দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন পেয়েছেন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদ ও উপদেষ্টা পরিষদের ৪১ নেতা। দলীয় প্রতীক নৌকা নিয়ে নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন তারা। তাদের মধ্যে অন্তত ১৪ জন তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখে পড়ছেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দলীয় রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ এই নেতাদের ভোটের মাঠে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছেন আওয়ামী লীগের মনোনয়নবঞ্চিত ‘স্বতন্ত্র’ প্রার্থীরা। কোনো কোনো আসনে অন্য দলের হেভিওয়েট প্রার্থী থাকার কারণেও জয়ের নিশ্চয়তা পাচ্ছেন না নৌকার প্রার্থীরা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিএনপিসহ বেশ কিছু দল অংশ না নিলেও এবারের নির্বাচন সুষ্ঠু ও অবাধ করতে চায় আওয়ামী লীগ। বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একটি সুন্দর নির্বাচন আয়োজনে বদ্ধপরিকর। এই নির্বাচনে সর্বোচ্চসংখ্যক ভোটারের উপস্থিতি নিশ্চিত করার বিষয়েও তাগিদ দেওয়া হয়েছে। এ কারণেই দলীয় নেতাদের মধ্যে যারা স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন, তাদের বিষয়ে কোনো হস্তক্ষেপ করা হয়নি। মূলত গুরুত্বপূর্ণ ও জনপ্রিয় নেতাদের অনেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার কারণেই উল্লেখযোগ্যসংখ্যক আসনে নির্বাচন তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ও জমজমাট হবে।
৭ জানুয়ারির নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সভাপতি, সাধারণ সম্পাদকের আসনসহ সব আসনেই রয়েছে একাধিক প্রতিযোগী। তবে কিছু কিছু আসনে হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের আভাস মিললেও অনেক আসনে তেমন শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী নেই। ফলে সেসব আসনে নির্বাচনের আনুষ্ঠানিকতা থাকলেও খুব বেশি প্রতিদ্বন্দ্বিতা না হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আব্দুর রহমান কালবেলাকে বলেন, ‘নির্বাচনী পরিবেশ এখন পর্যন্ত খুবই ভালো। প্রার্থী সংখ্যার আধিক্য থাকবেই, এটাই নির্বাচনের সৌন্দর্য। নির্বাচন করে জনপ্রিয়তা যাচাই করেই জিততে হবে প্রার্থীদের।’
এবারের নির্বাচনে প্রাথমিকভাবে ২৯৮টি আসনে দলীয় প্রার্থী তালিকা ঘোষণা করেছিল আওয়ামী লীগ। তবে নির্বাচনী সমঝোতার মধ্যে দিয়ে ১৪ দলের শরিকদের ৬টি ও জাতীয় পার্টিকে ২৬ আসনে ছাড় দিয়েছে ক্ষমতাসীনরা। এ ছাড়া তিনটি আসনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী যাচাই-বাছাইয়ে বাদ পড়েছেন। সব মিলিয়ে শেষ পর্যন্ত দলীয় প্রতীক নৌকা নিয়ে নির্বাচন করছেন ২৬৬ জন। এর মধ্যে আছেন কেন্দ্রীয় কমিটি ও উপদেষ্টা পরিষদের ৪১ নেতা। প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী ও সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় তাদের অনেকেই সহজে পার পেয়ে যাবেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। তবে দলের স্বতন্ত্র এবং অন্য দলের শক্তিশালী প্রার্থী থাকায় অন্তত ১৪ জন কেন্দ্রীয় নেতা তীব্র চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে যাচ্ছেন বলে সারা দেখে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে।
গত দুই নির্বাচনের মতো ফরিদপুর-৪ আসনে আবারও মুখোমুখি হয়েছেন আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজী জাফর উল্লাহ এবং যুবলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য মজিবুর রহমান চৌধুরী নিক্সন। নানা কারণে এই দুজনের দ্বৈরথ ফরিদপুরসহ সারা দেশেই আলোচিত। গত দুই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির কো-চেয়ারম্যান কাজী জাফর উল্লাহ স্বতন্ত্র প্রার্থী নিক্সনের কাছে হেরেছেন। এবারও এই দুজনের মধ্যে তীব্র লড়াই হবে বলে মনে করছেন ওই এলাকার ভোটার ও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা।
নানাবিধ কারণে নিজ এলাকায় আলোচিত মাদারীপুর-৩ আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক আবদুস সোবহান গোলাপ। এবার তার বিরুদ্ধে লড়ছেন কালকিনি উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সংরক্ষিত নারী আসনের সংসদ সদস্য তাহমিনা বেগম। এই আসনে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হবে নৌকা ও ঈগল প্রতীকের প্রার্থীর মধ্যে। তাদের মুখোমুখি লড়াই এরই মধ্যে নির্বাচনী এলাকায় উত্তাপও ছড়িয়েছে।
রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, আওয়ামী লীগের কার্যালয় তাহমিনার সমর্থকরা দখলে রেখেছেন এমন অভিযোগ করেছেন আবদুস সোবহান গোলাপ। তবে কার্যালয়ে প্রবেশের বিষয়ে হস্তক্ষেপ কামনা করে দেওয়া সেই আবেদন খারিজ করে দিয়েছে নির্বাচন কমিশন।
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল-আলম হানিফ কুষ্টিয়া-৩ আসনে নির্বাচন করছেন। তবে তাকে এবার চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী কুষ্টিয়া পৌরসভার মেয়র আনোয়ার আলীর ছেলে পারভেজ আনোয়ার তনু। জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আনোয়ার আলী কুষ্টিয়া পৌরসভার পাঁচবারের নির্বাচিত মেয়র। ১৯৯১ ও ১৯৯৬ সালের সংসদ নির্বাচনে এ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়ে সামান্য ভোটে আনোয়ার আলী পরাজিত হন।
দলের আরেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক শিক্ষামন্ত্রী দীপু মণিকে অগ্নিপরীক্ষা দিতে হতে পারে চাঁদপুর-৩ আসনে। এই আসনে মোট ৭ জন প্রার্থী থাকলেও দীপু মনির শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী স্বতন্ত্র প্রার্থী মোহাম্মদ সামছুল হক ভূঁইয়া। তিনি চাঁদপুর-৪ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য। এবার সেখানে দলীয় মনোনয়ন না পেয়ে পাশের আসনে দীপু মনির বিপক্ষে দাঁড়িয়েছেন তিনি।
ফরিদপুর-১ আসনে নৌকা প্রতীকের প্রার্থী আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও সাবেক সংসদ সদস্য আব্দুর রহমানকে কঠিন পরীক্ষায় ফেলতে পারেন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের (বিএনএম) ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান শাহ্ মোহাম্মদ আবু জাফর। তিনিও এই আসনের সাবেক এমপি। এই নির্বাচনে দলীয় নোঙ্গর প্রতীকে নির্বাচন করছেন প্রবীণ এই নেতা। এ ছাড়া আওয়ামী লীগের মনোনয়ন না পেয়ে স্বতন্ত্র হওয়া আরিফুর রহমানও এখানে শক্ত প্রার্থী।
চাঁদপুর-২ আসন থেকে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া। তার সঙ্গে স্বতন্ত্র প্রার্থী আন্তর্জাতিক উপকমিটির সদস্য এম ইসফাক আহসানের প্রতিদ্বন্দ্বিতা হতে পারে। মায়া চৌধুরীর রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের সমর্থন নিয়ে ফ্যাক্টর হয়ে উঠতে পারেন এই স্বতন্ত্র প্রার্থী।
দলের আরেক সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কামরুল ইসলামকেও ঢাকা-২ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হাবিবুর রহমানের সঙ্গে লড়াই করতে হবে। এখানেই কামরুল বিরোধীদের ভোট নির্বাচনী হিসাবনিকাশ পাল্টে দিতে পারেন।
দলের সাংগঠনিক সম্পাদক শফিউল আলম চৌধুরী নাদেল আওয়ামী লীগের প্রার্থী হয়েছেন মৌলভীবাজার-২ আসনে। এখানে তৃণমূল বিএনপির প্রার্থী হয়েছেন সাবেক সংসদ সদস্য এম এম শাহীন। ২০০১ সালের জাতীয় নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েও সংসদ সদস্য হয়েছিলেন তিনি। ফলে এই আসনে শাহীন সব সময়ই শক্ত প্রার্থী। এ ছাড়া কুলাউড়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান পদ থেকে ত্যাগ করে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন এ কে এম সফি আহমদ সলমান। এলাকায় তার অবস্থানও বেশ শক্ত। ফলে এই আসনে ত্রিমুখী লড়াই জমে উঠতে পারে।
আওয়ামী লীগের মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক সম্পাদক মৃণাল কান্তি দাস নৌকার প্রার্থী হয়েছেন মুন্সীগঞ্জ-৩ আসনে। তাকে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছেন মুন্সীগঞ্জ পৌরসভার মেয়র পদ ত্যাগ করে স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়া মোহাম্মদ ফয়সাল বিপ্লব। দুই প্রার্থীর দ্বৈরথ এরই মধ্যে জমে উঠেছে। দুজনের সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষে কয়েকজন আহতও হয়েছেন।
নেত্রকোনা-৩ আসনে আওয়ামী লীগের সাংস্কৃতিক সম্পাদক অসীম কুমার উকিল মনোনয়ন পেয়েছেন। তার বিরুদ্ধে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন এ আসনের সাবেক দুই সংসদ সদস্য ইফতিখার উদ্দিন তালুকদার পিন্টু ও মঞ্জুর কাদের কোরাইশী। ফলে এই কেন্দ্রীয় নেতাকে নির্বাচনে কঠিন পরীক্ষায় অবতীর্ণ হতে হচ্ছে।
সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্যদের মধ্যে তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক সেলিম মাহমুদ, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সম্পাদক আবদুস সবুর, যুব ও ক্রীড়া সম্পাদক মাশরাফী বিন মোর্ত্তজার আসনে তেমন প্রতিদ্বন্দ্বিতার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে।
ঢাকা-৪ আসনে আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সংসদের সদস্য সানজিদা খানমকে জাতীয় পার্টির প্রার্থী সৈয়দ আবু হোসেন বাবলার মুখোমুখি হতে হচ্ছে। লাঙ্গল প্রতীকের বর্তমান এমপি বাবলার সঙ্গে কঠিন প্রতিদ্বন্দ্বিতা হতে পারে সানজিদার।
অন্যদিকে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের ৪৪ সদস্যের মধ্যে নৌকা প্রতীকে নির্বাচন করছেন আমির হোসেন আমু, তোফায়েল আহমেদ, রাজিউদ্দিন আহম্মেদ রাজু, রমেশ চন্দ্র সেন, নুরুল ইসলাম নাহিদ, ডা. আ ফ ম রুহুল হক ও সালমান ফজলুর রহমান। তাদের মধ্যে রাজিউদ্দিন আহম্মেদ রাজু, নুরুল ইসলাম নাহিদ ও সালমান ফজলুর রহমান তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখে পড়তে পারেন।
নরসিংদী-৫ আসনে সংসদ সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী রাজিউদ্দিন আহমেদ রাজুর বিরুদ্ধে স্বতন্ত্র প্রার্থী উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান চৌধুরী। নানা কারণে আলোচিত-সমালোচিত বর্ষীয়ান রাজনীতিক রাজুকে এবার কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হতে পারে বলে ধারণা করছেন ওই এলাকার মানুষ।
দোহার ও নবাবগঞ্জ নিয়ে গঠিত ঢাকা-১ আসনে ফের ভোটযুদ্ধে মুখোমুখি আওয়ামী লীগের সালমান ফজলুর রহমান ও জাতীয় পার্টির কো-চেয়ারম্যান সালমা ইসলাম। এই আসনে সেয়ানে সেয়ানে লড়াইয়ের আভাস পাওয়া যাচ্ছে।
সিলেট-৬ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী বর্তমান সংসদ সদস্য নুরুল ইসলাম নাহিদ। এই আসনে প্রার্থী হয়েছেন তৃণমূল বিএনপির চেয়ারম্যান শমসের মবিন চৌধুরী। সোনালী আঁশ প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করছেন তিনি। রাজনীতির নানা হিসাবনিকাশে এবার নুরুল ইসলাম নাহিদকে কঠিন পরীক্ষার মুখে পড়তে হচ্ছে বলে ধারণা করছেন এলাকাবাসী।
এদিকে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা এবারও নৌকা প্রতীক নিয়ে নিজ এলাকা গোপালগঞ্জ-৩ আসনে নির্বাচন করছেন। এখানে বরাবরই রেকর্ড ভোটের ব্যবধানে জয়ী হন তিনি।
দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের নোয়াখালী-৫ আসনে নৌকার প্রার্থী হয়ে ফের লড়ছেন। তার বিরুদ্ধেও শক্তিশালী কোনো প্রার্থী নেই।
সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য বেগম মতিয়া চৌধুরী, শেখ ফজলুল করিম সেলিম, আব্দুর রাজ্জাক, ফারুক খান, শাজাহান খান, জাহাঙ্গীর কবির নানক ও সিমিন হোসেন রিমির আসনে তেমন কোনো শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী নেই। যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ এবং আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিমসহ সাংগঠনিক সম্পাদক আহমদ হোসেন, আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন, এস এম কামাল হোসেন, মির্জা আজমের আসনেই নেই প্রতিদ্বন্দ্বিতার সম্ভাবনা।
এ ছাড়া কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যদের মধ্য আবুল হাসনাত আবদুল্লাহ, দীপঙ্কর তালুকদার, মোহাম্মদ আলী আরাফাত, ইকবাল হোসেন অপু ও মোহাম্মদ সাঈদ খোকনের নির্বাচনী বৈতরণী পাড় হওয়া কঠিন হবে না বলে ধারণা করা হচ্ছে।