দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচন ঘিরে তৃণমূলে তৈরি হওয়া বিভক্তি দূর করতে সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড জোরদার করতে যাচ্ছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। দলীয় ও স্বতন্ত্র প্রার্থীদের কেন্দ্র করে বিভক্ত নেতাকর্মীদের ঐক্যবদ্ধ করে দলীয় শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে চায় দলটি। সেই লক্ষ্যে তৃণমূলে সংগঠন ঢেলে সাজানোর চিন্তা করা হচ্ছে। উপজেলা নির্বাচনের পর ক্ষমতাসীনরা এ নিয়ে পুরোদমে মাঠে নামবেন বলে জানা গেছে।
আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী কেন্দ্রীয় সম্মেলন নিয়মিত হলেও তৃণমূলে চলছে ব্যতিক্রম। অনেক জেলা ও উপজেলা শাখার সম্মেলনই সময়মতো অনুষ্ঠিত হয় না। আবার সম্মেলন হলেও সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের দ্বন্দ্বে বছর পেরিয়ে গেলেও অনেক শাখার পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠিত হয় না অনেক জেলায়। এ নিয়ে তৃণমূলের নেতাকর্মীদের মধ্যে পুঞ্জীভূত হচ্ছে ক্ষোভ।
জানা গেছে, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন কেন্দ্র করে সারা দেশে জেলা-উপজেলা শাখার সম্মেলন ও পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা বন্ধ রাখে ক্ষমতাসীন দলটি। দ্বাদশ নির্বাচনে নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জনের পর আবারও সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডে গতি সঞ্চারে উদ্যোগ নিয়েছে দেশের প্রাচীনতম দলটি।
এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘দলীয় সভাপতি মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটি নতুন করে গঠন এবং অভ্যন্তরীণ বিরোধ মেটাতে বিভাগীয় দায়িত্বপ্রাপ্তদের নির্দেশ দিয়েছেন। মেয়াদোত্তীর্ণ বিভিন্ন শাখার সম্মেলন, সহযোগী সংগঠনের প্রতিটির অসমাপ্ত সম্মেলন, কমিটি গঠন প্রক্রিয়ায় বিলম্বসহ সাংগঠনিক সমস্যার সমাধান করা জরুরি। বিভাগীয় দায়িত্বপ্রাপ্তরা সব শাখাকে ঢাকায় ডেকে বসতে পারেন। সমস্যা ও বিরোধ থাকলে তা সমাধানে অনতিবিলম্বে কাজ শুরু করতে নির্দেশ দিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি।’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দলের বিভিন্ন পর্যায়ের পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন, দলের কাছে জমা বিভিন্ন শাখা কমিটির অনুমোদন দেওয়া, মেয়াদোত্তীর্ণ বিভিন্ন শাখার সম্মেলন, সহযোগী সংগঠনের নতুন সম্মেলনের প্রস্তুতি, তৃণমূলে বিভিন্ন সাংগঠনিক সমস্যা ও বিরোধ সমাধানে নির্দেশ দিয়েছেন দলের নীতিনির্ধারকরা। কারণ হিসেবে নেতারা জানান, সম্মেলন হলেও অনেক জেলা, মহানগর, উপজেলা, থানা ও পৌর শাখা চলছে মূলত দুই নেতার কাঁধে ভর করে। পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠনে দীর্ঘসূত্রতা দূর করতে ২২তম জাতীয় সম্মেলনে ৪৫ দিনের নির্দিষ্ট সময়সীমা বেঁধে দিয়ে গঠনতন্ত্র সংশোধন করা হলেও বেশিরভাগ শাখার দায়িত্বপ্রাপ্তরা তা মানছে না।
সংশ্লিষ্টরা জানান, দেশের আট বিভাগে আওয়ামী লীগের ৭৮টি সাংগঠনিক জেলা রয়েছে। অন্যদিকে উপজেলা, থানা ও পৌর কমিটির সংখ্যা সাড়ে ৬০০-র মতো। তিন বছর পরপর সম্মেলনের মাধ্যমে এসব শাখায় কমিটি গঠন করার কথা। তবে বেশিরভাগ শাখাই নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সম্মেলন করে না।
জানা গেছে, আওয়ামী লীগের জেলা কমিটির মধ্যে এরই মধ্যে মেয়াদ শেষ হয়েছে ঠাকুরগাঁও, নীলফামারী, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, বগুড়া, রাজশাহী জেলা ও মহানগর, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, যশোর, সাতক্ষীরা, নড়াইল, কুষ্টিয়া, খুলনা জেলা ও মহানগর, বাগেরহাট, ঝালকাঠি, পটুয়াখালী, বরিশাল জেলা, বরিশাল মহানগর, শরীয়তপুর, নারায়ণগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ, মুন্সীগঞ্জ, মাদারীপুর ও গোপালগঞ্জ, সিলেট জেলা ও মহানগর, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, কুমিল্লা জেলা উত্তর, ফেনী, চাঁদপুর, চট্টগ্রাম উত্তর, খাগড়াছড়ি, বান্দরবানসহ ৩৭ জেলার। এসব শাখার সম্মেলনের পর তিন বছরের বেশি সময় পার হয়েছে গেছে। এর মধ্য নারায়ণগঞ্জ মহানগর শাখার সম্মেলন ২০০৩ সালের পর অনুষ্ঠিত হয়নি। সর্বশেষ ২০১৩ সালে সম্মেলন ছাড়াই কমিটি দেওয়া হয়। বরিশাল জেলা শাখার সম্মেলন ২০১২ সালের পর আর অনুষ্ঠিত হয়নি। শরীয়তপুর, চাঁদপুর ও কিশোরগঞ্জে ২০১৬ এবং মৌলভীবাজারে ২০১৭ সালের পর কোনো সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়নি। একই অবস্থা মাদারীপুর ও গোপালগঞ্জেও।
অন্যদিকে সম্মেলন হলেও পূর্ণাঙ্গ কমিটি হয়নি নীলফামারী, জয়পুরহাট, নওগাঁ, চুয়াডাঙ্গা, গাজীপুর মহানগর, মুন্সীগঞ্জ, শেরপুর, সুনামগঞ্জসহ আরও কয়েকটি জেলায়।
এ ছাড়া কেন্দ্রে জমা দেওয়া হলেও লক্ষ্মীপুর, কক্সবাজার, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও বরগুনা জেলা কমিটি এখনো অনুমোদন দেওয়া হয়নি।
জানা গেছে, ২০২২ সালের রংপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হোসনে আরা লুৎফার ভরাডুবির চার দিন পর রংপুর জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগের কমিটি বিলুপ্ত ঘোষণা করে দুই সদস্যবিশিষ্ট জেলা ও মহানগরের নতুন আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হয়। এখন পর্যন্ত রংপুর দুই শাখার সম্মেলন করতে পারেনি আহ্বায়ক কমিটি।
অন্যদিকে নারায়ণগঞ্জ জেলা শাখার সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের দ্বন্দ্বের কারণে কেন্দ্রে পাল্টাপাল্টি কমিটি জমা দেওয়া হয়েছে। যার সুরাহা এখন পর্যন্ত হয়নি। বরং দলীয় কার্যালয় দখল নিয়ে চলছে উত্তেজনা।
সার্বিক বিষয়ে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক কালবেলাকে বলেন, ‘দলের সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দলকে ঢেলে সাজাতে সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড বৃদ্ধি করতে বলেছেন। এই লক্ষ্যে মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটির সম্মেলন, শাখার পূর্ণাঙ্গ কমিটির অনুমোদনসহ জেলা-উপজেলার দ্বন্দ্ব নিরসনের কাজ করতে নির্দেশনা দিয়েছেন। সে অনুযায়ী দলীয় কার্যক্রম শুরু হয়েছে, যা আরও বেগবান হবে।’