বাংলাদেশে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন নিশ্চিতে আরোপিত মার্কিন ভিসা নিষেধাজ্ঞায় মোটেও চিন্তিত নয় একদফা দাবিতে আন্দোলনে থাকা বিএনপি। বরং ভিসা বিধিনিষেধের এই ঘটনাকে ইতিবাচক হিসেবেই দেখছে দলটি। বিএনপি নেতারা বলছেন, সরকারের কারণেই এ ধরনের পরিস্থিতি হয়েছে। ফলে ক্ষমতাসীনদের জন্যই এটি চিন্তার বিষয়। তাদের দাবি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বে গণতন্ত্রের কথা বলছে। এ লক্ষ্যে তারা বাংলাদেশে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন চায়। এর অংশ হিসেবে বাংলাদেশে গণতন্ত্রের পক্ষে পদক্ষেপ নিয়েছে বাইডেন প্রশাসন।
বিএনপিও দেশে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের লক্ষ্যে জনগণকে সঙ্গে নিয়ে শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলন করছে। অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনে জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়েই সেই গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা সম্ভব।
বিএনপি মনে করে, সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টির জন্য এখনো সরকারের অবস্থানের কোনো পরিবর্তন হয়নি। তাই ভিসা নিষেধাজ্ঞাকে ইতিবাচক হিসেবে দেখলেও রাজপথে আন্দোলনের মধ্য দিয়েই দাবি আদায় করতে চান তারা।
বাংলাদেশের নির্বাচন সুষ্ঠু ও অবাধ করার লক্ষ্যে যুক্তরাষ্ট্র ভিসা নীতি ঘোষণা করেছে গত ২৪ মে। এই ঘোষণার চার মাসের মাথায় গত শুক্রবার দেশটির পক্ষ থেকে বলা হয়, গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়াকে বাধাদানে দায়ী ও জড়িত ব্যক্তিদের ওপর ভিসা বিধিনিষেধ আরোপের পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। এসব ব্যক্তির মধ্যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল ও বিরোধী দলের সদস্যও রয়েছেন। ভিসা নীতির আওতায় পড়া ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্যদের ওপরও এ নীতি প্রয়োগ হতে পারে।
বাংলাদেশে মার্কিন ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপের জন্য ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার এককভাবে দায়ী বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি বলেন, এ ঘটনা বাংলাদেশের জন্য অপমানজনক ও লজ্জাজনক। বিএনপি মহাসচিব বলেন, সরকার নির্বাচন ব্যবস্থাকে ধ্বংস করেছে। মানুষের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা কেড়ে নিয়েছে এবং মানবাধিকার লঙ্ঘন করে চলেছে। বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের নির্যাতন ও গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। এসব কারণে যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশ থেকে নানারকম পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্রের এই পদক্ষেপে বাংলাদেশে নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হবে—এমনটা বিএনপি মনে করছে কি না—এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্র তাদের ভিসা নীতি দিয়েছে। কিন্তু সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন করার পরিবেশ সৃষ্টির জন্য সরকারের অবস্থানের কোনো পরিবর্তন এখনো হয়নি। আসলে এখন সরকার কী করবে, সেটা তাদের ওপর নির্ভর করছে। আর আমরা জনগণকে সঙ্গে নিয়ে আমাদের আন্দোলন অব্যাহত রাখব।
মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে আত্মপ্রকাশ করা স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের ওপর ভিসা নিষেধাজ্ঞা কোনো আনন্দের সংবাদ নয় বলে মনে করেন বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু। তিনি বলেন, আমাদের দেশের ৫২ বছর বয়স হয়েছে। এই সময়ে আমাদের অর্জন আমেরিকার স্যাংশন ও ভিসা নীতি। কারণ বাংলাদেশে গণতন্ত্র, ভোটের অধিকার ও মানবাধিকার নেই। আর এই কারণে আমেরিকা আগে স্যাংশন দিয়েছিল, এখন ভিসা নীতি কার্যক্রম শুরু করেছে। কেন বাংলাদেশের ওপর ভিসা নিষেধাজ্ঞা আসবে? এটা কোনো আনন্দের সংবাদ নয়।
আওয়ামী লীগ সরকারের একগুঁয়েমির কারণে দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ‘জঘন্য’ ভিসা নিষেধাজ্ঞার কবলে পড়ল বলে মনে করেন বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কবিষয়ক কমিটির সদস্য শামা ওবায়েদ। তিনি কালবেলাকে বলেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইতোমধ্যে ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপের প্রক্রিয়া শুরু করেছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নও ইতোমধ্যে বলে দিয়েছে যে, নির্বাচনে তারা কোনো পর্যবেক্ষক পাঠাবে না। কারণ, শেখ হাসিনার সরকারের অধীনে বাংলাদেশে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের কোনো পরিবেশ তারা দেখছেন না। এরপর তো আর বলার কিছু বাকি থাকে না। শেখ হাসিনার সরকারের ওপর আন্তর্জাতিক বিশ্বের আর কোনো আস্থা নেই।
এদিকে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকে মনে করেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও বিএনপির দাবি আজ এক ও অভিন্ন। উভয়পক্ষই বাংলাদেশে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন চায়। সুতরাং মার্কিন ভিসা নিষেধাজ্ঞা বিএনপির জন্য ইতিবাচক হবে। তবে বিএনপিকে শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলন চালিয়ে যেতে হবে।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. নুরুল আমিন বেপারী কালবেলাকে বলেন, মার্কিন ভিসা নিষেধাজ্ঞা বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলোর জন্য ইতিবাচক হবে। কারণ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন চায়। বিএনপিও সেই দাবিতে শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলন করছে। অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্র ও বিএনপির দাবি আজ এক ও অভিন্ন।
ভিসা নিষেধাজ্ঞায় বিরোধী দলের কথাও বলা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে এই রাজনৈতিক বিশ্লেষক বলেন, আমার মনে হয় এখানে বিরোধী দল বলতে জাতীয় পার্টিকে বোঝানো হয়েছে। কারণ, বেশিরভাগ রাজনৈতিক দলের বর্জন সত্ত্বেও ২০১৪ সালের নির্বাচনে অংশ নিয়ে তারাই গণতন্ত্রকে ধ্বংস করেছে। ২০১৮ সালেও তারা সরকারের সঙ্গে সমঝোতার ভিত্তিতে নির্বাচন করেছে।
বিএনপির জন্য ভিসা নিষেধাজ্ঞা ইতিবাচক হলেও দাবি আদায়ে তাদের শান্তিপূর্ণভাবে আান্দোলন চালিয়ে যাওয়া উচিত বলে মনে করেন ড. নুরুল আমিন বেপারী।
মন্তব্য করুন