সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে করা মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় গতকাল সোমবার আরও দুজন সাক্ষী তাদের সাক্ষ্য প্রদান করেছেন। তারা হলেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে পুলিশের গুলিতে পা হারানো ঢাকা কলেজের মাস্টারের শিক্ষার্থী আব্দুল্লাহ আল ইমরান (২৫) এবং আন্দোলন চলাকালে যাত্রাবাড়ীতে গুলিবিদ্ধ বাঁ চোখ হারানো পারভীন (২৭)। বেলা সাড়ে ১১টায় বিচারপতি গোলাম মর্তুজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে এ সাক্ষ্য গ্রহণ চলে। রাষ্ট্রপক্ষের আবেদনে আগামী ৬ আগস্ট পরবর্তী সাক্ষ্য গ্রহণের দিন ধার্য করা হয়েছে।
শিক্ষার্থী ইমরান তার জবানবন্দিতে বলেছেন, ‘গত বছরের জুলাইয়ের ২৬-২৭ তারিখে শেখ হাসিনা পঙ্গু হাসপাতালে আমাদের দেখতে আসেন। হাসপাতাল থেকে বের হওয়ার সময় শেখ হাসিনা বলেছিলেন ‘নো রিলিজ, নো ট্রিটমেন্ট। পরে উনি যখন চলে যাচ্ছিলেন, তখন হেল্প ডেস্কের কাছে গিয়ে ‘নো রিলিজ, নো ট্রিটমেন্ট’ অর্ডার দিয়ে যান। পরবর্তী সময়ে আমার ঠিকঠাক ট্রিটমেন্ট দেওয়া হচ্ছিল না। হাসপাতালে সাপ্লাই করা অ্যান্টিবায়োটিক আমার শরীরে কাজ করছিল না; কিন্তু বাইরে থেকে কিনে আনারও অনুমতি ছিল না। ৫ আগস্টের পর আমাকে কেবিনে নেওয়া হয়, যথাযথ চিকিৎসা শুরু হয়।’
আরেক সাক্ষী পারভীন তার জবানবন্দিতে বলেন, ‘চিকিৎসার অবহেলায় আমার বাঁ চোখ পুরোপুরি নষ্ট হয়ে গেছে। ডান চোখেও কম দেখি। আমার অন্ধত্ব এবং পঙ্গুত্বের জন্য একমাত্র শেখ হাসিনা দায়ী। শেখ হাসিনা ছিলেন পুলিশের বাপ-মা। তার নির্দেশেই পুলিশ গুলি করেছে। আমার মতো আরও হাজার হাজার মানুষকে আহত করেছে, পঙ্গু করেছে, হত্যা করেছে। বর্তমানে আমি আট মাসের অন্তঃসত্ত্বা। আমার ৯ বছর ও ৪ বছর বয়সী আরও দুটি ছেলে রয়েছে। তাদের কে দেখবে? হাজার হাজার শহীদের, আহতদের, আমার অন্ধত্বের বিচার হোক। ন্যায়বিচার পাওয়ার জন্য এ আদালতে এসেছি। আমি চাই এই অন্যায়ের বিচার হোক। এ ঘটনার সঠিক বিচার না হলে ভবিষ্যতে যেসব সরকার আসবে, তারাও একইভাবে মানুষ হত্যা করতে দ্বিধা করবে না। মনে করবে হত্যা করলে তো বিচার হয় না।’ পরে এ মামলায় পলাতক সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের পক্ষে জেরার সময় রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবীর প্রশ্নের পরিপ্রেক্ষিতে পারভীন বলেন, ‘আমি গর্ভবতী। এ অবস্থায় মিথ্যা কথা বলতে পারি না। আমি যা বলেছি, সব সত্য বলেছি।’
‘নো রিলিজ, নো ট্রিটমেন্ট’: গুলিবিদ্ধ হয়ে অচল হয়ে যাওয়া বাঁ পা নিয়ে ট্রাইব্যুনালে সাক্ষীর ডায়াসে বসে ইমরান তার সাক্ষ্যে বলেন, ‘২০২৪ সালের জুলাইয়ের শুরু থেকে কোটাবিরোধী যৌক্তিক আন্দোলনে আমি সম্পৃক্ত ছিলাম। ১৯ জুলাই বিজয়নগর পানির ট্যাঙ্ক এলাকায় আন্দোলনরত অবস্থায় পুলিশ আমাদের ওপর অতর্কিত গুলি করে। আমি গুলিবিদ্ধ হই ও সেখানে আমার দুই সহযোদ্ধা নিহত হন। আমার বাঁ পায়ের হাঁটুর নিচে গুলি লাগে। এরপর আমার সহযোদ্ধারা আমাকে বিভিন্ন হাসপাতালে নেওয়ার চেষ্টা করে। তবে কোনো প্রাইভেট হাসপাতাল আমাকে ভর্তি করতে অপারগতা প্রকাশ করে।
পরে মিটফোর্ড হাসপাতালে আমাকে নিয়ে যাওয়া হয়। এখানে চিকিৎসকরা আমার বাঁ পা কেটে ফেলার কথা বলেন। আমি পা কেটে ফেলার পক্ষে ছিলাম। কারণ হাঁটু থেকে গোড়ালি পর্যন্ত মাংস ও হাড় ছিল না, শুধু চামড়ায় ঝুলে ছিল। আমার শুভাকাঙ্ক্ষীরা পা কাটার অনুমতি দেয়নি। পরে মিটফোর্ড হাসপাতাল থেকে আমাকে পঙ্গু হাসপাতালে নিয়ে যেতে বলা হয়। এরপর ১৯ জুলাই রাত ১১টার দিকে আমাকে পঙ্গু হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে দুটো অপারেশন হয়। গত বছরের ২৬ বা ২৭ জুলাই পঙ্গু হাসপাতালে আমাদের দেখতে আসেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তার আসা উপলক্ষে আগের রাত থেকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা চলতে থাকে হাসপাতালে। এজন্য আমাদের রাতে ঘুমের সুযোগও দেওয়া হয়নি। শেখ হাসিনা এসে আমাদের খোঁজখবর নিচ্ছিলেন। তখন আমার সঙ্গে তার কথা হয়। তখন আমি তাকে ম্যাডাম বলে সম্বোধন করলে তিনি আপা বলে ডাকতে বলেন। আমি কোথায় পড়াশোনা করি, হলে থাকি কি না সে সম্পর্কে তিনি জানতে চান।
একপর্যায়ে তিনি বুঝতে পারেন আমরা আন্দোলনকারী। তিনি আমাকে আরও জিজ্ঞাসা করেন যে, তুমি কি দেখেছ পুলিশ তোমাকে গুলি করেছে? আমি বলি যে, পুলিশ আমাকে গুলি করেছে। তবে পুলিশের পোশাকে কে ছিল তা আমি জানি না। আমার পরও উনি চার- পাঁচজনের সঙ্গে হাসপাতালে কথা বলেন। পরে উনি যখন চলে যাচ্ছিলেন তখন হেল্প ডেস্কের কাছে গিয়ে ‘নো রিলিজ, নো ট্রিটমেন্ট’ অর্ডার দিয়ে যান। যা আমি শুনতে পাই। তখন বুঝিনি তিনি এটা বলে কী বুঝিয়েছেন। পরবর্তী সময়ে আমার ঠিকঠাক ট্রিটমেন্ট দেওয়া হচ্ছিল না। আমার পা পচে যাচ্ছিল। গন্ধ আশপাশে কেউ থাকতে পারত না। হাসপাতালে সাপ্লাই করা অ্যান্টিবায়োটিক আমার শরীরে কাজ করছিল না; কিন্তু বাইরে থেকে কিনে আনারও অনুমতি ছিল না।
তখন আমার বাবা আমাকে হাসপাতাল থেকে রিলিজের চেষ্টা করেন; কিন্তু আমাকে রিলিজ দেওয়া হয়নি। পরে আমি বুঝতে পারি, শেখ হাসিনার ‘নো রিলিজ, নো ট্রিটমেন্ট’ অর্ডারের ফলে আমাকে রিলিজ দেওয়া হচ্ছে না। তারা চাচ্ছিল আমার পা-টা কেটে ফেলে পরবর্তী সময়ে জেলে পাঠাতে। তবে গত ৫ আগস্টের পর হাসপাতালের সাধারণ বেড থেকে কেবিনে নেওয়া হয়। এখন যথাযথ চিকিৎসা চলছে। এখন পর্যন্ত আমার পায়ে ২৫টি অপারেশন সম্পন্ন হয়েছে। তবে আমার বাঁ পা মুভমেন্ট হয় না, এটা কখনো সুস্থ হবে না।’
একপর্যায়ে, সাক্ষী আব্দুল্লাহ আল ইমরান আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালকে বলেন, আমার এই অবস্থার জন্য শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও পুলিশের সাবেক আইজি দায়ী। কারণ তারাই গুলির নির্দেশ দেন। সে কারণে পুলিশ গুলি করে। এই সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণের পর তাকে জেরা করা হয়। জেরা করেন শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামালের পক্ষে রাষ্ট্র নিযুক্ত আইনজীবী মো. আমির হোসেন।
‘আমি গর্ভাবস্থায় ন্যায়বিচার চাইতে এসেছি’
পারভীন তার সাক্ষ্যে বলেন, আমি যাত্রাবাড়ীর বউবাজার এলাকায় থাকতাম। দিনমজুরের কাজ করতাম। ১৮ জুলাই প্রতিদিনের মতো যাত্রাবাড়ী হেঁটে আসি এবং লেগুনায় চড়ে জুরাইনে কাজে যাই। বিকেল ৫টা পর্যন্ত কাজ করে লেগুনাস্ট্যান্ডে এসে দেখি কোনো গাড়ি নেই। হেঁটে যাত্রাবাড়ীর উদ্দেশে রওনা হই। এরপর যাত্রাবাড়ী এসে দেখি, অনেক মানুষ রাস্তার ওপর আহত হয়ে পড়ে আছেন। কারও হাত নেই, কারও পা নেই, কারও মাথা দিয়ে রক্ত ঝরছে। যাত্রাবাড়ী ফ্লাইওভারের নিচে ১৮-১৯ বছর বয়সী একটা ছেলে পড়ে ছিল। সে বাঁচাও বাঁচাও বলে চিৎকার করছিল। আমি তার কাছে যাই। সাদা প্যান্ট, সাদা হাফ হাতা গেঞ্জি, গলায় একটি আইডি কার্ড ঝোলানো ছিল। আমি তাকে টেনে তুলি। তাকে যখন হাসপাতালে নেওয়ার জন্য রিকশা খুঁজছিলাম, তখন যাত্রাবাড়ী থানা থেকে ১৪-১৫ জন পুলিশ এসে এলোপাতাড়ি গুলি করতে থাকে। ছেলেটাকে লক্ষ্য করে গুলি করা হচ্ছিল। গুলিগুলো ছেলেটার পিঠে লাগে। এরপর পুলিশ আমার বাঁ চোখ বরাবর গুলি করে। ২-৩ জন পুলিশ মিলে এলোপাতাড়ি গুলি করে। আমার তলপেটসহ শরীরের আরও কয়েক জায়গায় গুলি লাগে। আমার চোখ থেকে ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হচ্ছিল। এক পর্যায়ে দুর্বল হয়ে আমি পড়ে যাই। পড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ছেলেটি আমাকে চেপে ধরে এবং জোরে নিশ্বাস নেয়। তখন বুঝতে পারি, সে মারা গেছে। আমি তখন ছটফট করছিলাম। পরে লোকজন উদ্ধার করে আমাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠায়। প্রথমে পুলিশ কেস বলে ডাক্তাররা কালক্ষেপণ করতে থাকে। একপর্যায়ে অন্যদের চাপাচাপিতে আমাকে চিকিৎসা দেয়। সাক্ষী তার সাক্ষ্যে আরও বলেন, ঢাকা মেডিকেলে আমার অপারেশন হয়। চোখ থেকে তিনটি গুলি বের করা হয়। তবে আরও গুলি থেকে যায়। ৩-৪ দিন রাখার পর আমাকে চক্ষুবিজ্ঞান হাসপাতালে পাঠানো হয়। চক্ষুবিজ্ঞানের ডাক্তাররা
পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে ভেতরে গুলি দেখে অপারেশনের জন্য ভর্তি করে। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে অপারেশন করেনি। ৫ আগস্টে দেশ স্বাধীনের পর আমার অপারেশন করা হয়। চোখ থেকে একটা বড় গুলি বের করে। তলপেটের গুলিগুলো বের হয়নি। বর্তমানে আমি অন্তঃসত্ত্বা। ন্যায়বিচার পাওয়ার জন্য এ আদালতে এসেছি।
এর আগে গত রোববার এ মামলায় সূচনা বক্তব্য উপস্থাপনের পর ট্রাইব্যুনালে প্রথম সাক্ষ্য দেন খোকন চন্দ্র বর্মণ। তিনি গত বছরের ১৮ জুলাই নারায়ণগঞ্জের সাইনবোর্ড এলাকায় তার সামনে সংঘটিত হতাহতের ঘটনা ও গুলিতে নিজের মুখমণ্ডল বিকৃত হওয়ার বিষয়ে সাক্ষ্য দেন। পরবর্তী সময়ে তাকে জেরা করেন আসামিপক্ষের আইনজীবী।
গত বছরের জুলাই-আগস্টে ছাত্র- জনতার গণঅভ্যুত্থানে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে গত ১ জুন আনুষ্ঠানিক অভিযোগ (ফর্মাল চার্জ) আমলে নেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১। শেখ হাসিনার পাশাপাশি এ মামলায় অভিযুক্ত সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগে মানবতাবিরোধী অপরাধের ৫টি অভিযোগ গঠনের আবেদন করে প্রসিকিউশন। এরপর গত ১০ জুলাই অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল। এ ছাড়া এই মামলায় দোষ স্বীকার করে ঘটনার সত্যতা উদ্ঘাটনে রাজসাক্ষী হতে সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনের আবেদন মঞ্জুর করেন ট্রাইব্যুনাল। গতকালও রাজসাক্ষী চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন ট্রাইব্যুনালে উপস্থিত ছিলেন।
মন্তব্য করুন