আমজাদ হোসেন হৃদয়
প্রকাশ : ০৯ আগস্ট ২০২৫, ১২:০০ এএম
আপডেট : ০৯ আগস্ট ২০২৫, ০৭:৪৪ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

জুলাই অভ্যুত্থানের পথ ধরে এনসিপির যাত্রা

জনআকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নের অভিপ্রায়
ছবি : গ্রাফিক্স কালবেলা
ছবি : গ্রাফিক্স কালবেলা

দীর্ঘ রাজনৈতিক অস্থিরতা, ছাত্র-জনতার টানা আন্দোলন এবং শেষ পর্যন্ত জুলাই অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে দেশের রাজনৈতিক মানচিত্রে উদিত হয় নতুন সূর্য। স্বৈরাচার পতনের আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা। অভ্যুত্থানের পর আন্দোলনের প্রথম সারির সমন্বয়করা উপলব্ধি করেন যে, বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে একটি নতুন বিকল্প শক্তির প্রয়োজন রয়েছে। পুরোনো পদ্ধতির রাজনীতির অবসান ঘটিয়ে একটি নতুন, গণমুখী, অংশগ্রহণমূলক রাজনীতির প্ল্যাটফর্ম গঠনের প্রয়োজনীয়তা তখন প্রবল হয়ে ওঠে। এ ভাবনা থেকেই জুলাই গণঅভ্যুত্থানের একদফার ঘোষণা অনুযায়ী নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের দিকে হাঁটেন তারা। প্রথমে গঠন করা জাতীয় নাগরিক পার্টি এবং সেখান থেকে পরবর্তী সময়ে একটি নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত ও সম্ভাবনার বার্তা নিয়ে গত ২৮ ফেব্রুয়ারি আত্মপ্রকাশ করে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)।

অভ্যুত্থানের শক্তিকে সংহত করে দেশ পুনর্গঠনের লক্ষ্যে অভ্যুত্থানের নেতাদের উদ্যোগে গত বছরের ৮ সেপ্টেম্বর জাতীয় নাগরিক কমিটির যাত্রা শুরু হয়। এটিই ছিল মূলত দল গঠনের প্রথম প্রক্রিয়া। জাতীয় নাগরিক কমিটির মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠন ও পরবর্তী রাজনৈতিক কাঠামো পুনর্গঠন। এরপর গত বছরের ২ নভেম্বর কুষ্টিয়া জেলায় আহ্বায়ক কমিটি গঠনের মধ্য দিয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনও সাংগঠনিক কার্যক্রমের বিস্তৃতি ঘটানো শুরু করে।

পরবর্তী সময়ে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের প্রথম সারির নেতাদের সমন্বয়ে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটি যৌথ সিদ্ধান্তে পৌঁছায়। ৫ ফেব্রুয়ারি এক সংবাদ সম্মেলন থেকে নতুন রাজনৈতিক দল আসছে বলে ঘোষণা দেওয়া হয়। নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণের প্রত্যয় ব্যক্ত করে লিখিত বক্তব্যে তারা বলেন, ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার রক্তক্ষয়ী অভ্যুত্থানের মুখে গণহত্যাকারী আওয়ামী ফ্যাসিবাদী লীগের পতন ঘটে এবং ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়। ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগের পতন ঘটলেও রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে বিদ্যমান ফ্যাসিবাদী উপাদানের বিলোপ ঘটেনি। গণঅভ্যুত্থানের একদফা তথা ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার বিলোপ ও নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত বাস্তবায়ন, গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ প্রদান এবং সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচারের বাংলাদেশ গড়ার কাজ এখনো অসমাপ্ত রয়ে গেছে।

তারা আরও বলেন, এই জনপদের মানুষ ১৯৪৭-এর পাকিস্তান আন্দোলন, ১৯৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধ, ১৯৯০-এর অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে একটি জুলুম-শোষণহীন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষা বারবার ব্যক্ত করেছে; কিন্তু পূর্বের বিদ্যমান রাজনৈতিক দলগুলো এ আকাঙ্ক্ষাকে বাস্তবরূপ দিতে বারবার ব্যর্থ হয়েছে। ২০২৪ সালে ছাত্র-জনতার রক্তের বিনিময়ে আরেকবার এদেশের মানুষের সামনে গাঠনিক মুহূর্ত হাজির হয়েছে। সময়ের পরিক্রমায় ছাত্র-জনতার নেতৃত্বে সংঘটিত অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণ করা দেশের সর্বস্তরের নাগরিকের; বিশেষত, তরুণ জনগোষ্ঠীর নতুন আকাঙ্ক্ষা ও রাষ্ট্রকল্প তৈরি হয়েছে; কিন্তু বিদ্যমান রাজনৈতিক দলগুলো তা ধারণ করতে ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে। ফলে অভ্যুত্থানের শক্তি ছাত্র-তরুণরা অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে সৃষ্টি হওয়া নতুন আকাঙ্ক্ষা ও রাষ্ট্রকল্পকে ধারণ করে বাংলাদেশের ফ্যাসিবাদবিরোধী জনতাকে সঙ্গে নিয়ে একটি রাজনৈতিক দল গঠনের উদ্যোগ নিয়েছে।

সে সময় নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের প্রেক্ষাপট তুলে ধরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের তৎকালীন সদস্য সচিব আরিফ সোহেল বলেন, ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে স্বৈরাচারী ফ্যাসিস্ট শাসনের প্রতিভূ শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান। যে কোনো ঐতিহাসিক ঘটনার পর জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা প্রকাশিত হয়। চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানের পর জনগণের মনে সেরকম নতুন আশা-আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছে। তবে ছাত্র-জনতা ঔপনিবেশিক শোষণমূলক শাসনের ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতা দেখতে চায় না। এই আশা-আকাঙ্ক্ষা সঙ্গে নিয়ে মাঠে থাকতে একটি নতুন রাজনৈতিক দলের প্রয়োজন ছিল। রক্তের মধ্য দিয়ে গঠিত নতুন বাংলাদেশ গড়ার আকাঙ্ক্ষা সামনে নিয়ে এ দলটি কাজ করবে। এ দলটি ঐতিহাসিক দায় থেকে গঠিত হচ্ছে।

সে সময় সবচেয়ে বড় ঘটনা ছিল একদফার ঘোষক, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম উপদেষ্টা পদ থেকে পদত্যাগের ঘটনা। ২৫ ফেব্রুয়ারি সরকার থেকে পদত্যাগ করে নতুন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকার কথা প্রকাশ্যে আনেন। সে সময় এক সংবাদ সম্মেলনে নাহিদ ইসলাম বলেছেন, গণতান্ত্রিক পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষার জন্য এবং গণঅভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারী ছাত্র-জনতার শক্তিকে সংহত করতে, সরকারে থাকার চেয়ে রাজপথে তার ভূমিকা বেশি হবে। সে জন্য তিনি পদত্যাগ করেছেন।

ব্রিফিংয়ে নাহিদ বলেন, দেশের বর্তমান যে পরিস্থিতি, সে পরিস্থিতিতে একটি রাজনৈতিক শক্তির উত্থানের জন্য আমার রাজপথে থাকা প্রয়োজন, ছাত্র-জনতার কাতারে থাকা প্রয়োজন। আমরা যে গণতান্ত্রিক পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা করি, সেই আকাঙ্ক্ষার জন্য এবং গণঅভ্যুত্থানে যে ছাত্র-জনতা অংশগ্রহণ করেছে, সেই শক্তিকে সংহত করতে, আমি মনে করেছি যে, সরকারে থাকার চেয়ে সরকারের বাইরে থেকে রাজপথে আমার ভূমিকা বেশি হবে এবং বাইরে যে সহযোদ্ধারা রয়েছেন, তারাও এটি চান। সেই পরিপ্রেক্ষিতে আমি পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছি।

এরপর চলতি বছরের ২৮ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যা ৬টা ২০ মিনিটে রাজধানীর মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ে এ দলের নাম ঘোষণা করেন শহীদ মো. ইসমাইল হাসান রাব্বির বোন মিম আক্তার। তিনি বলেন, আপনাদের মনে আছে—গত ৫ আগস্ট দুই বোনের কাঁধে ভাইয়ের লাশ; সে দুই বোনের মধ্যে আমি একজন। ইতিহাসে এমন ঘটনা ঘটেনি। ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানের পর ছাত্র-জনতার নেতৃত্বে রাজনৈতিক দলের নাম জাতীয় নাগরিক পার্টি ঘোষণা করছি। এ সময় তিনি আহ্বায়ক হিসেবে নাহিদ ইসলাম এবং সদস্য সচিব হিসেবে আখতার হোসেনের নাম ঘোষণা করেন। ঘোষণাপত্রে স্পষ্ট করা হয়—দলটি কেবল ক্ষমতার জন্য নয়, বরং জনগণের ঐক্য, গণতান্ত্রিক সংস্কার, স্বচ্ছ প্রশাসন ও দুর্নীতি দমনের লক্ষ্য নিয়ে কাজ করবে।

আত্মপ্রকাশের পর নানান চড়াই-উতরাই পার করেছে জাতীয় নাগরিক পার্টি। শুরুতে সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা ছিল সীমাহীন। দিন যত গড়ায় মানুষের সেই প্রত্যাশায় ভাটা পড়ে। বিশেষ করে দল গঠনের পর থেকেই এনসিপির অভ্যন্তরে বিশৃঙ্খলা, নেতাদের মধ্যে সমন্বয়হীনতা, কোনো কোনো নেতার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ—এসব নানা কারণে দলটি ইমেজ সংকটে পড়েছে। তবে জুলাই মাসকে কেন্দ্র করে আবারও ছন্দে ফিরেছে এনসিপি। দেশব্যাপী জুলাই পদযাত্রা করে মানুষের ভালোবাসায় সিক্ত হয়েছে দলটি। সর্বশেষ গত রোববার নতুন বাংলাদেশ গঠনে ২৪ দফা ইশতেহারও ঘোষণা করে দলটি। দ্বিতীয় রিপাবলিক প্রতিষ্ঠায় নতুন সংবিধান প্রণয়ন, জুলাই অভ্যুত্থানের স্বীকৃতি ও বিচার, গণতন্ত্র ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের সংস্কারসহ রাষ্ট্র সংস্কারের নানান বিষয় স্থান পায় এতে।

ইশতেহার ঘোষণাকালে ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার বিলোপ করে একটি নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত তৈরির বিষয়ে আশাবাদ ব্যক্ত করে এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেন, কেবল এক ফ্যাসিবাদী শাসনব্যবস্থা হটিয়ে আরেক ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থা উত্থানের সম্ভাবনা জিইয়ে রেখে আমরা নিশ্চিন্তে ঘরে ফিরতে পারিনি। বরং তাদের সমূলে উৎপাটন ও জনআকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়ন করতে জাতীয় নাগরিক পার্টি গঠন করেছি।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

প্লট ও ফ্ল্যাট বরাদ্দে মন্ত্রী-সচিবসহ যাদের কোটা বাতিল

১১ বছর আগে মারা যাওয়া স্বামীই সন্তানের বাবা, দাবি অন্তঃসত্ত্বার

ডাকসু নির্বাচন / দ্বিতীয় দিনে মনোনয়নপত্র নিয়েছেন ১৩ জন

জরায়ুর বদলে লিভারে বেড়ে উঠছে ভ্রূণ, বিস্মিত চিকিৎসকরাও

ঋণখেলাপিরা নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে না : অর্থ উপদেষ্টা

মোদির হাতেই দেশ নিরাপদ, বললেন কংগ্রেস নেতা

অসহায় বিধবা পরিবারকে আর্থিক সহায়তা দিলেন তারেক রহমান

এবার জাফলংয়ে পাথর লুটপাট বন্ধে অভিযান

ইবতেদায়ি মাদ্রাসার এমপিওভুক্তি নিয়ে সুখবর

একবার ফোন চার্জ দিলে কত টাকা খরচ হয় আপনার? জেনে নিন

১০

১২ হাজার কোটি টাকা রেমিট্যান্স এলো ১২ দিনে

১১

ভারতকে পাক সেনাপ্রধানের পরমাণু যুদ্ধের হুমকি, যা বলল যুক্তরাষ্ট্র

১২

এসএসসি পাসেই পানি উন্নয়ন বোর্ডে চাকরি, নেবে ২৮৪ জন

১৩

বিচ্ছেদের পর কাজ থেকে বিরতি, এখনো চিকিৎসা নিচ্ছেন ফারিয়া

১৪

হস্তান্তরের আগেই নবনির্মিত স্কুল ভবনে ফাটল

১৫

পরীক্ষায় কম নম্বর দেওয়ায় শিক্ষিকাকে মারধর করল ছাত্র

১৬

অভাব-ঋণের ভারে মা-মেয়ের বিষপান

১৭

বিএনপির বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাচ্ছে একটি ধর্মভিত্তিক দল : রিজভী

১৮

হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি বাড়ায় যে ৬ খাবার, বাদ দিন এখনই

১৯

সমুদ্রে মাছ ধরছেন প্রভা

২০
X