ইউসুফ আরেফিন
প্রকাশ : ০৪ অক্টোবর ২০২৫, ১২:০০ এএম
আপডেট : ০৪ অক্টোবর ২০২৫, ০৮:২৭ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

মানব পাচার ঠেকানোর তোড়জোড় কেবল কাগজে-কলমে

উদ্যোগ আছে সুফল নেই
ফাইল ছবি
ফাইল ছবি

মানব পাচার প্রতিরোধে সরকারের পক্ষ থেকে কাগজে-কলমে নানা উদ্যোগের কথা বলা হলেও বাস্তবে সেগুলোর বাস্তবায়ন চোখে পড়ে না। ফলে প্রতি বছরই আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার (আইওএম) হিসাবে মানব পাচারে ঘুরেফিরে শীর্ষ দশটি দেশের মধ্যেই থাকছে বাংলাদেশ। এরই ধারাবাহিকতায় চলতি বছর তালিকার শীর্ষে রয়েছে বাংলাদেশ। এটিকে দেশের জন্য ‘লজ্জাজনক’ বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। তাদের ভাষ্য, সরকার ঘোষিত উদ্যোগগুলোর বাস্তবায়ন হলে কমত মানব পাচার।

সংশ্লিষ্টদের ভাষ্য, মানব পাচারের অন্যতম কারণ দেশে কাঙ্ক্ষিত কর্মসংস্থানের অপ্রতুলতা। ফলে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত পরিবারের তরুণ-তরুণীরা ভালো কাজের প্রলোভনে পাচারকারী চক্রের খপ্পরে পড়েন। ভালো বেতনে চাকরির আশায় তারা ভূমধ্যসাগর কিংবা স্থলপথে বিদেশে যেতে মৃত্যুর মুখোমুখি হচ্ছেন। আইওএমের হিসাবে, গত পাঁচ বছরে সমুদ্র ও স্থলপথে ইউরোপে পাচারের সময় ১৫ হাজার ৭৯৪ জন অভিবাসনপ্রত্যাশী মানুষ নিহত ও নিখোঁজ হয়েছেন। তাদের মধ্যে বাংলাদেশি কতজন মারা গেছেন, তা জানা সম্ভব হয়নি। তবে সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তর ও বেসরকারি সংস্থাগুলোর ধারণা, অবৈধভাবে ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যে যেতে প্রতি বছর অন্তত ৪০০ থেকে ৫০০ বাংলাদেশি নিহত ও নিখোঁজ হন। অথচ এই পাচার প্রতিরোধে সরকারের দৃশ্যমান কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেই। কাগজে-কলমে কিছু উদ্যোগ থাকলেও তার বাস্তবায়ন নেই বললেই চলে। ফলে বছর বছর পাচারের সংখ্যা বেড়েই চলেছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকারকে বড় পরিসরে এটি নিয়ে কাজ করতে হবে। কারণ বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে এখন আর তালিকার নিচের দিকে নেই। যুদ্ধ বিধ্বস্ত সিরিয়া, লিবিয়া, আফগানিস্তান কিংবা তিউনেশিয়ার চেয়েও বাংলাদেশের অবস্থা ভালো এবং অর্থনৈতকভাবে স্থিতিশীল। অথচ এসব দেশ থেকে যে সংখ্যক মানুষ পাচার হচ্ছে বাংলাদেশ থেকেও সে সংখ্যা প্রায় একই। গত পাঁচ বছরের পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, মানব পাচার কমছে না। বরং দিন দিন বেড়েই চলছে। পাচার বন্ধে সরকারের কি সদিচ্ছা নেই, না-কি পারছে না, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।

তবে পাচাররোধে বসে নেই বলে দাবি সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোর কর্মকর্তাদের। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব (রাজনৈতিক-১ অধিশাখা) মু. জসীম উদ্দিন খান কালবেলাকে বলেন, ‘গত ২৯ সেপ্টেম্বর মানব পাচারের শিকার ব্যক্তিদের সুরক্ষা ও সহায়তায় ডিজিটাল ন্যাশনাল রেফারেল মেকানিজম (এনআরএম) প্ল্যাটফর্মের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেছেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা। ডিজিটাল এনআরএম ভুক্তভোগীদের আরও কার্যকরভাবে শনাক্তকরণ, অনুমোদিত সেবা প্রদানকারীদের সঙ্গে নিরবচ্ছিন্ন সংযোগ, সেবার গুণগত মান নিয়ন্ত্রণ, তদারকি ও মনিটরিং ব্যবস্থার মাধ্যমে রেফারেলে গতি-স্বচ্ছতা আনয়ন এবং পাশাপাশি জবাবদিহি নিশ্চিত করবে।’ ভুক্তভোগীদের পাশাপাশি মানব পাচার নিয়ে কাজ করা সব পক্ষ এই ডিজিটাল সিস্টেমে ঢুকে সেবা নিতে পারবে বলেও জানান স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এই কর্মকর্তা।

ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপে ঢোকার ঝুঁকিপূর্ণ চেষ্টা: লিবিয়া থেকে ২০২৪ সালে দেশে ফেরত আসা ৫৫৭ জন বাংলাদেশির ওপর গবেষণা করে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাক। এতে জানানো হয়, এসব মানুষের যাত্রা, গন্তব্য, অর্থ, নিপীড়ন, উদ্ধার থেকে শুরু করে প্রত্যেকের ৫০ ধরনের তথ্য বিশ্লেষণ করে প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে। ইউরোপীয় সীমান্ত ও উপকূলরক্ষী বাহিনীগুলোর সমন্বয়ের দায়িত্বে থাকা ফ্রন্টেক্সের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশিরা লিবিয়া থেকে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপে ঢোকার চেষ্টা করে সবচেয়ে বেশি। এটি সেন্ট্রাল মেডিটেরিয়ান রুট হিসেবে পরিচিত। ২০০৯ থেকে ২০২৩ সাল পযর্ন্ত এই পথে অন্তত ৭০ হাজার ৯০৬ জন বাংলাদেশি ইউরোপে ঢুকেছেন। তবে এভাবে প্রবেশ করতে গিয়ে মাঝে মধ্যেই ঘটছে প্রাণহানির ঘটনা।

ব্র্যাকের এই গবেষণায় অংশ নেওয়া ৫৫৭ জনের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, তাদের ৬০ শতাংশের পরিবারকে স্থানীয় দালালরা ভালো চাকরির প্রলোভন দেখায়; কিন্তু ৮৯ শতাংশই চাকরি বা কোনো কাজ পাননি। উল্টো নানা ধরনের ঝুঁকিতে পড়েছেন। ঢাকা থেকে দুবাই-মিশর হয়ে লিবিয়া গেছেন সবচেয়ে বেশি মানুষ। এ ছাড়া ঢাকা থেকে ইস্তাম্বুল-দুবাই হয়ে লিবিয়া, ঢাকা থেকে কাতার হয়ে লিবিয়া, ঢাকা থেকে দুবাই-সিরিয়া হয়ে লিবিয়া এবং অল্পসংখ্যক ঢাকা থেকে সরাসরি লিবিয়া গেছেন।

ব্র্যাকের ওই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, এভাবে লিবিয়া যাওয়ার পথে ৬৩ শতাংশই বন্দি হয়েছেন, যাদের ৯৩ শতাংশই ক্যাম্পে বন্দি ছিলেন। বন্দিদের ৭৯ শতাংশই শিকার হন শারীরিক নির্যাতনের। এ ছাড়া লিবিয়ায় পৌঁছানোর পর ৬৮ শতাংশই মুক্তভাবে চলাচলের স্বাধীনতা হারান। ৫৪ শতাংশই বলেছেন, তারা কখনো তিনবেলা খাবার পাননি। অন্তত ২২ শতাংশ দিনে মাত্র একবেলা খাবার পেয়েছেন। এভাবে লিবিয়া হয়ে ইউরোপে যাওয়ার জন্য অর্থ কোথায় পেয়েছেন—এমন প্রশ্নের উত্তরে ৫৬ শতাংশ বলেছেন, তারা নিজেরাই এই টাকা জোগাড় করেছেন। ২৩ শতাংশ বলেছেন, তারা পরিবারের কাছ থেকে অর্থ সহায়তা নিয়েছেন।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, বাংলাদেশ থেকে ইউরোপে পাঠানোরে প্রলোভন দেখিয়ে যাদের লিবিয়া নেওয়া হয়, তাদের সবাইকে ভালো চাকরির প্রলোভন দেখালেও তারা চাকরি পায় না। উল্টো অধিকাংশকেই লিবিয়ার বিভিন্ন ক্যাম্পে বন্দি রেখে শারীরিক নির্যাতন করা হয়েছে। তাদের জিম্মি করে পরিবারের কাছ থেকে আদায় করা হয় মোটা অঙ্কের অর্থ। তবে এতকিছুর পরেও ভূমধ্যসাগর পেরিয়ে ইউরোপের উন্নত জীবনের স্বপ্নে লিবিয়া যাওয়ার প্রবণতা থামছে না।

এ প্রসঙ্গে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা কালবেলাকে বলেন, ‘দেখুন পাচার বন্ধ করা খুবই কঠিন। কারণ যেসব লোক প্রতিবেশী দেশ ভারত, লিবিয়া কিংবা অন্য কোনো দেশ হয়ে ইউরোপে যাচ্ছে, তারা কিন্তু বৈধ ভিসা নিয়েই যাচ্ছেন। একজন মানুষের কাছে যদি লিবিয়া, ভারত কিংবা আরব আমিরাতের ভিসা থাকে আপনি তাকে কীভাবে আটকাবেন? কারণ তিনি তো প্রথমে ওইসব দেশে যাচ্ছেন। পরে সেখান থেকে নৌ কিংবা সড়কপথে ইউরোপে ঢুকছেন। সুতরাং তাকে আটকানোর মতো কোনো টুলস (পদ্ধতি) সরকারের হাতে নেই। এটা হলো বাস্তবতা। তবে হ্যাঁ, জেলা-উপজেলা পর্যায়ে খোঁজ নেওয়া যেতে পারে এসব লোক কাদের মাধ্যমে যাচ্ছে। তাহলে হয়তো পাচারকারীদের শনাক্ত করা সম্ভব।’

যদিও সরকারি এই কর্মকর্তার এমন ভাষ্যের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেন ব্র্যাকের মাইগ্রেশন প্রোগ্রাম ও ইয়ুথ প্ল্যাটফর্মের সহযোগী পরিচালক শরিফুল ইসলাম হাসান। তিনি কালবেলাকে বলেন, ‘কর্মকর্তাদের এমন বক্তব্য মোটেই গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ যে লোকটি জীবনে কখনোই বিদেশে যাননি, তিনি যদি হঠাৎ করে লিবিয়া কিংবা অন্য কোনো দেশের ভিসা হাতে নিয়ে ঘুরেন তাহলে বিষয়টি খুব সহজে বোঝার কথা। বিশেষ করে ফরিদপুর, শরীয়তপুর, মাদারীপুর কিংবা গোপালগঞ্জসহ যেসব জেলার লোক বেশি সংখ্যায় অবৈধ পথে বিদেশে যান, যদি সেসব জেলার হন তাহলে তার মাধ্যমেই পাচারকারীদের চিহ্নিত করা সম্ভব। এটি সরকারের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর জন্য সহজ বিষয়। তারা চোর-ডাকাত খুনিদের গ্রেপ্তার করতে পারেন। অথচ মানব পাচারকারীদের ধরতে পারেন না! মূলত এখানে সদিচ্ছার অভাব।’

যেসব দেশে পাচার বেশি: স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়—এশিয়ার দেশ ভারত, মালয়েশিয়া, ব্রুনাই, থাইল্যান্ড, ইউরোপের ইতালি, গ্রিস, পর্তুগাল, সাইপ্রাস, স্পেন এবং মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সৌদি আরব, ওমান, কাতার, ইরাক ও লিবিয়ায় মানব পাচার হচ্ছে। মূলত এসব দেশে উচ্চ বেতনে চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত পরিবারের চাকরিপ্রত্যাশী তরুণ-তরুণীদের পাচার করছে দালালরা। পাচারের শিকার বেশিরভাগই নারী-পুরুষ। তবে সম্প্রতি শিশুদেরও পাচার করা হচ্ছে। আর পাচারকৃত অনেকের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গও বিক্রি করা হচ্ছে বলে সরকারের কাছে তথ্য রয়েছে।

পাঁচ বছরে কত পাচার: আইওএমের হিসাবে গত পাঁচ বছরে বাংলাদেশ থেকে ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচের দেশগুলোতে ৬৮ হাজার ৩৭০ জন বাংলাদেশি পাচার হয়েছে। চলতি বছর পাচারের শীর্ষ ১০টি দেশের তালিকায় বাংলাদেশ শীর্ষে অবস্থান করছে।

আইওএমের হিসাবে এ বছর (২০২৫) সমুদ্র ও স্থলপথে বাংলাদেশ থেকে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ১৫ হাজার ৯৫ জন পাচার হয়েছে। তাদের বেশিরভাগেরই গন্তব্য ছিল ইতালি। যদিও এটি চলতি বছরের সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত সময়ের তথ্য, বছরের বাকি তিন মাসের তথ্য এতে যোগ হলে পাচারের সংখ্যা আরও বাড়বে। তালিকায় দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে মিশর। দেশটি থেকে ১১ হাজার ৬২২ জন পাচার হয়েছে। তৃতীয় অবস্থানে থাকা যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ আফগানিস্তান থেকে পাচার হয়েছে ৯ হাজার ৪৪৬ জন। চতুর্থ অবস্থানে রয়েছে সুদান। দেশটি থেকে ৭ হাজার ২৫৪ জন, পঞ্চম ইরিত্রিয়া থেকে ৬ হাজার ৭৩১, ষষ্ঠ মালি থেকে ৬ হাজার ২৩৬, সপ্তম আলজেরিয়া থেকে ৫ হাজার ১৩৩ জন এবং অষ্টম অবস্থানে থাকা সোমালিয়া থেকে পাচার হয়েছে ৩ হাজার ৯৩৯ জন। এই তালিকায় পাকিস্তানের অবস্থান নবম। দেশটি থেকে ৩ হাজার ৬১০ জন পাচারের ঘটনা ঘটেছে। আর দশম অবস্থানে থাকা সিরিয়া থেকে পাচার হয়েছে ৩ হাজার ৩১৬ জন।

বাংলাদেশ ২০২৪ সালের তালিকায় ছিল চতুর্থ অবস্থানে। ওই বছর পাচার হয় ১৫ হাজার ৩০৪ জন। এ বছরের সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে করা হিসাবের তুলনায় এক বছরের ব্যবধানে পাচারের সংখ্যা কমেছে মাত্র ২০৯ জন। তবুও চলতি বছর বাংলাদেশ পাচারের তালিকায় শীর্ষে অবস্থান করছে। অথচ গত বছর ৪৩ হাজার ৬১৭ জন পাচার হওয়া যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ সিরিয়া তালিকার প্রথম স্থানে থেকেও চলতি বছর মানব পাচার রোধে অভাবনীয় সাফল্য দেখিয়ে তালিকার দশম স্থানে নামতে সক্ষম হয়েছে। চলতি বছর দেশটি থেকে মাত্র ৩ হাজার ৩১৬ জন পাচার হয়েছে। অবশ্য বর্তমানে সিরিয়ার অবস্থা স্থিতিশীল হওয়ায় দেশটি থেকে কেউ এখন বের হচ্ছে না বলে ধারণা করা হচ্ছে।

২০২৩ সালে বাংলাদেশ থেকে ১৩ হাজার ৫২৯ জন পাচার হয়। ২০২২ সালে এ সংখ্যা ছিল ১৬ হাজার ৪৮৭ জনে। ২০২১ সালে পাচারের সংখ্যা ছিল ৭ হাজার ৯৫৫ জন। আর ২০২০ সালে পাচার হয় ৪ হাজার ৫১০ জন। আইওএমের হিসাব বলছে, বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছরই মানব পাচারের সংখ্যা বাড়ছে। চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময়ের হিসাবে গত বছরের তুলনায় ২০৩ জন কম পাচার হয়েছে। তবে এটিকে খুব বেশি সফলতা ধরে নেওয়া যাচ্ছে না।

১৫ জেলা থেকে বেশি পাচার: সরকারি তথ্য ও বেসরকারি সংস্থাগুলোর হিসাবে দেশের ১৫টি জেলা থেকে সবেচেয়ে বেশি মানব পাচারের ঘটনা ঘটছে। জেলাগুলো হলো—মাদারীপুর, শরীয়তপুর, ফরিদপুর, সিলেট, সুনামগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, চাঁদপুর, নোয়াখালী, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কুষ্টিয়া, কুমিল্লা, কক্সবাজার, চুয়াডাঙ্গা, নরসিংদী ও সাতক্ষীরা।

পাচারকৃতদের কপালে জোটে যে দুর্গতি: সরকারি তথ্য বলছে, বিদেশের পাশাপাশি দেশের মধ্যেও নারী ও শিশু পাচারের ঘটনা ঘটছে। শিশুদের জোরপূর্বক শ্রমে নিযুক্তকরণ, যৌন নির্যাতন, জোরপূর্বক বিয়ে, চুরি-ডাকাতির মতো অপরাধে যুক্ত করা এবং ভিক্ষাবৃত্তিতে জড়ানো হয়। আর প্রাপ্তবয়স্ক পাচারকৃতদের জোরপূর্বক নির্মাণ ও কৃষি শ্রমে যুক্ত এবং জাহাজ ভাঙা শিল্প, যৌন নির্যাতন ও গৃহ শ্রমিকের মতো কাজে সম্পৃক্ত করা হয়। এমনকি অনেকের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গও বিক্রি করে দেয় পাচারকারীরা।

পাচার রোধে সরকারের উদ্যোগ: মানব পাচার প্রতিরোধে বেশ কিছু উদ্যোগ নেওয়ার কথা জানিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। তবে সরকার ঘোষিত এসব উদ্যোগেও পাচার রোধ করা সম্ভব হচ্ছে না। মন্ত্রণালয়ের এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, গত বছর বাংলাদেশ পুলিশের ৭ হাজার ২৫১ জন সদস্যকে মানব পাচার প্রতিরোধবিষয়ক প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) ৬০৪ জন ও কয়েকটি গোয়েন্দা সংস্থার ২২৩ জন কর্মকর্তাকে পাচার রোধ বিষয়ে আইনকানুন সম্পর্কে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। এর বাইরে মানব পাচার অপরাধ দমন ট্রাইব্যুনালের ১০৬ জন বিচারক, ২৭ জন পুলিশ সদস্য, ২৭ জন পাবলিক প্রসিকিউটর, ৬২ জন প্যানেল আইনজীবী এবং ৫৭ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। তবে পর্যাপ্ত বরাদ্দের অভাবে বর্তমানে এ প্রশিক্ষণ কর্মসূচি বন্ধ রয়েছে। বরাদ্দ পাওয়া গেলে আবারও পুলিশের প্রশিক্ষণ চালু করা হবে বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা। যদিও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত লোকজনও ঠিকমতো কাজ করেন না বলে অভিযোগ রয়েছে। শুধু তাই নয়, যারা এসব উদ্যোগে হাত দেন তারাও কয়েকদিন পরপর বদলি হন। ফলে গৃহীত উদ্যোগ আর আলোর মুখ দেখে না।

স্বরাষ্ট্রের এই কর্মকর্তা আরও জানান, মন্ত্রণালয়ের কাছে এ বিষয়ে আর্থিক বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে। মানব পাচার নিয়ে যে পরিসরে কাজ করার কথা, তা আসলে হচ্ছে না। তবে বড় পরিসরে শিগগির এ বিষয়ে কাজ হবে বলে আশা করেন তিনি।

পাচারের শিকার ব্যক্তিদের সুরক্ষা ও সহায়তা দিতে গত ২৯ সেপ্টেম্বর এনআরএম প্ল্যাটফর্মের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। জাস্টিস অ্যান্ড কেয়ার বাংলাদেশের কারিগরি সহায়তা এবং যুক্তরাজ্যের মডার্ন স্লেভারি ইনোভেশন ফান্ড (এমএসআইএফ) হোম অফিসের সমর্থনে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এই ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মটি তৈরি করে। মানব পাচারপ্রবণ চারটি জেলায় পাইলটিং করার পর এটি এখন জাতীয় পর্যায়ে বাস্তবায়নের পথে হাঁটছে সরকার। এই প্ল্যাটফর্মটি দীর্ঘমেয়াদে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে পরিচালিত হবে।

কর্মকর্তারা জানান, ডিজিটাল এনআরএমের পাশাপাশি সরকার মানব চোরাচালান প্রতিরোধে আইন পর্যালোচনা, ২০২৬-৩০ সাল পর্যন্ত মানব পাচারবিরোধী জাতীয় কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন, সিআইডিতে বিশেষায়িত তদন্ত ইউনিট গঠন এবং ভুক্তভোগী শনাক্তকরণ নির্দেশিকা বাধ্যতামূলক করার মতো বিস্তৃত সংস্কারমূলক কার্যক্রমও এগিয়ে নিচ্ছে। তবে এসব কার্যক্রম বাস্তবেই পাচার রোধ করতে সক্ষম হবে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।

ব্র্যাকের মাইগ্রেশন প্রোগ্রাম ও ইয়ুথ প্ল্যাটফর্মের সহযোগী পরিচালক শরিফুল ইসলাম হাসান বলেন, ‘বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর যে সংখ্যক মানুষ পাচার হচ্ছে, তা খুবই বিপজ্জনক। পাচারে বাংলাদেশ প্রায়ই শীর্ষ দেশের তালিকায় থাকে। এটি দেশের জন্য খুবই লজ্জাজনক।’

মানব পাচার প্রতিরোধে সরকারের যে ধরনের উদ্যোগ নেওয়া দরকার বলে মনে করেন, সে সংখ্যক উদ্যোগ দেখতে পাচ্ছে না বলে জানান নিরাপদ অভিবাসন নিয়ে কাজ করা ব্র্যাকের এই কর্মকর্তা। শরিফুল হাসান কালবেলাকে বলেন, ‘সামান্য যেসব উদ্যোগ নেওয়া হয় সেগুলোও ঠিকমতো বাস্তবায়ন হচ্ছে না। ফলে পাচার কিন্তু থেমে নেই। সরকার তো জানে দেশের ১০-১২টি জেলার মানুষই বেশি অবৈধ পথে বিদেশে যায়। সেসব জেলায় কারা কারা পাচারে যুক্ত, তাদের স্থানীয় লোকজন চেনে। সুতরাং খুবই সহজে সেসব পাচারকারীকে আইনের আওতায় আনা সম্ভব। কিন্তু আমরা সেটি দেখি না।’

পাচার বন্ধে কার্যকর উপায় কী হতে পারে—এমন প্রশ্নে শরিফুল বলেন, ‘এলাকার স্থানীয় দালাল ও মানব পাচার চক্রকে চিহ্নিত করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সমন্বিত অভিযান চালাতে হবে। বিশেষ করে অর্থের লেনদেন খুঁজে বের করতে হবে। পাশাপাশি যে আন্তর্জাতিক মানব পাচারকারী চক্র রয়েছে লিবিয়া বা অন্য দেশে, তাদের বিরুদ্ধেও আন্তর্জাতিক আইন ব্যবহার করে সোচ্চার হতে হবে। পাশাপাশি লিবিয়া, সিরিয়া, আফগানিস্তান—এই এলাকাগুলোর স্থিতিশীলতা জরুরি। নয়তো সেখানকার মানুষ জীবন বাঁচাতে ইউরোপে প্রবেশের চেষ্টা করবে, আর সেই সুযোগে পাচারকারীরা বাংলাদেশের মতো আরও অনেক দেশের নাগরিকদের সেখানে যুক্ত করবে। কাজেই সম্মিলিতভাবে এই পাচারকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে।’

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

বদলির আদেশের ৩ সপ্তাহ পরও অফিস করছেন রাসিক সচিব

ড. তোফায়েল আহমেদ মারা গেছেন

চার দিন ধরে নিখোঁজ বিকাশ কর্মী ওমর ফারুক

ওসির বিরুদ্ধে দুর্বল ধারার অভিযোগ, আ.লীগ নেতার ৩ সন্তানের জামিন

বরিশালে মা ইলিশ রক্ষায় নৌবাহিনী, চার দিনে ১০৪ জেলের কারাদণ্ড

উচ্ছেদের পর অবৈধ স্থাপনার বৈধতা দিতে তোড়জোড়

ধর্ষণের আলামত গায়েব, ওসিসহ দুজনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা

সীমান্তে দেড় কোটি টাকার কষ্টি পাথরের মূর্তি উদ্ধার

রাজধানীতে যুবলীগ নেত্রী লাবণ্য ও নিষিদ্ধ ছাত্রলীগ নেতা আমির হামজা গ্রেপ্তার

কাঁচা নাকি পাকা পেঁপে, কোনটি ভালো জেনে নিন

১০

পাঁচ দফা দাবিতে নারায়ণগঞ্জ নগরভবন ঘেরাও

১১

টাইফয়েড টিকা : যেসব উত্তর জানা জরুরি

১২

দুদিনের কর্মসূচি নিয়ে জামায়াতের নতুন বার্তা

১৩

আফগানিস্তানের সম্পদ ফিরিয়ে দেওয়ার আহ্বান রাশিয়ার

১৪

২৮০-এর কথা বলে ২২১ রানেই শেষ বাংলাদেশ

১৫

ওমানে মাছ ধরে বাসায় ফেরা হলো না ৮ বাংলাদেশির

১৬

সাংবাদিক শহীদুল আলমকে আটকে রিজভীর উদ্বেগ

১৭

নির্বাচন নিয়ে যে কোনো ষড়যন্ত্র শক্ত হাতে মোকাবিলা করা হবে : কফিল উদ্দিন

১৮

দুদিন পর উদযাপিত হবে জবির এবারের বিশ্ববিদ্যালয় দিবস

১৯

দেশের বাজারে স্বর্ণের দামে বড় লাফ, ফের ইতিহাস

২০
X