মনোয়ার হোসেন মান্না
প্রকাশ : ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০২:৫১ এএম
আপডেট : ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৭:৩৪ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

ঢাকা-ওয়াশিংটন সম্পর্কের নতুন দুয়ার খুলল

যুক্তরাষ্ট্র প্রতিনিধিদলের সফর
বাংলাদেশ ও যুক্তরাজ্যের পতাকা। ছবি : সংগৃহীত
বাংলাদেশ ও যুক্তরাজ্যের পতাকা। ছবি : সংগৃহীত

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে প্রথম মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধিদলের ঢাকা সফর শেষ হয়েছে। সম্পর্ক জোরদারে আসা মার্কিন প্রতিনিধিদলের সফরটি আরও নানা কারণে গুরুত্ব পাচ্ছে আলোচনার টেবিলে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশ দ্বিপক্ষীয়ভাবে বিভিন্ন কারণেই একে অপরের সঙ্গে সম্পৃক্ত। সেটা যেমন রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি কূটনৈতিকভাবেও সংযুক্ত। আবার অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবেও দুদেশের সংযোগ রয়েছে। এই সফর ঢাকা-ওয়াশিংটন সম্পর্কের নতুন দরজা উন্মোচন করবে বলে মত বিশ্লেষকদের। পাশাপাশি এই সফর যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশ ছাড়াও আঞ্চলিক ভূরাজনীতির জন্যও গুরুত্বপূর্ণ।

দেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বাংলাদেশের প্রয়োজনীয় খাতগুলোতে সংস্কার করতে যাচ্ছে। এক্ষেত্রে সরকার বাইরের দেশের সহযোগিতা চাচ্ছে। একটি নতুন জায়গা তৈরি হয়েছে, যেটা আগে ছিল না। আওয়ামী লীগ সরকারের সময় এর চেয়েও উঁচুপর্যায়ের যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি দল এসেছিল; কিন্তু তখনকার সরকার রাজনৈতিকভাবে তাদের জায়গা দেয়নি। তাদের বিরুদ্ধে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার মন্ত্রীরা নানা কথা বলা শুরু করেছিলেন। তারা অর্থনৈতিক জায়গায় কাজ করার জন্য বাংলাদেশে এসেছিল; কিন্তু সরকার তাদের রাজনৈতিক তকমা লাগিয়ে দেওয়ার কারণে সেই প্রচেষ্টা আর এগোয়নি।

যুক্তরাষ্ট্র এখন বাংলাদেশের প্রয়োজনের জায়গাগুলোতে সহযোগিতা দিতে প্রস্তুত। এই জায়গাটি রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও নীতিগত সবক্ষেত্রে একটি সমন্বয় তৈরি হয়েছে। এ কারণে এই সফর থেকে একটি ভালো ফল পাওয়ার আশা করছেন বিশ্লেষকরা।

তিন দিনের সফরে গত শনিবার ঢাকায় আসে উচ্চ পর্যায়ের মার্কিন প্রতিনিধি দল। এই দলের নেতৃত্ব দেন দেশটির অর্থ দপ্তরের সহকারী আন্ডার সেক্রেটারি ব্রেন্ট নেইম্যান। ছয় সদস্যের প্রতিনিধি দলে ছিলেন মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের (পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়) পক্ষ থেকে অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি ডোনাল্ড লু, যিনি দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোয় গত কয়েক বছর রাজনৈতিক অঙ্গনে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হিসেবে আলোচিত। দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব পাওয়ার পর এ নিয়ে পাঁচবার বাংলাদেশ সফর করেছেন লু। সর্বশেষ গত মে মাসে তার ঢাকা সফর ছিল আলোচনার শীর্ষে। এ ছাড়া এ দলে ছিলেন ইউএসএআইডির এশিয়াবিষয়ক উপসহকারী প্রশাসক অঞ্জলি কৌর। সফরে তারা বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস, পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন, অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ, পররাষ্ট্র সচিব ও বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের সঙ্গে বৈঠক করেন।

বৈঠকগুলোতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সংস্কার সম্পর্কে জানতে চেয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। সরকারের কাছে দ্রুততম সময়ের মধ্যে অর্থনৈতিক সংস্কারের বিষয়টি তাদের বিশেষ অগ্রাধিকারে রয়েছে বলে তারা জনিয়েছেন। এক্ষেত্রে আর্থিক সংস্কারে যুক্তরাষ্ট্র কীভাবে বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্ত হতে পারে, তা নিয়ে আলোচনা করেছে ঢাকা-ওয়াশিংটন। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সংস্কার প্রক্রিয়ায় সহযোগিতা করতে নিজেদের আগ্রহের কথাও জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।

যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধি দলের সঙ্গে বৈঠকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস দেশ পুনর্গঠন, গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার কর্মসূচি বাস্তবায়ন এবং পাচার হওয়া অর্থ ফিরিয়ে আনতে যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতা চেয়েছেন। ঘণ্টাব্যাপী বৈঠকে আর্থিক খাতের সংস্কার, বিনিয়োগ, শ্রম পরিস্থিতি, রোহিঙ্গা সংকট এবং জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে যোগদান উপলক্ষে প্রধান উপদেষ্টার আসন্ন নিউইয়র্ক সফর নিয়েও আলোচনা হয়েছে।

এ ছাড়া সফরে সুশাসন, সামাজিক, মানবিক ও অর্থনৈতিক খাতে বাংলাদেশকে ২০২ দশমিক ২৫ মিলিয়ন ডলার সহায়তা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। বাংলাদেশ সরকার ও ইউনাইটেড স্টেটস এজেন্সি ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্টের (ইউএসএআইডি) মধ্যে এ-সংক্রান্ত চুক্তি হয়। ইউএসএআইডির এশিয়াবিষয়ক উপসহকারী প্রশাসক অঞ্জলি কৌর জানিয়েছেন, তারা বাংলাদেশের অগ্রাধিকার খাতে ২০০ মিলিয়ন ডলারের বেশি সহায়তা দেবেন। আর বাংলাদেশের অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশ থেকে পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আসতে সহায়তার আশ্বাস দিয়েছে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে বাকস্বাধীনতা, নাগরিক অধিকার, গণতন্ত্র, ভোটাধিকার নিয়ে আগে থেকেই কথা বলে আসছিল। এখন একটি স্বৈরাচারী সরকারের পতন এবং নতুন অন্তর্বর্তী সরকারের শুরুতে তাই যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধি দলের ঢাকা সফরের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও আঞ্চলিক গুরুত্ব আছে। মার্কিনিরা যেটা চেয়েছিল, সেটা এখন আমরাই করছি। ফলে দুই দেশের মধ্যে এখন সহযোগিতা ও সহমর্মিতা থাকবে।

তারা আরও বলছেন, এবারের সফরে প্রাধান্য পেয়েছে বাংলাদেশের অর্থনীতি। বাংলাদেশের রিজার্ভের সংকট আছে, অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় জটিলতা আছে, রপ্তানির সংকট আছে। বাংলাদেশ একটা বড় ধরনের অর্থনৈতিক চাপের মধ্যে পড়েছে, এটা তারা (যুক্তরাষ্ট্র) বুঝতে পেরেছে এবং এটা তারা ওয়াশিংটন থেকেই জানে। এই চাপ থেকে বের হওয়ার জন্য বাংলাদেশ সরকারের কিছু সংস্কারের প্রয়োজন, এটাও তারা উপলব্ধি করেছে। এখানে কয়েকটি মেসেজ বা লক্ষ্যকে সামনে রেখে তারা এসেছে। আমাদের আশ্বস্ত করতে এসেছে, আমরা যে অর্থনৈতিক চাপের মধ্যে পড়েছি, সেখান থেকে বের হওয়ার জন্য বাংলাদেশ সঠিক পন্থা নিতে পারলে তারা আমাদের সাপোর্ট করবে। আর সাপোর্টের জন্য তারা কিছু উপদেশে এবং পথরেখা নিয়ে আলোচনা করেছে।

যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত ড. এম হুমায়ূন কবির কালবেলাকে বলেন, এখনকার বাস্তবতায় এই সফরটি একটি সময়োপযোগী সফর ছিল। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আমাদের দ্বিপক্ষীয় বা বহুমাত্রিক যে সম্পর্ক রয়েছে, সেটাকে তারা আরও সমৃদ্ধ করতে চায়; কিন্তু বিগত সরকারের সঙ্গে একটা শীতল সম্পর্কের কারণে তাদের পক্ষে সেটা সম্ভব হয়নি। তারপরেও তারা সহযোগিতা দিয়ে গেছে। আমি খুব বিস্মিত (সারপ্রাইজড) হয়েছি, তারা আমাদের বাঁধ ভেঙে গেছে, সেটা মেরামতে সহযোগিতা করতেও তাদের আগ্রহের কথা বলেছে। তারা আমাদের নিউট্রিশনের জন্যও সাহায্য করতে রাজি।

মার্কিন প্রতিনিধি দল বাংলাদেশের জন্য একটি আস্থার বার্তা নিয়ে এসেছে উল্লেখ করে ড. হুমায়ূন বলেন, তারা বলছে, বাংলাদেশের অর্থনীতিকে টেকসই করতে হলে অন্তর্ভুক্তিমূলক (ইনক্লুসিভ) করতে হবে। দীর্ঘমেয়াদে এখানে সংস্কার প্রক্রিয়াগুলো চালিয়ে অর্থনীতিকে চাঙা করতে হবে। সেখানেও তারা কিন্তু বিনিয়োগের কথা বলেছে, সংস্কারের কথা বলেছে, শান্তিপূর্ণ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার ওপর জোর দিয়েছে। অর্থাৎ তারা ভবিষ্যৎও কিন্তু চিন্তা করছে। তারা আমাদের সমস্যাটা কী, সেটা বোঝার চেষ্টা করেছে এবং প্রাথমিক সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছে।

তিনি বলেন, ভবিষ্যতে আমরা সংশ্লিষ্ট জায়গাগুলোতে সংস্কার করতে পারলে তারা এই সহযোগিতা আরও বাড়াবে এবং শুধু যুক্তরাষ্ট্র নয়, আইএমএফ, ওয়ার্ল্ড ব্যাংক, এডিবি, জাতিসংঘসহ যেসব জায়গা থেকে বাংলাদেশের জন্য সহযোগিতা আসা সম্ভব সেখানেও তারা আমাদের জন্য কাজ করতে আগ্রহী, তারা সেটা বলেছে।

ভূরাজনীতির ক্ষেত্রেও এই সফরের গুরুত্ব অনেক বলে মনে করেন ড. হুমায়ূন কবির। তিনি বলেন, এই সফরে অবশ্যই ভূরাজনীতির বিষয়টি আছে। কারণ বাংলাদেশ এখন এই ইন্দো-পেসিফিক অঞ্চলে যে ভূরাজনীতি আছে, সেখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ দেশ, বড় জনসংখ্যার দেশ। বঙ্গোপসাগরের নিকটবর্তী দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে একটা সেতুবন্ধন। একটি উদীয়মান অর্থনীতির দেশ। এসব বিষয় মনে রেখেই তাদের (যুক্তরাষ্ট্র) ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপট এবং আমাদের প্রয়োজনীয়তা এ দুটির মধ্যে একটি সাদৃশ্য তৈরি হয়েছে এবং সেই জায়গাটায় আমি ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা দেখি।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

অপহরণ করে ১০ কোটি টাকা আদায়ের মামলায় লিপটন কারাগারে 

আসামি ছিনতাইয়ের ঘটনায় আ.লীগ নেতাসহ গ্রেপ্তার ২১

তারেক রহমানের বক্তব্য বিকৃত করছে একটি গোষ্ঠী : আবিদ

জামায়াত কী হিন্দুদের স্বর্গের টিকিটও দেবে : সেলিম জাহাঙ্গীর

ঢাকা-১৮ আসনে কফিল উদ্দিনের উদ্যোগে উঠান বৈঠক

সংবাদ সম্মেলনে অভিযোগ / রাজনৈতিক হয়রানির অভিযোগ তুলে হত্যা মামলা প্রত্যাহারের পাঁয়তারা 

নৌকা উল্টে  কর্ণফুলীতে ভেসে গেল সাড়ে ১২ টন মাছ

গাজা যুদ্ধবিরতি নিয়ে ইসরায়েল-হামাস পরোক্ষ আলোচনা শুরু

নির্বাচন পেছানোর চেষ্টা গণতন্ত্র ও জনগণের অধিকারবিরোধী : নীরব

বজ্রপাত নিয়ে বিশেষজ্ঞের সতর্কতা

১০

প্রথমবার প্রকাশ্যে আসছেন ফিলিস্তিনি যোদ্ধাদের নেতা

১১

নতুন ২ জাতীয় দিবসের ছুটি নিয়ে যা জানা গেল

১২

সাংবাদিকদের ওপর হামলাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি

১৩

নির্বাচন নিয়ে কোনো ষড়যন্ত্র হতে দেওয়া হবে না : পাপিয়া

১৪

ভারতের ভিসা নিয়ে সুখবর দিলেন বিক্রম মিশ্রি

১৫

স্ত্রীর অভিযোগের জবাব দিলেন আবু ত্বহা আদনান

১৬

শেখ রেহানার পরিবারের বিরুদ্ধে ৩ জনের সাক্ষ্য

১৭

আকাশে ফানুসের জ্যোৎস্না, হৃদয়ে প্রবারণা পূর্ণিমার আলো

১৮

ঢাকা অভিমুখে লং মার্চের হুঁশিয়ারি হেফাজতের

১৯

আলী পেপার মিলসের মালিকসহ ৩ জনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা

২০
X