কোটি টাকার কিছু বেশি। সূচক ৩২ পয়েন্ট হারিয়ে ৫ হাজার ৬৫৩ পয়েন্টে অবস্থান করছে। লেনদেনে অংশগ্রহণ করা কোম্পানির মধ্যে দর বৃদ্ধির তুলনায় দর হারিয়েছে প্রায় ৪ গুণ। লেনদেনে অংশগ্রহণ করা ৩৯৩টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে দর বৃদ্ধি পেয়েছে ৭৫টির, কমেছে ২৮৫টি এবং অপরিবর্তিত ছিল ৩৩টি কোম্পানির শেয়ার ও ইউনিটের।
পুঁজিবাজার বিশ্লেষক অধ্যাপক আবু আহমেদ এ প্রসঙ্গে কালবেলাকে বলেন, অনেক দিন থেকে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানিও কারসাজিতে জড়িয়ে পড়ছে। কোম্পানির ভেতর থেকে দুর্বল কোম্পানির শেয়ারে বিনিয়োগে উৎসাহিত করা হচ্ছে। তবে যারা ভালো কোম্পানির শেয়ারে দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ করেছেন, তাদের পক্ষ থেকে বর্তমান বাজার নিয়ে কোনো অভিযোগ নেই। যারা দৈনন্দিন লাভ খোঁজে তাদের সমস্যা হচ্ছে। তারাই বেশি হা-হুতাশ করছে। এ ছাড়া বাজারে এখন সূচকের পতন হচ্ছে, এর সঙ্গে ফোর্সড সেলের সম্পর্ক আছে। এর জন্য দায়ী হচ্ছে ফ্লোর প্রাইস। দীর্ঘমেয়াদি এ নীতি বিনিয়োগকারীদের ঋণের বোঝা বাড়িয়েছিল। এখন তারা হালকা হতে চাচ্ছে। এতে সূচকের পতন হচ্ছে। পতন হতেই পারে। এটিই স্বাভাবিক। এটিই শেয়ারবাজার। বাজার নিজ থেকেই ঘুরে দাঁড়াবে।
তিনি দাবি করেন, আমার মনে হচ্ছে—অল্প সময়ের মধ্যে বাজার ঊর্ধ্বমুখী হবে। সারা বিশ্বের সব বাজারে শেয়ারের দর সমন্বয় হয়। এখানেও হচ্ছে। যেভাবে শেয়ারের দাম টেনে-হিঁচড়ে ওপরে উঠানো হয়েছে, সেখান থেকে তো কারেকশন (সমন্বয়) হওয়া লাগবে। বাজার তার নিজস্ব গতিতে আসতে হবে।
সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ কারণেও অর্থনীতি ভালো যাচ্ছে না। অর্থনৈতিক মন্দা, সুদহার বৃদ্ধি ও উচ্চ মূল্যস্ফীতির প্রভাব রয়েছে শেয়ারবাজারে। এ ছাড়া দীর্ঘমেয়াদি ফ্লোর প্রাইসে আটকে থাকা মার্জিন লোনের বিনিয়োগকারীরা এই সময়ে ফোর্সড সেলের মুখে পড়ছে। এ ধরনের ফোর্সড সেল বাজারের উপর আরও বিরূপ প্রভাব তৈরি করছে। আবার সুদহার বৃদ্ধির কারণে অনেকেই পুঁজি এখন ব্যাংক ও ট্রেজারি বন্ডে বিনিয়োগ করছে। এর ফলে শেয়ারবাজার মন্দা থাকাটা স্বাভাবিক। অন্যদিকে পুঁজিবাজারের বর্তমান অবস্থার জন্য নিয়ন্ত্রক সংস্থার পক্ষ থেকে দাবি করা হচ্ছে—বাজারে অস্থিরতা সৃষ্টি করতে একটি সক্রিয় চক্র সিরিয়াল ট্রেডিংয়ের মাধ্যমে কারসাজি করছে। এতেও মূল্য সূচকের পতন ঘটেছে, যা সাধারণ বিনিয়োগকারীদের ক্ষতিগ্রস্ত করছে। যদিও এর প্রতিকারে কারসাজির সঙ্গে জড়িতদের কঠোর শাস্তির আওতায় আনারও হুঁশিয়ারি দেওয়া হয় বিএসইসি থেকে। কিন্তু কোনো উদ্যোগই বর্তমানে শেয়ারবাজারকে স্থিতিশীলতায় ফেরাতে পারছে না। কারণ বাজারে এখন বহুমুখী সমস্যায় জর্জরিত। এ কারণে বাজার ক্ষণে ক্ষণে বিরূপ আচরণ করছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) তথ্য বলছে, মার্চে দেশে মূল্যস্ফীতি বেড়ে ৯ দশমিক ৮১ শতাংশে উঠেছে, যা ফেব্রুয়ারিতে ছিল ৯ দশমিক ৬৭ শতাংশ। আর মার্চে খাদ্য মূল্যস্ফীতি বেড়ে ৯ দশমিক ৮৭ শতাংশে উঠেছে। এ নিয়ে গত ১৩ মাস থেকে মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের বেশিতে অবস্থান করছে। অন্যদিকে ডলারের মূল্য বেড়ে যাওয়া আমদানি রপ্তানিতে ব্যয় বেশি পড়ছে। যদিও বাংলাদেশ ব্যাংক মুদ্রার বাজার দর ঠিক রাখতে সুদহার বাড়ানোর দিকে মনোযোগ দিয়েছে। পাশাপাশি চলতি বছর মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি প্রবৃদ্ধি কমার পূর্বাভাস দিয়েছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। সংস্থাটি বলছে, ২০২৪ সালে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি হতে পারে ৫ দশমিক ৭ শতাংশ। তবে ২০২৫ সালে তা কিছুটা বেড়ে ৬ দশমিক ৬ শতাংশ হতে পারে। আর ২০২৯ সালে তা বেড়ে ৭ শতাংশে দাঁড়াবে। এসব অর্থনীতির এসব দুর্বল সূচকের প্রভাবও দেখা যাচ্ছে শেয়ারবাজারে।