ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট টানা সাড়ে ১৫ বছরের আওয়ামী শাসনের ইতি ঘটে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকাকালে বিরোধী কোনো রাজনৈতিক দলই সক্রিয়ভাবে মাঠে তাদের কার্যক্রম চালাতে পারেনি। হামলা-মামলা-নির্যাতনের শিকার হয়ে দলগুলোর নেতাকর্মীরা অনেকটা কোণঠাসা হয়ে পড়েছিলেন। বর্তমান পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এক আওয়ামী লীগ বাদে বিএনপি, জামায়াত, বিভিন্ন জোট, ইসলামী ও বাম ঘরানার দলগুলোর সরব উপস্থিতিতে রাজনীতির মাঠ যেন আস্তে আস্তে প্রাণ ফিরে পেয়েছে। শিক্ষার্থী ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের নিয়ে নতুন আত্মপ্রকাশ করা ‘জাতীয় নাগরিক কমিটি’ নিয়েও মানুষের আগ্রহ বাড়ছে। সব মিলিয়ে দেশে গরম ও সরব হয়ে উঠেছে রাজনীতির মাঠ।
গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মধ্য দিয়ে অবসান হয় ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের শাসনামল। প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে ভারতে আশ্রয় নেন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। ৮ আগস্ট দায়িত্বে আসে ড. মুহাম্মদ ইউনূস নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। এর পরই বদলে যাওয়া পরিবেশে মাঠ দখলে নিয়েছে বিএনপি, সক্রিয় রাজনীতির চর্চা করছে দলটি। গত এক দশকের বেশি সময় নির্বাসনে থাকা রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন হারানো জামায়াত নতুন রূপে ফিরে এসেছে রাজনীতিতে। এমনকি সরকারের পতনের মাত্র চার দিন আগে নিষিদ্ধ করা হলেও তা প্রত্যাহারের মাধ্যমে এখন জামায়াত-শিবির দেশের রাজনীতির মাঠ চষে বেড়াচ্ছে। সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ছোট-বড় জোট। বসে নেই ছাত্র আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া সমন্বয়করাও।
রাষ্ট্র সংস্কারের মাধ্যমে নতুন বাংলাদেশ গড়ার যে প্রত্যয় ব্যক্ত করেছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার, তার সমর্থন জানিয়েছে সব পথ ও মতের রাজনৈতিক দল ও সংগঠন। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে যথেষ্ট সময় দেওয়ার আশ্বাস দলগুলোর পক্ষ থেকে দেওয়া হয়েছে। তবে এই সংস্কার কতদিন চলবে, তা নিয়ে কেউ কেউ সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার দাবি তুলছে। যথেষ্ট সংস্কারের মাধ্যমে গণতন্ত্রের পথে ফিরতে নির্বাচন অনুষ্ঠানের রূপরেখা জানতে চেয়েছে কোনো কোনো দল। তাদের মধ্যে অনেকে সংস্কারের আগে নির্বাচন নয়—এমন দাবিও উত্থাপন করেছেন। এই রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ-বিপক্ষ অবস্থানে সরব হয়ে উঠেছে দেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতির রাজনীতি।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য আনোয়ারউল্লাহ চৌধুরী কালবেলাকে বলেন, এখন মান্ধাতা আমলের রাজনীতি বাদ দিয়ে গুণগত পরিবর্তন দরকার। শেখ হাসিনার দমনপীড়নের অবসান হওয়ায় দলগুলোর রাজনীতিতে গতি এসেছে, এটা ভালো। বর্তমান সরকারকে সবাই সমর্থন দিলেও কোনো কোনো দল আগে সংস্কার চায়, কেউ কেউ চায় নির্বাচনের রূপরেখা। এজন্য কতদিন সরকারের প্রতি সমর্থন থাকবে, তা-ও পরিষ্কার নয়। আবার সংস্কারের কর্মসূচি কী কী, তা-ও অজানা। সুতরাং দলগুলোর অবস্থান তখন কী হবে, তা আগে থেকে বলা মুশকিল। সংস্কারগুলো জনবান্ধব না হলে রাজনৈতিক দলগুলোর অবস্থান কী হয়, তারপর নির্ভর করবে রাজনৈতিক পরিস্থিতি।
বিএনপি দীর্ঘদিন ক্ষমতার বাইরে থাকার হতাশা কাটিয়ে দলীয় কর্মীরা সারা দেশে রাজনৈতিক অঙ্গনে সরব হয়েছেন। একই সঙ্গে দলের অনেকে রাজনৈতিক মাঠের দখল নিতে গিয়ে নানা অপকর্মে জড়াচ্ছেন। তবে ইমেজ ধরে রাখতে এসব অপকর্মে জড়িতদের বিরুদ্ধে শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে ব্যবস্থা যেমন নেওয়া হচ্ছে, তেমনি সারা দেশে প্রায় প্রতিদিনই সভা-সমাবেশের মাধ্যমে কেন্দ্র থেকে তৃণমূলকে চাঙ্গা রাখছে দলটি। গত মাসে দেশের দক্ষিণ-পূর্বের কয়েকটি জেলায় বন্যা পরিস্থিতিতে ত্রাণ কার্যক্রমেও অংশ নেন তারা। দলের নেতাকর্মীদের সঙ্গে, দেশি-বিদেশি প্রতিনিধির সঙ্গে যেমন দেখা করছেন দলীয় প্রধান বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া, তেমনি কেন্দ্রীয় অনেক নেতার সঙ্গেও হচ্ছে বৈঠক। লন্ডনে অবস্থানরত বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ভার্চুয়ালি নেতাকর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন। গত রোববার সাতক্ষীরায় এক জনসভায় ভার্চুয়ালি অংশ নিয়ে তাকের রহমান বলেন, ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার যে দারুণ সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে, তা নস্যাৎ করতে এখনো সক্রিয় দেশি-বিদেশি চক্র ও কিছু রাজনৈতিক দল। তাই যতক্ষণ পর্যন্ত গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠিত না হয়, ততক্ষণ পর্যন্ত নেতাকর্মীকে মাঠে থাকতে হবে।
এদিকে, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বিরোধী ভূমিকা ও যুদ্ধাপরাধের দায়ে জামায়াতের শীর্ষ নেতৃত্বের অনেকে সাজাপ্রাপ্ত হয়ে শূন্যতা তৈরি হলেও বর্তমান নেতৃত্বে তা কাটি উঠতে আপ্রাণ চেষ্টা করছে দলটি। সাম্প্রতিক বন্যা কার্যক্রম, ছাত্র আন্দোলনে আহতের পাশে দাঁড়ানোসহ নানা জনবান্ধব কাজের মাধ্যমে নতুন ইমেজ তৈরির চেষ্টা করছে দলটি। জামায়াত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের গৃহীত সংস্কারে যথেষ্ট সময় দেওয়ার পক্ষপাতী। সংস্কার শেষের আগে নির্বাচন নয় বলেও জানিয়েছে তারা। এ বিষয়ে জামায়াতে ইসলামীর আমির শফিকুর রহমান বলেছেন, অন্তর্বর্তী সরকার ‘যৌক্তিক সময়ে’ রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার সম্পন্ন করে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের আয়োজন করে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে বলে আশা করি।
পদত্যাগী নির্বাচন কমিশন দায়িত্ব থেকে অব্যাহতির আগে ডাকসুর সাবেক ভিপি নুরুল হক নুরের দল বাংলাদেশ গণঅধিকার পরিষদ, আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টি, জোনায়েদ সাকির গণসংহতি আন্দোলনকে নিবন্ধন দেওয়ায় জমে উঠেছে ছোট দলগুলোর রাজনীতিও।
রাজনীতিতে বিভিন্ন হিসাব-নিকাশে পিছিয়ে নেই ১২ দলীয় জোট, ইসলামী দলগুলোও। এই দরকষাকষিতে জমে উঠেছে খেলাফত আন্দোলন, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ, খেলাফত মজলিস, জাকের পার্টি, নেজামে ইসলাম পার্টি ও ইনসানিয়াত বিপ্লবের মতো ইসলামী দলগুলো।
জাতীয় পার্টি আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে সরকারে বিরোধী দলে থাকলেও তারাও পিছিয়ে নেই। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সঙ্গে যেমন বৈঠক করছে, তেমনি দলীয় কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে চালিয়ে যাচ্ছে রাজনীতি। তবে মাঠে নেই টানা চারবারের সরকারে নেতৃত্ব দেওয়া দল আওয়ামী লীগ। সাম্প্রতিক বন্যা পরিস্থিতিতে ত্রাণের মাধ্যমে কিছুটা সক্রিয় হওয়ার চেষ্টা করলেও হামলা-মামলার ভয়ে নিরাপদ আশ্রয়ে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে দলটি।
অন্যসব প্রধান দলের চেয়ে বেশি সক্রিয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া সমন্বয়করা। একাধারে সরকারের যেমন তাদের প্রতিনিধিত্ব রয়েছে, তেমনি কাজ করছে বন্যা পরিস্থিতি সামাল দিতে, বিভিন্ন সভায় বক্তব্য দিয়ে কখনো উদ্ভূত সমস্যা সমাধানের ভূমিকা রাখার মাধ্যমে। এরই ধারাবাহিকতায় জেলা সফরে নেমেছে ছাত্র সমন্বয়করা।
বসে নেই নতুন আত্মপ্রকাশ হওয়া ‘জাতীয় নাগরিক কমিটি’। গত রোববার ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের শক্তিকে সংহত করে দেশ পুনর্গঠনের লক্ষ্যে নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারীকে আহ্বায়ক ও আখতার হোসেনকে সদস্য সচিব করে ৫৫ সদস্যের জাতীয় নাগরিক কমিটি গঠন করা হয়। দল গঠনের প্রথম প্রহরেই আটটি সুনির্দিষ্ট প্রাথমিক কাজের লক্ষ্য চূড়ান্ত করে ঘোষণা দেয় নাগরিক কমিটি।