আহ্ছানউল্লা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য বিভাগের চতুর্থ বর্ষে পড়ছেন মায়ীশা তাহসিন। হাতে তৈরি শিল্পকর্ম ও পেইন্টিংয়ের দুনিয়ায় তার দারুণ বিচরণ। বিদেশি কয়েকটি ম্যাগাজিনেও স্থান পেয়েছে মায়ীশার অনবদ্য শিল্পকর্মগুলোর ছবি। পেয়েছেন পুরস্কারও। তার গল্প শুনেছেন মারুফ হোসেন-
আকাশে ফুটে আছে বিশাল গোলগাল চাঁদ। নিজের কাছে এমন একটা চাঁদ থাকলে তো ভালোই হতো। আঁকিবুঁকির প্রতি তীব্র ভালোবাসা থেকে সেদিন ঠিকঠাক চাঁদ এঁকে ফেলেন মায়ীশা। আর এভাবেই একের পর এক অনবদ্য সব আলো-ছায়া ধরা দিতে থাকে মায়ীশার রং-তুলিতে।
শৈশবে পুতুল ছেড়ে রঙের প্রতি ঝোঁক দেখে বাবা-মা আঁচ করেছিলেন, মেয়ে আর্টেই একটা কিছু ঘটাবে। তাই ভর্তি করিয়ে দেওয়া হলো জাতীয় শিশু একাডেমির সিলেট শাখায়। দুদিন ক্লাস করে ছকবাঁধা আর্ট শেখাটা আর মনে ধরল না মায়ীশার। ছেড়ে দিলেন ক্লাস।
সপ্তম শ্রেণিতে এসে আবার ভর্তি হন সিলেট শিল্পকলা একাডেমিতে। প্রথম দিনই বাজিমাত। ভর্তির দিন তার সামনে একটি ফুলদানি রেখে আঁকতে বলা হয়েছিল। এমন এঁকেছিলেন যে, আর্ট শিক্ষক সুভাষ চন্দ্র স্যার তাকে ছোটদের ব্যাচে নয়; সোজা ভর্তি করিয়ে দিলেন বড়দের ব্যাচে।
মায়ীশা বললেন, ‘আমাকে যে ব্যাচে দেওয়া হলো সবাই বড়। আমিই সবচেয়ে ছোট। ব্যাচে অনেক ভার্সিটির স্টুডেন্টও ছিল। বড়দের সঙ্গে আঁকতে প্রথমে একটু ভয় কাজ করেছিল। পরে অবশ্য মানিয়ে নিয়েছিলাম।’
যথারীতি শিল্পকলা একাডেমিতেও মায়ীশার মন বসেনি বেশিদিন। গৎবাঁধা রুটিন, হোমওয়ার্ক এসব একদমই পছন্দ নয় তার। ছবি আঁকা তো তার বন্ধু, এ নিয়ে আবার পরীক্ষা দিতে হবে কেন!
তাই নিজে নিজেই চলে আঁকাআঁকি। মায়ীশা বললেন, ‘এখনকার মতো তখন ইন্টারনেট, ইউটিউব হাতের মুঠোয় ছিল না। তবে শেখার ইচ্ছা ছিল অনেক। তাই কোনো কিছু বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। সেইসঙ্গে প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাস থাকাও জরুরি।’
কোনো বন্ধুর পরনে নতুন পোশাক থেকে শুরু করে কোথাও ঘুরতে গেলেও সেটার ছবি মনে মনে ধারণ করে নিতেন মায়ীশা। পরে স্মার্টফোন হাতে এলো। নিজের শিল্পকর্ম সবাইকে দেখানোর প্ল্যাটফর্মও পেলেন। ইতিবাচক সাড়া পেয়ে আত্মবিশ্বাসও বেড়ে যায় অনেক। বললেন, ‘বাবা ছোটবেলায় যখন পাহাড়ে নিয়ে যেতেন ওখানকার প্রাকৃতিক দৃশ্যগুলো বাড়ি ফিরে আঁকার চেষ্টা করতাম। এভাবে অনেক কিছুই এঁকে ফেলতাম।’
কিন্ডারগার্টেনে থাকতে একবার বিজয় দিবস উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে ছবি এঁকে প্রথম হয়েছিলেন। একটি শাপলা ফুল এঁকেছিলেন সেবার। ২০ বছর পর স্কুলে যখন পুনর্মিলনী হলো, সেখানে গিয়ে নিজের আঁকা শাপলা ফুলটি অধ্যক্ষের টেবিলের গ্লাসের নিচে দেখে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন মায়ীশা।
বললেন, ‘ক্লাসে বসে বসে স্যার-ম্যাডামদের ছবি আঁকতে থাকতাম। স্যাররা ক্লাস করছেন, সেটাও স্কেচ করতাম। স্যাররা যখন ক্লাস শেষে বের হবেন, এমন সময় আঁকা ছবিটি তাদের হাতে দিতাম। তারা বেশ খুশি হতেন। শিক্ষকরা আমাকে আদর করে ডাকতেন আমাদের শিল্পী ছাত্রী বলে।’
একই ঘটনা বিশ্ববিদ্যালয়েও। যথারীতি প্রিয় শিক্ষকদের স্কেচ করে ফেলতেন ঝটপট। জুনিয়র সিনিয়র সবার কাছেই এভাবে সুপরিচিত নাম হয়ে যায় মায়ীশা। কেউ কেউ শেখার আগ্রহ দেখান। আবার অনেকে বায়না ধরে ছবি এঁকে দেওয়ার। কারও অনুরোধে না নেই মায়ীশার। ক্যাম্পাসের নানান প্রোগ্রাম ও ইভেন্টেও সরব তিনি। তার আঁকা ছবি প্রদর্শিত হয়েছে কয়েকটি প্রোগ্রামে।
আঁকিবুঁকি করতে গিয়ে মায়ীশার ঝুলিতে যুক্ত হচ্ছে সম্মাননা ও পুরস্কার। দেশি-বিদেশি কয়েকটি ম্যাগাজিনে তার চিত্রকর্ম ছাপা হয়েছে। তার মধ্যে বেলজিয়ামের ‘ন্যাক ম্যাগাজিন’ উল্লেখযোগ্য। কলোনি অব আর্ট (সেকেন্ড মেগা কালচারাল ইভেন্ট- ২০২১)-এর ‘ট্র্যাডিশনাল আর্ট’ সেগমেন্টে বিজয়ী হয়েছেন মায়ীশা। অনির্গন ফাইভেস্ট ফেস্ট আর্ট (পেইন্টিং)-এও চ্যাম্পিয়ন তিনি।
স্থাপত্যের এ শিক্ষার্থী হস্তশিল্পেও পটু। তার বানানো কাঠের গহনাও বেশ পছন্দ ক্যাম্পাসের বন্ধুদের। ‘বর্ণ মল্লিকা’ নামে একটি ফেসবুক পেজ রয়েছে তার। সেখানে নিজের আঁকা ছবি ও গহনার ছবি আপলোড করছেন নিয়মিত। চলছে টুকটাক বিক্রিবাট্টাও।
মায়ীশা বললেন, ‘বেশ সাড়া পাই অনলাইনে। ক্যাম্পাসে বন্ধু-বান্ধবরাও খুশি। সবাই অনুপ্রেরণা দেয়, উৎসাহ দেয়। সৃষ্টিশীল কাজে নিজেকে আরও বেশি জড়াতে চাই।’
তবে স্থাপত্যেই গড়তে চান ক্যারিয়ার। শখের কাজ সঙ্গী হয়েই থাকবে। অন্যদের ছবি আঁকা শেখানোরও ইচ্ছে আছে।
মন্তব্য করুন