হাসান আজাদ
প্রকাশ : ০৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০৩:৩৪ এএম
আপডেট : ০৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০৭:৪৫ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

গ্যাস সংকটে তছনছ ছয় খাত

বন্ধ হয়ে যাচ্ছে অনেক সিএনজি স্টেশন
গ্যাস সংকটে তছনছ ছয় খাত

গ্যাস সংকটের কারণে দেশের ছয়টি খাতে মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। গত মাসের তুলনায় চলতি মাসে সরবরাহ কিছুটা বাড়লেও সার্বিক সংকটের উল্লেখযোগ্য কোনো উন্নতি হয়নি। বিশেষ করে সরাসরি উৎপাদন ও অর্থনীতির সঙ্গে জড়িত ভারী শিল্প, বস্ত্র, তৈরি পোশাক, সার, বিদ্যুৎ ও পরিবহনের সিএনজি খাতে গ্যাস সরবরাহে বড় রকমের ঘাটতি রয়েই গেছে। তার ওপর গ্যাসের চাপ (প্রেশার) কম থাকায় উৎপাদন ক্ষমতার অর্ধেকও কাজে লাগাতে পারছে না শিল্পকারখানাগুলো। এর প্রভাবে রপ্তানিমুখী পোশাক খাতে আদেশ বাতিল হচ্ছে। পূর্ণ উৎপাদন করতে না পারলেও কারখানা চালু রাখায় কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মজুরি ও অন্যান্য ব্যয় অব্যাহত থাকছে। এর ফলে ব্যাপক লোকসানের মুখে পড়তে হচ্ছে। এ কারণে অনেকেই কারখানা বন্ধ করে দেওয়ার চিন্তা করছেন বলে উদ্যোক্তারা জানিয়েছেন।

এদিকে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, এই গ্যাস সংকট শিগগির সমাধান হচ্ছে না। ডলার সংকটের কারণে চাহিদার বিপরীতে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানি করা যাচ্ছে না। পাশাপাশি দেশীয় গ্যাসক্ষেত্রে উৎপাদন বাড়ানোর পরিকল্পনা করা হলেও এর পরিপূর্ণ ফল পেতে আরও দুই থেকে আড়াই বছর লাগবে। ফলে এ বছর তো বটেই, আগামী দুই বছর গ্যাস সংকট অব্যাহত থাকবে। তবে গ্যাস সরবরাহের ক্ষেত্রে রেশনিং করে সরকার পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করছে।

বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেছেন, ‘দেশে গ্যাসের সরবরাহ স্বাভাবিক করাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। সরবরাহ স্বাভাবিক করতে আরও বছর দুয়েক সময় লাগবে। ২০২৬ সালের মধ্যে দেশে নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহে কাজ চলছে।’

চলমান গ্যাস সংকটের কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ‘এলএনজি টার্মিনালের মধ্যে একটি বন্ধ থাকায় এই সংকট প্রকট হয়েছে। আমদানির ক্ষেত্রে ডলার সংকটও রয়েছে। এ ছাড়া দেশি গ্যাসক্ষেত্রগুলোর উৎপাদন কমে এসেছে। তবে আমরা চেষ্টা করছি দেশীয় উৎপাদন বাড়াতে।’

পেট্রোবাংলা সূত্রে জানা গেছে, সারা বছরজুড়েই গ্যাসের সংকট অব্যাহত থাকবে। তবে এখনকার মতো তীব্র হবে না। রেশনিং করে এই সংকট মোকাবিলার চিন্তা করা হচ্ছে। বর্তমানে দেশে গ্যাসের চাহিদা রয়েছে প্রায় ৪ হাজার ৩০০ মিলিয়ন ঘনফুট। এর বিপরীতে গড়ে সরবরাহ করা হচ্ছে ২ হাজার ৭০২ মিলিয়ন ঘনফুট। এর মধ্যে ৬৪৪ মিলিয়ন ঘনফুট পাওয়া যাচ্ছে আমদানি করা এলএনজি থেকে। এই হিসাবে ঘাটতি থাকছে প্রায় দেড় হাজার মিলিয়ন ঘনফুট। মার্চে দুটি এলএনজি টার্মিনাল চালু হলে আরও ৫০০ মিলিয়ন ঘনফুট সরবরাহে যোগ হবে। তারপরও ঘাটতি থাকবে ১ হাজার মিলিয়ন ঘনফুট।

শিল্প উদ্যোক্তারা জানান, ঢাকাসহ সারা দেশেই শিল্পে গ্যাস সরবরাহ পরিস্থিতি খুবই খারাপ। এর মধ্যে নারায়ণগঞ্জ ও ফতুল্লায় গ্যাসের সরবরাহ পরিস্থিতি খুবই নাজুক। এর পরই রয়েছে রূপগঞ্জ ও আড়াইহাজার এলাকা। গাজীপুর, সাভার ও শ্রীপুর অঞ্চলের অবস্থাও একই। এসব এলাকার শতাধিক পোশাক কারখানার উৎপাদন ৮০ শতাংশ কমে গেছে। বিশেষ করে যেসব কারখানায় ক্যাপটিভ পাওয়ার ও গ্যাস বয়লার চালানো হয়, তাদের অবস্থা খুবই খারাপ। কারণ, ক্যাপটিভ পাওয়ার গ্যাস ছাড়া তেল দিয়ে চালালে ব্যয় বেড়ে যায় কয়েক গুণ। এতে বড় অঙ্কের লোকসান গুনতে হয়। আর গ্যাস বয়লার তেল দিয়ে চালানো যায় না। ফলে উৎপাদন থেমে থাকে।

বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম এ বিষয়ে কালবেলাকে বলেন, ‘সরকারকে আর গ্যাস সংকটের কথা বলব না। বলতে বলতে আমরা হয়রান। নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস দেওয়ার কথা বলে দাম বাড়ানো হয়েছিল। এখন বাড়তি দামেও গ্যাস দিতে পারছে না। গ্যাস না পাওয়ার কারণে অর্ধেকে নেমে এসেছে উৎপাদন। শিপমেন্ট শিডিউল ফেইল করার কারণে ক্রেতারা ত্যক্ত-বিরক্ত হয়ে অর্ডার বাতিলের হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। আমরা অসহায়।’

বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশন (বিটিএমএ) সভাপতি মোহাম্মদ আলী খোকন কালবেলাকে বলেন, ‘ঢাকার আশপাশের শিল্প এলাকাগুলোতে ভয়াবহ গ্যাস সংকট চলছে। আমরা দিনের বেলায় গ্যাসের প্রেশার পাই না। দেওয়ার কথা ১৫ পিএসআই (পাউন্ড পার স্কয়ার ইঞ্চি)। দিচ্ছে ১ থেকে ২ পিএসআই। ৫০ শতাংশের বেশি উৎপাদন কমেছে এই খাতে। এই খাত থেকে বছরে ২৮ বিলিয়ন ডলারের কাপড় রপ্তানি হয়। সব মিলিয়ে বছরে প্রায় ৮০০ কোটি মিটার কাপড় উৎপাদন করি। কিন্তু চলতি বছর এর অর্ধেক উৎপাদন করা যাবে কি না, তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘ক্যাপটিভ পাওয়ার, বয়লার মেশিনসহ আমাদের উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত সব কিছুই গ্যাসে চলে। এখানে বিকল্প জ্বালানি ব্যবহারের সুযোগ কম। শুধু গার্মেন্ট খাতে সুইং মেশিন বিদ্যুতে চলে। গ্যাস সংকটের কারণে আমাদের টেক্সটাইল খাত ধীরে ধীরে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। আমরা বিদেশি বায়ার (ক্রেতা) হারাচ্ছি। এসব বায়ার অন্য দেশে চলে যাচ্ছে। কারণ, আমি অর্ডার নিয়ে সময়মতো সরবরাহ করতে পারছি না।’

একই অবস্থা বিরাজ করছে পরিবহন খাতে। বর্তমানে দেশে সিএনজিচালিত যানবাহনের সংখ্যা কমবেশি ১০ লাখের মতো। আর সিএনজি স্টেশনের সংখ্যা ৫০০টি। বিআরটিএর হিসাব অনুযায়ী, ঢাকার ভেতরে মোট বাস ১২ হাজার ৫২৬টি। তার মধ্যে গ্যাসে চলে ১১ হাজার ৯০০টি। ঢাকা থেকে দূরপাল্লার বাস মোট ১৬ হাজার। তার মধ্যে গ্যাসে চলে ১১ হাজার ২০০। সারা দেশে মোট বাস ৭৮ হাজার। তার মধ্যে গ্যাসে চলে ৪৬ হাজার ৮০০টি। এ ছাড়া রয়েছে সিএনজিচালিত ব্যক্তিগত গাড়ি, অটোরিকশা।

সিএনজি ব্যবসায়ীরা জানান, গ্যাস সংকটের কারণে গাড়িতে সিএনজি দেওয়া যাচ্ছে না। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ২০ ঘণ্টাই গ্যাসের চাপ থাকে না। যখন থাকে ১ বা ২ পিএসআইর বেশি হয় না। ফলে প্রতিটি স্টেশনে গ্যাস নেওয়ার জন্য দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করতে হচ্ছে। এতে অনেকেই বিরক্ত হয়ে গাড়িতে সিএনজির পরিবর্তে এলপিজি গ্যাস ব্যবহার করছেন।

গ্যাস না পাওয়ার কারণে সাভারের ডেল্টা সিএনজিসহ বেশ কয়েকটি স্টেশন বন্ধ হয়ে গেছে বলে ব্যবসায়ীরা জানান। সব মিলিয়ে সিএনজি খাতে ব্যবসা কমেছে ৫০ শতাংশের বেশি।

সিএনজি ফিলিং স্টেশন ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব ফারহান নূর এ প্রসঙ্গে কালবেলাকে বলেন, ‘আমরা সিএনজি খাতে বিনিয়োগ করে এখন প্রচণ্ড রকমের সমস্যায় আছি। গ্যাস না থাকায় ব্যবসা করতে পারছি না। আর যতটুকু পাই, তাতে প্রেশার থাকে না। এ নিয়ে অনেকবার সরকারের কাছে ধরনা দিয়েছি। লাভ হয়নি।’

তিনি বলেন, ‘এই খাতের ব্যবসায়ীদের অনেকেই বিনিয়োগ করেছেন ব্যাংক ঋণ নিয়ে। ব্যবসা না থাকায় ঋণ পরিশোধ করতে পারছেন না।’

গ্যাসের অভাবে সার ও বিদ্যুৎ খাতেও উৎপাদন মারাত্মক ব্যাহত হচ্ছে। শীতের মধ্যেও ঢাকাসহ সারা দেশেই লোডশেডিং হচ্ছে। গ্যাসের অভাবে কম খরচের বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যাচ্ছে না। ফলে বেশি খরচে বিদ্যুৎ উৎপাদন করায় লোকসান বাড়ছে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি)।

সংশ্লিষ্টরা জানান, গরম পড়ার সঙ্গে সঙ্গে দেশে লোডশেডিং বাড়বে। তবে সামনে বোরো মৌসুমে যাতে সারের কোনো সংকট না হয়, সেজন্য শিল্পে গ্যাস কমিয়ে সার কারখানায় সরবরাহ বাড়ানো হয়েছে।

পিডিবির হিসাব অনুযায়ী, বিদ্যুৎ উৎপাদনে বর্তমানে গ্যাসের চাহিদা ২ হাজার ৩১৬ মিলিয়ন ঘনফুট। এর বিপরীতে গতকাল বৃহস্পতিবার সরবরাহ করা হয়েছে ৮৫৫ মিলিয়ন ঘনফুট। আর সার উৎপাদনে চাহিদা ৩২৯ মিলিয়ন ঘনফুটের বিপরীতে গতকাল সরবরাহ করা হয়েছে ২০৭ মিলিয়ন ঘনফুট।

প্রাপ্ত তথ্যমতে, গ্যাস সংকটের কারণে গতকালও প্রায় ৮ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যায়নি। পাশাপাশি গ্যাসের অভাবে জ্বালানি তেলনির্ভর বিদ্যুৎকেন্দ্রের ওপর নির্ভরতা বেড়ে যাওয়ায় পিডিবির লোকসান বাড়ছে।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

মুদি দোকানে মিলল টিসিবির ১৪৪২ লিটার তেল 

বিমানে যাত্রীদের সঙ্গে উঠে গেল সাপ, অতঃপর...

সংসদ নির্বাচনে ৪৮ লাখ ডলার দিচ্ছে জাপান

১২ কেজি এলপিজির দাম কমলো 

গৃহবধূকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণ, শ্রমিক দল-ছাত্রদলের ৩ নেতা বহিষ্কার

নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতায় বিপিসির উদ্বেগ 

ঢাবির মধুর ক্যান্টিনে ‘মুক্তির পাঠাগার’ স্থাপন করল ছাত্রদল নেতা

চলে গেলেন জীনাত রেহানা

জুলাই গণঅভ্যুত্থানে শহীদদের স্মরণে যুক্তরাষ্ট্রে দোয়া মাহফিল 

পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে ইরানের বড় ঘোষণা

১০

ডিম বাছাইকে কেন্দ্র করে দোকানিকে ছুরিকাঘাত

১১

কাজাখস্তানে প্রকাশ্যে মুখ ঢেকে রাখা নিষিদ্ধ ঘোষণা

১২

তেজগাঁও থেকে ছিনিয়ে নেওয়া রিয়াল উদ্ধার, আটক ৬

১৩

মাইক্রোবাস-ট্রাকের সংঘর্ষে নিহত ২

১৪

আরেক আ.লীগ নেতার কারাদণ্ড

১৫

বাবার মরদেহ নিতে অস্বীকৃতি জানালেন ছেলে

১৬

মোসাদের সঙ্গে আফগানদের কাজ করার অভিযোগ, কঠোর ইরান

১৭

শহীদ পরিবারের হাতে ‘প্রজন্ম ২৪’ নিউজ পোর্টালের উদ্বোধন

১৮

ইরানে ১৮ আফগান অভিবাসী আটক

১৯

ইরানের নতুন যুদ্ধ কমান্ডারের নাম জেনে গেছে মোসাদ

২০
X