

কক্সবাজারের টেকনাফ স্থলবন্দরে ৯ মাস ধরে বন্ধ রয়েছে আমদানি-রপ্তানি। এতে রাজস্ব ঘাটতি হয়েছে ৩০০ কোটি টাকা। আমদানি-রপ্তানি বন্ধ থাকায় এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
এ অবস্থায় সীমান্ত দিয়ে চোরাচালান যেমন বৃদ্ধি পেয়েছে তেমনি বন্দরের কয়েক লাখ শ্রমিক অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে চোরাচালানের মতো অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। আর আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম বন্ধ থাকায় বন্দরে প্রতি মাসে লোকসান হচ্ছে ৪০ লাখ টাকা।
চলমান এ ক্ষতি মোকাবিলায় দ্রুত সমস্যা সমাধানে সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। এদিকে সমস্যা সমাধানে মিয়ানমার সরকারের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক, চোরাচালান রোধ, আমদানি-রপ্তানিকারক ও সিএন্ডএফ এজেন্টদের সঙ্গে মতবিনিময়, কোস্টগার্ড ও বিজিবির সমন্বয়ে টাস্কফোর্স গঠনসহ সরকারের কাছে ৬টি সুপারিশ করেছে টেকনাফ কাস্টমস কর্তৃপক্ষ।
কাস্টম কর্তৃপক্ষের দেওয়া তথ্য মতে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে রাজস্ব আয় হয়েছে ৬৪০ কোটি টাকা। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে তা ২৩৬ কোটি টাকা কমে হয়েছে ৪০৪ কোটি টাকা। সর্বশেষ ২০২৪-২৫ অর্থবছরের মাত্র ৯ মাসে ৩০০ কোটি টাকা কমে হয়েছে প্রায় ১১০ কোটি টাকা।
কাস্টমস কর্মকর্তা মাহমুদুর রহমান কালবেলাকে বলেন, নানা রকম জটিলতার কারণে গেল এপ্রিল মাস থেকে বন্দরের কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। বন্দর সচল করতে দুই দেশের সরকারের উচ্চপর্যায়ে বৈঠক চলমান রয়েছে। আমরা আশা করছি, পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে রাজস্ব আয় বাড়বে।
বন্দর কর্তৃপক্ষের দেওয়া তথ্য বলছে, মিয়ানমার থেকে সর্বশেষ এপ্রিল মাসে চাল, ডাল, ভুট্টা, শিম, আদা, রসুন, সয়াবিন তেল, পাম ওয়েল, পেঁয়াজ, মাছ আমদানি করা হয়। এরপর থেকে মায়ানমারের অভ্যন্তরে সরকারি ও বেসরকারি ক্ষেত্রে নিরাপত্তাজনিত কারণে আমদানি রপ্তানি কার্যক্রম বন্ধ হয়ে পড়ে। এতে বন্দরের উপরে নির্ভরশীল কয়েক লাখ শ্রমিক অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে চোরাচালানের মতো অপরাধে জড়িয়ে যাচ্ছে। বাজারে চোরাইপন্য বাড়ছে, আর সরকার হারাচ্ছে রাজস্ব। ৩ সেপ্টেম্বর বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের এক সভায় জানানো হয়, মিয়ানমারের অভ্যন্তরে সরকারি-বেসরকারি ক্ষেত্রে কিছু সমস্যা থাকায় নিরাপত্তাজনিত কারণে টেকনাফ স্থলবন্দর দিয়ে আমদানি-রফতানি বন্ধ রয়েছে। এতে সরকার যেমন রাজস্ব হারাচ্ছে, তেমনি বন্দর কর্তৃপক্ষকে মোকাবিলা করতে হচ্ছে কোটি কোটি টাকার লোকসানও। আর আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়ে নিঃস্ব হওয়ার পথে অনেক ব্যবসায়ী।
কাস্টমস ক্লিয়ারিং অ্যান্ড ফরওয়ার্ডিংয়ের (সিএন্ডএফ) সভাপতি এহতেশামুল হক বাহদুর কালবেলাকে বলেন, এক বছর ধরে কোনো ব্যবসা নেই, এটি ভাবতে পারেন আমরা কীভাবে চলছি। আমাদের কী ক্ষতি হয়েছে তা মুখে বলে বোঝাতে পারব না। অথচ আয় না থাকলেও অনেক ব্যবসায়ীকে ব্যাংক সুদ দিতে হচ্ছে। বলতে পারেন অনেক ব্যবসায়ী একেবারে পথে বসেছে। আর প্রায় ৯০ লাখ মার্কিন ডলার মিয়ানমারে পড়ে আছে। কীভাবে ক্ষতি পুষিয়ে নিব তাও জানি না। আমরা আশা করছি, মিয়ানমারে নির্বাচনের পর নতুন সরকার গঠন করে আরকানে শান্তি ফিরিয়ে আনতে পারলে হয়তো ব্যবসা চালু হবে। এর আগে আশা দেখছি না।
টেকনাফ কাস্টমস কর্তৃপক্ষের ৬ সুপারিশ : ১. আমদানি-রপ্তানির কার্যক্রম চালু করতে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার সরকারের দ্বিপাক্ষিক কূটনৈতিক আলোচনা জোরদার করা। ২. সীমান্ত নিরাপত্তা, চোরাচালান প্রতিরোধ ও শান্তিপূর্ণ বাণিজ্য পরিবেশ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে যৌথ কমিটি গঠন করে টাস্কফোর্সের কার্যক্রম গতিশীল করা। সীমান্ত এলাকায় সাম্প্রতিক সংঘর্ষ বা অস্থিরতার ঝুঁকি থাকলে তা পর্যবেক্ষণ ও প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ। ৩. স্থানীয় চেম্বার, আমদানি-রপ্তানিকারক ও সিএন্ডএফ এজেন্টদের সঙ্গে মতবিনিময় ও ব্যবসায়ীদের উদ্বুদ্ধকরণ এবং প্রয়োজনীয় সুবিধা প্রদানের নীতিগত সহায়তা প্রদান। ৪. বর্ডার ট্রেড চুক্তির আলোকে জনপ্রিয় ও লাভজনক পণ্য অন্তর্ভুক্ত করে নতুন তালিকা প্রণয়ন। নিষিদ্ধ বা ঝুঁকিপূর্ণ পণ্য বাদ দিয়ে দুই দেশের বাজার উপযোগী পণ্যের অনুমোদন। ৫. পরীক্ষামূলকভাবে সীমিত পরিসরে বন্দর চালু করা। ৬. মিডিয়া ও জনসচেতনতা কার্যক্রম চালু রাখা।
টেকনাফ স্থলবন্দর আমদানি রপ্তানিকারক ব্যবসায়ী এনামুল হাসান বলেন, স্থলবন্দর বন্ধ আমরা অনেক দিন ধরে বলে আসছি। আমরা লোকাল ব্যবসায়ী আমদানি রপ্তানিকারক, বন্দরটা বন্ধ, বিশেষ করে এ বন্ধে সরকার প্রতি বছর হাজার কোটি টাকা রাজস্ব হারাচ্ছে। আমাদের অন্য কোনো জীবিকার উৎস নেই, আমাদের চলতে ফিরতে অনেক সমস্যা হচ্ছে। বিশেষ করে আমাদের টেকনাফবাসীর জীবিকার জন্য এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান। এখানকার অর্ধেক মানুষ বন্দরের সঙ্গে সম্পৃক্ত। আয়ের উৎস বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণে অনেক মানুষ অবৈধ পথ বেছে নিচ্ছে। পেটে খাবার না থাকলে মানুষ কী করবে। টেকনাফে একমাত্র বৈধ আয়ের প্রধান উৎস স্থলবন্দর। আমাদের প্রাণের দাবি বন্দর যেন সরকার খুলে দেয়।
টেকনাফ স্থলবন্দর শ্রমিক সর্দার আবুল হাশিম বলেন, গত নয় মাস থেকে স্থলবন্দর বন্ধ রয়েছে। বন্দর বন্ধ হওয়ার কারণে আমরা অনেক কষ্টে আছি, অনেক লোকসানের মধ্যে পড়ে আছি। আমার অনেক শ্রমিকরা মানবেতর জীবন-যাপন করছে। বন্ধ থাকা আমদানি-রপ্তানি কখন খুলবে সেই আশায় আছি।
টেকনাফ স্থলবন্দর পরিচালক মোহাম্মদ জসীম উদ্দিন চৌধুরী কালবেলাকে বলেন, নিরাপত্তাজনিত কারণে চলতি বছরের ১২ এপ্রিল থেকে বন্দরে আমদানি-রপ্তানি বন্ধ রয়েছে। এতে প্রতি মাসে বন্দরের ব্যয় বাবদ খরচ হচ্ছে ৩৫ থেকে ৪০ লাখ টাকা। অথচ আয় শূন্য। এই ব্যয় বহন করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে আমাদের। নিরাপত্তার শঙ্কা দূর না হলে সমস্যার সমাধান হবে বলে মনে হচ্ছে না।
মন্তব্য করুন