জাল সনদের কারণে চাকরি হারানো ৬৭৬ জন শিক্ষককে পুনর্বহালে চলছে তোড়জোড়। ২০২৪ সালে দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে চাকরি করা এই শিক্ষকদের ভুয়া সনদ শনাক্ত করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তর (ডিআইএ)। এরপর বন্ধ করা হয় তাদের বেতন-ভাতা। তবে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট পরিবর্তনের পর চাকরি হারানো এসব শিক্ষককে স্বপদে পুনর্বহালের তোড়জোড় শুরু হয়েছে। হঠাৎ তাদের চাকরিতে পুনর্বহালের এই প্রক্রিয়া নিয়ে নানা প্রশ্ন তৈরির পাশাপাশি বিতর্ক দানা বেঁধেছে। অভিযোগ উঠেছে, একটি প্রভাবশালী সিন্ডিকেট বিপুল অঙ্কের আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমে বরখাস্ত এসব শিক্ষককে চাকরি ফিরিয়ে দেওয়ার কাজ করছে।
এরই মধ্যে চাকরিচ্যুত এসব শিক্ষককে চাকরিতে পুনর্বহালের প্রক্রিয়া অনেক দূর এগিয়েছে বলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল একটি সূত্র কালবেলাকে নিশ্চিত করেছে। গত ১৫ মে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সিনিয়র সচিব সিদ্দিক জোবায়েরের সভাপতিত্বে মন্ত্রণালয়ে এক সভায় চাকরিচ্যুত ওই শিক্ষকদের তালিকা সংগ্রহ করতে বলা হয়। এরপর জোরেশোরে পুনর্বহালের কাজ শুরু করে ডিআইএ। ওই শিক্ষকদের তথ্য পাঠানোর জন্য গণবিজ্ঞপ্তি ও পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়েছে ডিআইএ।
চাকরিচ্যুত এসব শিক্ষকের চাকরি ফিরিয়ে দেওয়ার পেছনে মন্ত্রণালয় ও ডিআইএর যুক্তি, বেশিরভাগ শিক্ষকই ২০-২২ বছর ধরে শিক্ষকতা করেছেন। হঠাৎ চাকরিচ্যুতিতে তাদের সামাজিক মর্যাদা ক্ষুণ্ন হচ্ছে। অনেকেই আদালতের মাধ্যমে বেতন-ভাতা ফেরত পেয়েছেন, আবার আর্থিক সংকটের কারণে অনেকে আদালতেও যেতে পারেননি। এমন পরিস্থিতিতে বরখাস্ত এসব শিক্ষক মন্ত্রণালয়ের হস্তক্ষেপ চাচ্ছেন। কিছু ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা মনে করছেন, তাদের চাকরিচ্যুতির প্রক্রিয়াটি যথাযথ ও আইনানুগ হয়নি। তবে জাল সনদ শনাক্ত প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত একাধিক কর্মকর্তা বলেন, শতভাগ আইনের মধ্যে থেকে তাদের চাকরিচ্যুত করা হয়। এখন মানবিক দিক বিবেচনায় যদি চাকরি ফিরিয়ে দেওয়া হয়, তাহলে অতীতে যারা জাল সনদের কারণে চাকরি হারিয়েছেন বা দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন, তারাও একই ধরনের আবেদন করতে শুরু করবেন। এতে শিক্ষা প্রশাসনে চরম বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হবে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নথি অনুযায়ী, ডিআইএ ২০২২ সালের অক্টোবর মাসে প্রাথমিকভাবে ৮১৭ জন শিক্ষক-কর্মচারীর জাল সনদ চিহ্নিত করে। পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন দপ্তর ও সনদ ইস্যুকারী কর্তৃপক্ষ থেকে সনদ যাচাই করা হয়। একাধিক বৈঠকে তা যাচাই-বাছাই শেষে মোট ৬৭৮ জনের সনদ জাল হিসেবে প্রমাণিত হয়। এর মধ্যে নিবন্ধন সনদ সঠিক প্রমাণিত হওয়ায় দুজন শিক্ষককে তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়। জাল সনদ চিহ্নিত হওয়াদের মধ্যে ৫১০ জনের নিবন্ধন সনদ, ১২৩ জনের কম্পিউটার, ১৫ জনের সাচিবিক বিদ্যা, ৫ জনের গ্রন্থাগার বিজ্ঞান, ৫ জনের বিডিএস, একজনের বিএড এবং ১৭ জনের অন্যান্য সনদ জাল বলে প্রমাণিত হয়। এসব শিক্ষককের চাকরিচ্যুত এবং বেতন-ভাতা বন্ধের নির্দেশ দেয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়। নির্দেশনা অনুযায়ী ২০২৪ সালের ১৮ মে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি) তাদের এমপিও বাতিল এবং বেতন-ভাতা বন্ধ করে দেয়। এই সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ করে শিক্ষকরা হাইকোর্টে ৮৭টি রিট আবেদন করেন। যেখানে ২৩০ জন পক্ষভুক্ত হয়েছেন। এর মধ্যে ২৬ জন কম্পিউটার শিক্ষককে সাময়িকভাবে এমপিও সুবিধা দেওয়ার জন্য উচ্চ আদালত আদেশ দেন। তবে মামলার পূর্ণাঙ্গ রায় না হওয়া পর্যন্ত আদালত তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা অব্যাহত রাখার নির্দেশ দেন। অন্যান্য রিট শুনানি পর্যায়ে রয়েছে। মামলাগুলো বিচারাধীন থাকা সত্ত্বেও এসব শিক্ষককে হঠাৎ চাকরিতে পুনর্বহাল করার প্রক্রিয়া এরই মধ্যে বিতর্কের সৃষ্টি করেছে।
কালবেলার অনুসন্ধানে এই তোড়জোড়ের নেপথ্যে একটি সিন্ডিকেটের তথ্য মিলেছে। ওই চক্রের সদস্যরা চাকরিচ্যুত শিক্ষকদের কাছ থেকে সাড়ে তিন লাখ টাকা করে নিয়ে তাদের চাকরি ফিরিয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। সে অনুযায়ী তারা মন্ত্রণালয় ও ডিআইএর হয়ে কাজ করে দেবেন—এমন শর্তে প্রাথমিকভাবে চাকরিচ্যুতদের কাছ থেকে এক লাখ টাকা করে নিয়েছেন। মন্ত্রণালয় উদ্যোগ নেওয়ার পর আরও এক লাখ টাকা করে এবং চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসার পর বাকি দেড় লাখ টাকা করে নেওয়া হবে।
চাকরিচ্যুতদের একজন চাঁদপুরের একটি স্কুলের কম্পিউটার বিভাগের শিক্ষক কালবেলাকে বলেন, ‘নিজেদের অস্তিত্ব বাঁচাতে আমরা টাকা দিচ্ছি। যারা আদালতে গেছে তাদের অনেকেরই এক থেকে দুই লাখ টাকা খরচ হয়েছে। যখন শুনলাম সাড়ে তিন লাখ টাকা দিলে চাকরি ফেরত পাওয়া যাবে, তখন রাজি হয়েছি এবং দৃশ্যমান পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে সেটি দেখার পর এক লাখ টাকা দিয়েছি।’
মাউশির একজন কর্মকর্তা জানান, আদালত তাদের কম্পিউটার বিভাগের ২৬ জন শিক্ষকের এমপিও সাময়িকভাবে ছাড় করার আদেশ দিলেও শিক্ষকদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেছেন। এমন পরিস্থিতিতে শিক্ষকদের চাকরি ফিরিয়ে দেওয়ার ফাঁকফোকর খুঁজতে থাকে মন্ত্রণালয়। শুরু হয় জোড়জোড়।
জানতে চাইলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব বদরুল নাহার (নিরীক্ষা ও আইন) কালবেলাকে বলেন, ‘বিষয়টি একদমই প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। এটা নিয়ে কথা বলার মতো পরিস্থিতি হয়নি।’
ডিআইএ পরিচালক অধ্যাপক সাইফুল ইসলামের ভাষ্য, এসব শিক্ষকের চাকরিচ্যুতি যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করে হয়নি। তিনি কালবেলাকে বলেন, শিক্ষকদের যে সনদ জাল বলা হচ্ছে, তা সঠিক নয়। তার মতে, সনদের তিনটি দিক রয়েছে—একাডেমিক সনদ, প্রশিক্ষণ সনদ এবং দক্ষতা সনদ। এই ক্ষেত্রে প্রশিক্ষণ সনদ জাল বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। কিন্তু সে সময়কার পরিপত্র অনুযায়ী প্রশিক্ষণ সনদ চাকরির জন্য মূল শর্ত ছিল না। তাই এ সনদ জাল বা সঠিক কোনোটিই চাকরিচ্যুতির জন্য প্রযোজ্য নয়। চাকরিতে পুনর্বহালে আর্থিক লেনদেনের বিষয়ে তিনি অবগত নন বলে উল্লেখ করেন।
জানতে চাইলে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের আইন কর্মকর্তা আল আমিন কালবেলাকে বলেন, ‘আদালত মাত্র ২৬ জনের বেতন-ভাতা ছাড়ের আদেশ দিয়েছেন, তা-ও শর্তসাপেক্ষে। সচিবের সঙ্গে বৈঠকে এসব শিক্ষকের বিষয়ে আইনগত মতামত দিয়েছি। এখন চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত কী নেবে তা মন্ত্রণালয় ভালো বলতে পারবে।’
তবে ভিন্ন কথা বলছেন এসব শিক্ষকের সনদ যাচাইয়ের সময় যুক্ত কর্মকর্তারা। সংশ্লিষ্ট তিনজন কর্মকর্তার সঙ্গে এ বিষয়ে কালবেলার কথা হয়। তারা বলেন, শিক্ষকদের জন্য প্রথম নিয়োগবিধি হয় ১৯৮২ সালে। এরপর তা সংশোধন হয় ১৯৯৫ ও ২০১০ সালে। যেসব শিক্ষকের সনদ জাল প্রমাণিত হয়েছে, তাদের বেশিরভাগেরই নিবন্ধন সনদ জাল। মন্ত্রণালয়ের ভাষ্য অনুযায়ী, যদি কম্পিউটার সনদে ১২৩ জনের ক্ষেত্রে আইনের ব্যত্যয় হয়, তাহলে বাকি শিক্ষকদের কীভাবে দায়মুক্তি দেবে?
সনদ যাচাইয়ের সময় যুক্ত কর্মকর্তারা আরও বলেন, ১৯৯৫ সালে কম্পিউটার শিক্ষক নিয়োগের শর্তে বলা হয়—শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কম্পিউটার ও প্রিন্টার থাকলে কম্পিউটার শিক্ষক নিয়োগ দিতে পারবে। শিক্ষকের যোগ্যতা হবে ন্যূনতম স্নাতক পাস (দ্বিতীয় শ্রেণি) এবং জাতীয় কম্পিউটার প্রশিক্ষণ ও গবেষণা একাডেমি (নট্টামস) থেকে প্রশিক্ষণ সনদ প্রাপ্ত। তিনটি শর্তের মধ্যে নট্টামস সনদ জাল মানে তিনি চাকরি পাওয়ার যোগ্যতা হারিয়েছেন। এখন যদি এর ভিন্ন ব্যাখ্যা দেওয়া হয়, সেটি রহস্যজনক।
জানা গেছে, নব্বইয়ের দশকে প্রথম দেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে কম্পিউটার শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া শুরু হয়। ১৯৯৪ সালে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কম্পিউটার ও প্রিন্টার থাকলেই একজন কম্পিটার শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া যাবে—সরকারের এমন ঘোষণার পর দেশজুড়ে দেদার এ বিষয়ে শিক্ষক নিয়োগ শুরু হয়। এমনকি বিদ্যুৎ সংযোগ ছিল না এমন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও কম্পিউটার বিভাগে শিক্ষক পদে নিয়োগ দেওয়া হয়। তদন্তের পর এসব শিক্ষকের এমপিও আটকে যায়। শুধু তাই নয়, ২০০৫ সালে শিক্ষক নিয়োগে শিক্ষক নিবন্ধন সনদ বাধ্যতামূলক করার পর আগের বছরের নিয়োগ দেখিয়ে কম্পিউটার বিভাগের শিক্ষক পদে নিয়োগ দেওয়া শুরু হয়। এতে চরম বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। বিতর্কের মুখে ২০০৩ সালে নট্টামস থেকে তিন মাসের কোর্সের সনদ থাকার বিধানটিই বাতিল করা হয়।
জানা গেছে, কম্পিউটার বিভাগের শিক্ষকদের সনদের ব্যাপারে মন্ত্রণালয় বিভিন্ন সময় ভিন্ন ভিন্ন পরিপত্র দিয়েছে। প্রতিটি পরিপত্রে এসব শিক্ষকের যোগ্যতা বলা হয়েছে স্নাতক পাস। যেহেতু বিশেষায়িত বিষয়, তাই শিক্ষকদের অভিজ্ঞতা সনদ হিসেবে নট্রামস থেকে প্রথমে ৩ মাস, পরে ৬ মাসের একটি প্রশিক্ষণ কোর্সের সনদ বাধ্যতামূলক করা হয়। যাদের এ সনদ ছিল না তাদের ৫ বছরের মধ্যে সনদ অর্জন করে জমা দিতে বলা হয়। এরপর প্রশিক্ষণ সনদের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় নট্রামস দেশে ১৪৩৮টি প্রতিষ্ঠানকে প্রশিক্ষণ সনদ দেওয়ার অনুমতি দেয়। অবশ্য কেউ কেউ বলছেন, এ সংখ্যা ৩ হাজারের বেশি। এই সুযোগে এসব সেন্টার নামে-বেনামে সনদ বিক্রি শুরু করে। জাল সনদের বিপুলসংখ্যক অভিযোগ আসার পর ১৯৯৫ সালের মার্চ মাসের একটি পরিপত্রে যারা জাল সনদ দিয়ে চাকরি নিয়েছে তাদের বেতন-ভাতা আদায় করে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমার নির্দেশ দেওয়া হয়।
জানা গেছে, ১৯৯৩ থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত ভুয়া সনদ ব্যবহার করে কম্পিউটার বিভাগের শিক্ষক পদে সবচেয়ে বেশি নিয়োগ দেওয়া হয়। ২০০৫ সালে শিক্ষক নিবন্ধন বাধ্যতামূলক হওয়ার পরও বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিয়ম লঙ্ঘন করে শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়। এমনকি যেসব স্কুলে বিদ্যুৎ পর্যন্ত নেই, সেখানেও কম্পিউটার বিভাগে শিক্ষক নিয়োগ হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এমপিওভুক্তির সময় এসব অনিয়ম ফাঁস হয় এবং অনেক শিক্ষকের এমপিও আটকে দেওয়া হয়।
ডিআইএর একজন কর্মকর্তা কালবেলাকে বলেন, ‘আমরা সনদ যাচাই করতে গিয়ে সবচেয়ে বেশি জাল সনদ পেয়েছি শিক্ষক নিবন্ধনের। তারপর কম্পিউটার প্রশিক্ষণ সনদ। তাদের চাকরিচ্যুত করার পর রাজনৈতিক চাপ থাকলেও আমরা সিদ্ধান্তে অটল ছিলাম।’
ডিআইএ কর্মকর্তাদের ধারণা, বর্তমানে ৪০ হাজারের বেশি কম্পিউটার শিক্ষক রয়েছেন, যারা জাল সনদে নিয়োগ পেয়েছেন।
মন্তব্য করুন