দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী তালিকা ঘোষণা করা হয়েছে। এ তালিকায় স্থান পাননি ৭১ জন বর্তমান সংসদ সদস্য। এই তালিকায় বর্তমান মন্ত্রিসভার তিনজন সদস্য, সাবেক প্রতিমন্ত্রীসহ ডজনখানেক হেভিওয়েট প্রার্থীও রয়েছেন। বাদ পড়াদের বেশিরভাগই নানাবিধ কারণে বিতর্কিত, এলাকায় অজনপ্রিয়। স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাদের সঙ্গে দূরত্বসহ নানাবিধ অভিযোগে অভিযুক্ত। গতকাল রোববার বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে প্রার্থীর নাম ঘোষণা করেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের।
বাদপড়াদের মধ্যে রয়েছেন শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী মন্নুজান সুফিয়ান (খুলনা-৩), প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেন (কুড়িগ্রাম-৪) ও এবং সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ (ময়মনসিংহ-৫)।
জানা গেছে, বয়সের ভারে ন্যুব্জ মন্নুজান শারীরিকভাবে সক্ষমতা কমে যাওয়া ছাড়াও ভাই-ভাতিজির দুর্নীতির কারণে বাদ পড়েছেন। এই আসনে মনোনয়ন পেয়েছেন আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এস এম কামাল হোসেন।
একইভাবে এলাকায় অজনপ্রিয় হয়ে গিয়েছিলেন সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী খালিদ। এ ছাড়া সংসদীয় আসনে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের সঙ্গে দূরত্ব, জামায়াত-বিএনপির সাবেক নেতাকর্মীদের দলে জায়গা দিতে ভূমিকা পালন করার কারণে মনোনয়ন বঞ্চিত হন।
মন্ত্রণালয়ের এডিপি বাস্তবায়নে অদক্ষতা ছাড়াও মন্ত্রণালয়ে অনুপস্থিতি যেন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেনের জন্য নিত্যনৈমিত্তিক বিষয়। এ ছাড়া নিজ এলাকায় মানুষের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি তার মনোনয়ন না পাওয়ার অন্যতম বড় কারণ বলে জানিয়েছেন স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতারা।
বর্তমান মন্ত্রিসভার সদস্য ছাড়াও সাবেক প্রতিমন্ত্রী মুরাদ হাসানও মনোনয়ন বঞ্চিত হয়েছেন। মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকেই বেপরোয়া হয়ে ওঠা মুরাদ বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া, তার ছেলে ও নাতনিকে নিয়ে অবমাননাকর মন্তব্য করেন। এরপর অভিনেত্রী মাহিয়া মাহিকে নিয়ে একটি ফোনকল ভাইরাল হলে তিনি ব্যাপক সমালোচিত হন এবং মন্ত্রিত্ব ছেড়ে দিতে বাধ্য হন।
এদিকে চট্টগ্রাম-১ আসনে ছেলে মাহবুব উর রহমান রুহেলকে জায়গা করে দিতে সরে দাঁড়িয়েছেন আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন। এজন্য তাকে প্রার্থী তালিকায় রাখেনি আওয়ামী লীগ। একই কারণে রংপুর-৫ আসনটি ছেলে রাশেক রহমানকে ছেড়ে দিয়েছেন এইচ এন আশিকুর রহমান। মাগুরা-১ আসনে ক্রিকেটার সাকিব আল হাসানকে জায়গা ছেড়ে দিতেই সাইফুজ্জামান শিখর মনোনয়ন বঞ্চিত হয়েছেন।
ফরিদপুর-৩ আসনে ব্যক্তিগত কর্মকর্তাদের দুর্নীতি, বিদেশে অবস্থানসহ শারীরিক অক্ষমতার কারণে বাদ পড়েছেন খন্দকার মোশাররফ হোসেন। এই আসনে মনোনয়ন পেয়েছেন শামীম হক। অন্যদিকে আরেক আত্মীয় সিরাজগঞ্জ-২ আসনের বর্তমান হাবিবে মিল্লাত স্থানীয় আওয়ামী লীগের কোন্দলের কারণে জেলা আওয়ামী লীগের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি পান। এলাকায় অজনপ্রিয় হওয়ায় এবার বাদ পড়েছেন মনোনয়ন থেকে। দলীয় মনোনয়ন পেয়েছেন জান্নাত আরা হেনরী।
সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও বর্তমান সংসদ সদস্য মহীউদ্দীন খান আলমগীরও এবার মনোনয়ন পাননি। ব্যাংক কেলেঙ্কারি নিয়ে তার নাম আলোচনায় আসে।
মানিকগঞ্জ-১ আসনের সংসদ সদস্য জাতীয় ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক নাঈমুর রহমান দুর্জয়ও দলীয় মনোনয়ন হারিয়েছেন। তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময় জমি দখলের অভিযোগ ওঠে।
হাওর দখল, দুর্নীতির জন্য সমালোচিত হন সুনামগঞ্জ-১ আসনের সংসদ সদস্য মোয়াজ্জেম হোসেন রতন। আর সুনামগঞ্জ-২ আসনের সংসদ সদস্য জয়া সেনগুপ্ত মনোনয়ন হারিয়েছেন। তিনি আওয়ামী লীগের নেতা প্রয়াত সুরঞ্জিত সেন গুপ্তের স্ত্রী। পুলিশের বর্তমান মহাপরিদর্শক চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনের ভাই চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মাহমুদ এখানে নৌকার মনোনয়ন পেয়েছেন।
সরকারি জমি দখলসহ নানা অভিযোগে বিতর্কিত হয়ে পড়েন কুমিল্লা-১ আসনের সংসদ সদস্য সুবিদ আলী ভূঁইয়া।
বর্তমান সংসদের হুইপ সামশুল হক চৌধুরী বেশ কয়েকবার বিতর্কের মুখে পড়েন।
চট্টগ্রাম-৪ আসনে গত দুবারের সংসদ সদস্য দিদারুল আলম মনোনয়ন পাননি পাহাড় কেটে ইটখোলা স্থাপনসহ বিভিন্ন অভিযোগ থাকায়।
বনের জমি দখল ও অস্ত্রধারী নিয়ে মিছিল করে সমালোচিত কক্সবাজার-১ আসনের সংসদ সদস্য জাফর আলমও মনোনয়ন পাননি।
কিশোরগঞ্জ-২ আসনে সাবেক আইজিপি নূর মোহাম্মদ তৃণমূল আওয়ামী লীগের মধ্যে বিভাজনের জন্য আওয়ামী লীগের মনোনয়ন বঞ্চিত হলেন। ওই আসনে মনোনয়ন পেয়েছেন আরেক পুলিশ কর্মকর্তা আব্দুল কাহার আকন্দ। ঢাকা-১৩ আসনের গতবারের এমপি সাদেক খান এবার মনোনয়ন পাননি। এ আসেন মনোনয়ন পেয়েছেন আওয়ামী লীগের হেভিওয়েট নেতা জাহাঙ্গীর কবির নানক।
বরিশাল-৪ থেকে মনোনয়ন বঞ্চিত হয়েছেন পঙ্কজ দেবনাথ। এখানে মনোনয়ন পেয়েছেন আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিকবিষয়ক সম্পাদক শাম্মী আহমেদ। ঢাকা-১০ থেকে বাদ পড়েছেন ব্যবসায়ী নেতা মহিউদ্দিন আহমেদ। সেখানে মনোনয়ন পেয়েছেন চিত্রনায়ক ফেরদৌস।
নারীর সঙ্গে একের পর এক অশ্লীল অডিও-ভিডিও ফাঁসের ঘটনা নিয়ে বছরজুড়ে আলোচনায় থাকা রাজশাহী-৪ আসনের সংসদ সদস্য এনামুল হক মনোনয়ন পাননি। তার স্থলে বাগমারা উপজেলার তাহেরপুর পৌর মেয়র ও পৌর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবুল কালাম আজাদ মনোনয়ন পেয়েছেন।
অন্যদিকে, নরসিংদী-৩ থেকে জহিরুল হক ভুঞা মোহনকে বাদ দিয়ে উপজেলা আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক ফজলে রাব্বি খানকে মনোনয়ন দিয়েছে আওয়ামী লীগ। শিবপুরের সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি হারুন অর রশীদ খান হত্যা মামলার এজাহারভুক্ত আসামিকে সঙ্গে নিয়ে সভা-সমাবেশ করার অভিযোগ রয়েছে মোহনের বিরুদ্ধে। এ ছাড়া এই খুনিদের সঙ্গে নিয়ে দলীয় মনোনয়ন ফরম ক্রয় করেন তিনি। এ সংবাদ গণমাধ্যমে প্রকাশ হলে জেলাজুড়ে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়।
এর আগে বাদ দেওয়াদের বিষয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘উইনেবল প্রার্থী আমরা বাদ দিইনি। যারা নির্বাচনে জিতবে, যারা ইলেক্টেবল, তাদের মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। যাদের বাদ দেওয়া হয়েছে, তারা ইলেক্টেবল নন। উইনেবল নন। জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্যতা হারিয়েছেন। জনগণের কাছে যাদের গ্রহণযোগ্য নেই, তাদের আমরা মনোনয়ন দেওয়া হয়নি।’
পঞ্চগড়-১ আসন থেকে বাদ পড়েছেন বর্তমান সংসদ সদস্য মজাহারুল হক প্রধান, ঠাকুরগাঁও-২ থেকে দবিরুল ইসলাম, কুড়িগ্রাম-৩ থেকে এম এ মতিন, গাইবান্ধা-৪ থেকে মনোয়ার হোসেন চৌধুরী।
বগুড়া-৫ আসন থেকে হাবিবর রহমান। নওগাঁ-৩ আসনে ছলিম উদ্দীন তরফদার, নওগাঁ-৪ ইমাজ উদ্দিন প্রামাণিক, রাজশাহী-৩ আয়েন উদ্দিন, রাজশাহী-৫ আসনে মো. মনসুর রহমান, সিরাজগঞ্জ-২ আসন হাবিবে মিল্লাত, সিরাজগঞ্জ-৪ তানভীর ইমাম, সিরাজগঞ্জ-৬ মেরিনা জাহান, পাবনা-৪ নুরুজ্জামান বিশ্বাস মনোনয়ন বঞ্চিত হয়েছেন।
খুলনা বিভাগ থেকে মেহেরপুর-২ আসনে মোহাম্মদ সাহিদুজ্জামান, ঝিনাইদহ-৩ আসনে শফিকুল আজম খান, যশোর-২ আসনে মো. নাসির উদ্দিন, যশোর-৪ আসনে রনজিত কুমার রায়, বাগেরহাট-৪ আসনে আমিরুল আলম মিলন, খুলনা-১ আসনে পঞ্চানন বিশ্বাস, খুলনা-৬ আসনে আক্তারুজ্জামান, সাতক্ষীরা-২ মীর মোস্তাক আহমেদ রবি, সাতক্ষীরা-৪ এস এম জগলুল হায়দার বাদ পড়েছেন।
বরিশাল বিভাগ থেকে বরগুনা-২ আসনে শওকত হাচানুর রহমান (রিমন), বরিশাল-২ আসনে মো. শাহে আলম বাদ পড়েছেন।
ঢাকা বিভাগ থেকে টাঙ্গাইল-৩ আসনে আতাউর রহমান খান, টাঙ্গাইল-৪ আসনে মোহাম্মদ হাছান ইমাম খান হাজারী, টাঙ্গাইল-৫ আসনে মো. ছানোয়ার হোসেন, টাঙ্গাইল-৮ আসনে মো. জোয়াহেরুল ইসলাম, মানিকগঞ্জ-১ আসনে এ এম নাঈমুর রহমান, ঢাকা-৫ আসনে কাজী মনিরুল ইসলাম, ঢাকা-৭ আসনে হাজী মো. সেলিম, ঢাকা-১১ আসনে এ কে এম রহমতুল্লা, ঢাকা-১৪ আসনে আগাখান মিন্টু, গাজীপুর-৩ আসনে মুহাম্মদ ইকবাল হোসেন, ফরিদপুর-১ আসনে মনজুর হোসেন মনোনয়ন পাননি।
ময়মনসিংহ বিভাগ থেকে জামালপুর-১ আসনে আবুল কালাম আজাদ, জামালপুর-৫ আসনে মো. মোজাফফর হোসেন, শেরপুর-৩ আসনে এ কে এম ফজলুল হক, ময়মনসিংহ-৩ আসনে নাজিম উদ্দিন আহমেদ, ময়মনসিংহ-৯ আসনে আনোয়ারুল আবেদীন খান, নেত্রকোনা-১ আসনে মানু মুজুমদার, নেত্রকোনা-৫ আসনে ওয়ারেসাত হোসেন বেলাল বাদ পড়েছেন।
সিলেট বিভাগ থেকে সুনামগঞ্জ-১ আসনে মোয়াজ্জেম হোসেন রতন, সুনামগঞ্জ-২ আসনে জয়া সেন গুপ্তা, সিলেট-৫ আসনে হাফিজ আহমদ মজুমদার, মৌলভীবাজার-৩ আসনে নেছার আহমদ, হবিগঞ্জ-১ আসনে গাজী মোহাম্মদ শাহনওয়াজ, হবিগঞ্জ-২ আসনে মো. আব্দুল মজিদ খান মনোনয়ন পাননি।
চট্টগ্রাম বিভাগ থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৫ আসনে মোহাম্মদ এবাদুল করিম, কুমিল্লা-১ আসনে মোহাম্মদ সুবিদ আলী ভূঁইয়া, কুমিল্লা-৮ আসনে নাছিমুল আলম চৌধুরী, চাঁদপুর-১ আসনে মহীউদ্দিন খান আলমগীর, চাঁদপুর-২ আসনে মো. নুরুল আমিন, নোয়াখালী-৬ আসনে আয়েশা ফেরদাউস, চট্টগ্রাম-৪ আসনে দিদারুল আলম, চট্টগ্রাম-১২ আসনে সামশুল হক চৌধুরী, কক্সবাজার-১ আসনে জাফর আলম মনোনয়ন হারিয়েছেন।
সম্পাদনা: রাসেল