বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) ৪৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী আজ। ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের হাত ধরে জন্ম হয় দেশের অন্যতম বৃহৎ এই রাজনৈতিক দলটির। একাধিকবার রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকা বিএনপি এমন একটি সময়ে ৪৬ বছরে পা রাখছে, যখন সরকারের পদত্যাগ ও নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের একদফা দাবিতে চূড়ান্ত আন্দোলনের ‘শেষ ধাপ’-এর প্রস্তুতি চলছে। মধ্য সেপ্টেম্বরে সেই আন্দোলন শুরুর পরিকল্পনা করছে দলটি। লক্ষ্য অর্জন পর্যন্ত আন্দোলন চলবে বলে জানিয়েছেন বিএনপি নেতারা। তবে গত ২৯ জুলাই ঢাকার প্রবেশপথে অবস্থান কর্মসূচির তিক্ত অভিজ্ঞতার পর ‘চূড়ান্ত আন্দোলন’ জমানোই এখন বিএনপির জন্য বড় চ্যালেঞ্জ বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।
বিএনপির অনেক নেতার অভিমত, সভা-সমাবেশ, মানববন্ধন, পদযাত্রার মতো নরম কর্মসূচিতে নেতাকর্মীদের ব্যাপক উপস্থিতি থাকলেও ‘শক্ত কর্মসূচি’তে তাদের সেভাবে পাওয়া যায় না। এই বিষয়টি ভাবাচ্ছে নীতিনির্ধারকদের। যদিও অবস্থান কর্মসূচির ‘ব্যর্থতা’ কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়াতে তাৎক্ষণিক কিছু সাংগঠনিক শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয় দলটি। এর ইতিবাচক ফলও পেতে শুরু করেছে বলে দাবি নেতাদের।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকে মনে করেন, ১৬ বছরের বেশি সময় ধরে ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপির এবারের আন্দোলনে জয়ী হওয়ার বিকল্প নেই। কারণ, সরকার এবার বিএনপিকে বাইরে রেখে নির্বাচন করতে পারলে দলটি অস্তিত্ব সংকটে পড়তে পারে। এ বিষয়টি বিএনপির নেতৃত্বও বিবেচনায় নিচ্ছে। ফলে আগামী দিনে আন্দোলন জমানো ও তা সফল করাই বিএনপির বড় চ্যালেঞ্জ।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আব্দুল মঈন খান কালবেলাকে বলেন, ‘রাজনীতি এমন একটি জিনিস, যেখানে প্রতিনিয়ত চ্যালেঞ্জ থাকে। বিএনপি ৪৫ বছর ধরে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেই রাজনীতি করে এসেছে। বর্তমান চ্যালেঞ্জ হলো বাংলাদেশে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা। এটি বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের চ্যালেঞ্জ। কাজেই আমরা সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য শান্তিপূর্ণ এবং নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে কাজ করে যাচ্ছি।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা এ দেশে মৃত গণতন্ত্রকে পুনরুজ্জীবিত করতে চাই। সেই প্রক্রিয়াটিও হতে হবে গণতান্ত্রিক। সে কারণেই আমরা এক বছর ধরে বিভিন্ন বিভাগীয় শহর থেকে শুরু করে রাজধানীতেই শুধু নয়; গ্রামে-গঞ্জে, উপজেলা, ইউনিয়ন পর্যন্ত জনসমাবেশ করেছি। মানুষকে সম্পৃক্ত করে বর্তমান সরকারের দুঃশাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে যাচ্ছি।’
১৯৮১ সালের ৩০ মে চট্টগ্রামে এক ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থানে জিয়াউর রহমান নিহত হন। এরপর নানা ঘটনার মধ্য দিয়ে ১৯৮৩ সালে বিএনপির হাল ধরেন তারই সহধর্মিণী খালেদা জিয়া। তিনি দলের চেয়ারপারসন। তিনবার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার গৌরব অর্জন করেন খালেদা জিয়া। সর্বশেষ ২০০১ সালের ১ অক্টোবর জাতীয় নির্বাচনে বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট বিজয়ী হয়ে ক্ষমতায় আসে। ২০০৬ সালে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের পর থেকে ক্ষমতার বাইরে রয়েছে দলটি। এর মধ্যে ২০০৮ সালে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মাত্র ৩০টি আসন পায় বিএনপি। ২০১৪ সালে জাতীয় নির্বাচনের বাইরে থাকার পর ২০১৮ সালে একাদশ নির্বাচনে অংশ নেয় বিএনপি। তবে ৭টির বেশি আসনে জয়ী হতে পারেনি।
অনেকে মনে করেন, প্রতিষ্ঠার পর সাড়ে চার দশকের মধ্যে গত এক যুগের বেশি সময় ধরে সবচেয়ে প্রতিকূল সময় পার করছে বিএনপি। চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া কারারুদ্ধ হওয়ার পর থেকে দলের অবস্থা অনেকটা নাজুক হয়ে পড়ে। তিনি ২০২০ সালের মার্চে সরকারের নির্বাহী আদেশে শর্তসাপেক্ষ মুক্তি পেলেও অসুস্থতা ও বিধিনিষেধের বেড়াজালে রাজনীতিতে এখনো সক্রিয় হতে পারেননি।
দলটির নেতারা বলছেন, ফিরোজায় কার্যত তাকে গৃহবন্দি করে রাখা হয়েছে। এরই মধ্যে তাকে চিকিৎসার জন্য অনেকবার হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়েছে। শারীরিক নানা জটিলতা নিয়ে গত ৯ আগস্ট থেকে বসুন্ধরার এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন তিনি। এদিকে ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি খালেদা জিয়া কারাগারে যাওয়ার পর গঠনতন্ত্র অনুযায়ী বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হন লন্ডনে বসবাসরত দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান। সেখান থেকেই স্থায়ী কমিটির পরামর্শক্রমে ভার্চুয়ালি দল পরিচালনা করছেন তিনি। এ ছাড়া খালেদা জিয়া ও দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ প্রায় সব ছোট-বড় নেতার নামেই আছে মামলার বোঝা। খালেদা জিয়ার নামে মামলা রয়েছে ৩৭টি, আর মির্জা ফখরুলের মামলা ৮৭টি। দলটির শঙ্কা, নির্বাচন সামনে রেখে এসব মামলায় সিনিয়র অনেক নেতারই দ্রুততম সময়ে সাজা হয়ে যেতে পারে। এমন পরিস্থিতির মধ্যেই ৪৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালন করছে বিএনপি।
এদিকে প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে দুই দিনের কর্মসূচি পালন করছে বিএনপি। দিবসটি উপলক্ষে আজ শুক্রবার ভোরে নয়াপল্টনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়সহ সারা দেশের দলীয় কার্যালয়ে দলীয় পতাকা উত্তোলন করা হবে। এরপর সকাল সাড়ে ১০টায় রাজধানীর শেরেবাংলা নগরে দলের প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের কবরে পুষ্পস্তবক অর্পণ ও ফাতেহা পাঠ করা হবে। পরে বিকেল ৩টায় রাজধানীতে বর্ণাঢ্য র্যালি অনুষ্ঠিত হবে। নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে থেকে র্যালিটি শুরু হয়ে ফকিরাপুল মোড়, নটর ডেম কলেজ, শাপলা চত্বর, ইত্তেফাক মোড় হয়ে রাজধানী মার্কেটে গিয়ে শেষ হবে। নেতাকর্মীদের ব্যাপক অংশগ্রহণে র্যালিকে একদফার কর্মসূচির মতো রূপ দেওয়ার পরিকল্পনা নিয়েছে হাইকমান্ড।
বিএনপি সূত্রে জানা গেছে, দলের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর পর সেপ্টেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে একদফার আন্দোলনের কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নামার চিন্তা রয়েছে নীতিনির্ধারকদের। আর সেপ্টেম্বরের শেষ দিকে গিয়ে আন্দোলন গতি লাভ করবে। ওই সময় ঢাকায় ফের মহাসমাবেশ, গণসমাবেশ বা বড় ধরনের কর্মসূচির চিন্তা রয়েছে হাইকমান্ডের। এর মধ্য দিয়ে চূড়ান্ত আন্দোলনের ‘শেষ ধাপ’ শুরু হবে, যা দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত চলবে।
দলের নেতাদের কেউ কেউ বলছেন, সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তাহ থেকেই ঢাকাকেন্দ্রিক টানা কর্মসূচি দিয়ে অক্টোবরে তা চূড়ান্ত পর্যায়ে নেওয়ার চেষ্টা থাকবে তাদের। সেই আন্দোলনে দলটি আর কোনো ভুল করতে চায় না। এ লক্ষ্যে সাংগঠনিক প্রস্তুতি নিচ্ছে বিএনপি।
মন্তব্য করুন