আগের দুদিনের তুলনায় গতকাল বুধবার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ ক্যাম্পাস ও চারপাশটা তুলনামূলক শান্ত। উৎসুক মানুষের ভিড় কমেছে। যারা আসছেন, তারা বাইরে থেকেই যতটুকু পারছেন ভেতরটা দেখার চেষ্টা করছেন। তবে শিক্ষকসহ বাকি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা এসেছেন স্কুলে। সেইসঙ্গে হোস্টেলে থাকা শিক্ষার্থীসহ অন্য শিক্ষার্থীরাও ক্যাম্পাসে এসেছে। অনেকের সঙ্গে তাদের অভিভাবকও এসেছেন। তেমনই একজন শিক্ষার্থী রামিম তাসকিন আহমেদ।
রামিম স্কুলের ইংরেজি ভার্সনের সপ্তম শ্রেণির ছাত্র। ঘটনার দিন বিমান বিধ্বস্তের পর বিস্ফোরণের ফলে লাগা আগুনের আঁচে তার এক কান পুড়ে যায়। শরীরের সেই পোড়া ক্ষত ছাপিয়ে বন্ধু হারানোর বেদনায় কাতর এই শিক্ষার্থী। তার সঙ্গে দেখা হয় স্কুলের চার নম্বর ভবনের সামনে। রামিম এসেছিল ঘটনার দিন রেখে যাওয়া বইয়ের ব্যাগ নিতে। ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার সময় সে জানাল, ‘আমাদের ছুটি হয়ে গিয়েছিল। ক্লাস ক্যাপ্টেন হওয়ার সুবাদে সবাইকে বের করে দেওয়ার পরই আমি বের হই। তখনো তাই করছিলাম। খুব বেশিজন তখন সেখানে ছিল না। ছুটির পর যারা কোচিং করে এরকম চার-পাঁচজন ছিল। এমন সময় টিনের ওপর আমরা একটা শব্দ শুনতে পাই। এরপর আরও একটা বিকট শব্দ।
তৃতীয় ধাপে হয় এর থেকেও বিকট শব্দ। দ্বিতীয় শব্দের পর মিনিটখানেক কালো ধোঁয়ায় সব অন্ধকার হয়ে গেল। তৃতীয় শব্দের সঙ্গেই আগুন লেগে যায়। আমি দূরে ছিলাম, সেই আগুনের আঁচেই আমার কান পুড়ে গেছে। চোখের সামনেই আমার তিন বন্ধু আগুনে পুড়ে মারা গেল। সেই দৃশ্য আর মনে করতে চাই না!’
রামিমের পাশে থাকা তার বাবা রুবেল আহমেদ সন্তানকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, ‘ও ভীষণ ট্রমার (আতঙ্কে) মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। রাতে ঘুম থেকে লাফ দিয়ে ওঠে। আমরা ওকে ঘটনার দিন থেকে একা থাকতে দিচ্ছি না। আজ (গতকাল) স্কুলে এসেছিলাম ওর রেখে যাওয়া বইয়ের ব্যাগ নিতে। সেগুলো পেয়েছি। তবে ঘটনার দিন ওর মোবাইল ফোনটা হারিয়েছে, সেটি পাওয়া যায়নি।’
রামিমের সঙ্গে আরেক শিক্ষার্থী এসেছিল ক্যাম্পাসে। তার নাম জাহিদ মোল্লা। জাহিদ মাইলস্টোনের বাংলা ভার্সনের অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী। সেও বাবার সঙ্গে রেখে যাওয়া বই-খাতা ও সাইকেল নিতে এসেছিল। জাহিদ জানায় তার বেঁচে ফেরার গল্প। তার মতে, সেটা অলৌকিক। কারণ প্রতিদিন ছুটির সময় ঠিক সেই জায়গাটায় গিয়ে বন্ধুর জন্য অপেক্ষা করে, যেখানে গত সোমবার বিমানটি বিধ্বস্ত হয়েছে। আতঙ্কভরা অভিব্যক্তি নিয়ে জাহিদ বলে, ‘প্রতিদিনের মতো আমি ঠিক ওই জায়গাতেই অপেক্ষা করছিলাম। এক বন্ধু এসে আমাকে বলল, চল ক্যান্টিনে যাই। আমিও কিছু না ভেবে ওর সঙ্গে ক্যান্টিনের দিকে রওনা দিলাম। রওনা দেওয়ার বিশ-পঁচিশ সেকেন্ডের মাথায় বিমানটি এসে ওখানে পড়ে। আমি যে বেঁচে ফিরেছি এটা এখনো বিশ্বাস হয় না।’
গত সোমবার দুপুরে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর এফটি-৭ বিজিআই যুদ্ধবিমান নিয়ে একক উড্ডয়ন করেছিলেন ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মো. তৌকির ইসলাম। উড্ডয়নের ১৩ মিনিটের মাথায় উড়োজাহাজটি আছড়ে পড়ে উত্তরার দিয়াবাড়িতে মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের হায়দার আলী ভবনটিতে। ভয়াবহ এ দুর্ঘটনায় গতকাল পর্যন্ত ৩২ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দেওয়া তালিকা অনুযায়ী নিহতদের মধ্যে ১৮ জনই শিক্ষার্থী। এ ছাড়া পরিচয় শনাক্ত করা যায়নি আটজনের। তাদের ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করে সিআইডিতে পাঠানো হয়েছে।
মন্তব্য করুন