সোমবার, ২৫ আগস্ট ২০২৫, ১০ ভাদ্র ১৪৩২
বিশেষ প্রতিনিধি
প্রকাশ : ০২ মার্চ ২০২৪, ০৩:৪৭ এএম
আপডেট : ০২ মার্চ ২০২৪, ০৯:১৬ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

মানুষ পোড়ে মামলা জমে, বিচার শেষের দেখা নেই

নবাব কাটরা থেকে গ্রিন কোজি কটেজ
মানুষ পোড়ে মামলা জমে, বিচার শেষের দেখা নেই

পুরান ঢাকার নিমতলীর ৪৩, নবাব কাটরা। ২০১০ সালের ৩ জুন পাঁচতলা এই ভবনের নিচতলায় আগুন লেগে তা মুহূর্তেই ছড়িয়ে পড়ে আশপাশের ভবনগুলোয়। ওই আগুনে প্রাণ হারায় ১২৪ জন মানুষ। ১৪ বছর আগের ভয়াবহ সেই আগুনে পুড়ে যাওয়া ভবনগুলোর ক্ষতচিহ্নগুলো এখন আর নেই। তবে স্বজনহারা ও দগ্ধ মানুষের শরীরের ক্ষত শুকালেও তাদের মনের ক্ষত এখনো শুকায়নি। তাদের সেই স্মৃতি আজও দগদগে।

শুধু নিমতলীই নয়, এরপর এমন ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের আরও অনেক ঘটনা ঘটেছে রাজধানীতে। এসব অগ্নিকাণ্ডে প্রাণ হারিয়েছে কয়েকশ মানুষ। অপ্রত্যাশিত আগুন স্বপ্ন পুড়িয়ে অনেক পরিবারকে করেছে নিঃস্ব। এর মধ্যে ২০১২ সালে আশুলিয়ার তাজরীন ফ্যাশনে অগ্নিকাণ্ডে ১১৭ জন, ২০১৬ সালে টঙ্গীতে ট্যাম্পাকো ফয়েলস প্যাকেজিং কারখানায় ৩১ জন, ২০১৯ সালে চকবাজারের চুড়িহাট্টায় ৭১ জন, ওই বছর বনানীর এফআর টাওয়ারে ২৬ জন

এবং কেরানীগঞ্জের চুনকুটিয়ায় প্রাইম প্লাস্টিক কারখানায় ১৭ জন নিহত হন। ২০২১ সালে নারায়ণগঞ্জের হাসেম ফুড ফ্যাক্টরিতে ৫৪ জন এবং একই বছর রাজধানীর মগবাজারে একটি দোকানে বিস্ফোরণ থেকে সৃষ্ট আগুনে ১২ জন নিহত হন।

এ ছাড়া ২০২২ সালে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে বিএম ডিপোর আগুনে ৫১ ব্যক্তি নিহত হন। পুড়ে ছাই হয়ে যায় অনেক পরিবারের স্বপ্ন। কিন্তু স্বপ্ন হননকারী এসব ঘটনার একটিরও আজ পর্যন্ত বিচার হয়নি। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় অগ্নি ট্র্যাজেডি হিসেবে চিহ্নিত নিমতলীর ঘটনায় কোনো মামলাই হয়নি। এ ঘটনায় শুধু বংশাল থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি হয়। এর ভিত্তিতে পরিবারের কাছে লাশ হস্তান্তর করা হলেও জিডির আর তদন্ত হয়নি। মামলা না হওয়ায় পার পেয়ে গেছে দোষীরা।

এ ছাড়া কোনো কোনো ঘটনায় মামলা হলেও তদন্ত শেষ হয়নি। দু-একটি ঘটনায় বিচার কার্যক্রম শুরু হলেও তা চলছে একেবারেই ঢিলেঢালাভাবে। এরই মধ্যে বৃহস্পতিবার রাতে রাজধানীর বেইলি রোডের গ্রিন কজি কোট ভবনে ঘটে গেছে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা। এ ঘটনায় গতকাল শুক্রবার পর্যন্ত প্রাণ হারিয়েছেন ৪৬ জন। এই অগ্নিকাণ্ডের পেছনেও দায় রয়েছে, অবহেলা রয়েছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের। একটি মামলাও প্রক্রিয়াধীন রয়েছে বলে জানা গেছে। তবে এ ঘটনারও বিচার অন্য ঘটনাগুলোর মতো দীর্ঘসূত্রতার মুখে পড়বে বলে মত সংশ্লিষ্টদের।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অতীত থেকে সাম্প্রতিককাল পর্যন্ত রাজধানীতে যেসব ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে, সেসব নিয়ে তদন্তের পর কার্যকর কোনো ব্যবস্থা না নেওয়ায় দুর্ঘটনার পুনরাবৃত্তি হচ্ছে। সেবা সংস্থাগুলোর সমন্বয় এবং কার্যকর পদক্ষেপের অভাব, ব্যবসায়ী শ্রেণি এবং জনসাধারণের অসচেতনতা এ ক্ষেত্রে অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি করছে, যা রাজধানীবাসীর জন্য প্রতিনিয়ত হুমকি হয়ে দাঁড়াচ্ছে। ফায়ার সার্ভিসের তথ্য অনুযায়ী, প্রতি বছর দেশে গড়ে ২০ হাজারের মতো অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটছে। এসব ঘটনার মধ্যে হাতেগোনা দু-একটি ঘটনায় মামলা হচ্ছে। কিন্তু গত এক যুগের বেশি সময় ধরে সংঘটিত অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় যে কয়েকটি মামলা হয়েছে, এর কোনোটিরই বিচার শেষ হয়নি।

রাজধানীর উপকণ্ঠ আশুলিয়ার নিশ্চিন্তপুর এলাকায় অবস্থিত তাজরীন ফ্যাশনস লিমিটেড কারখানায় ২০১২ সালের ২৪ নভেম্বর ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। ওই ঘটনায় মোট ১১৭ জন পোশাক শ্রমিক নিহত হন। আহত হন ২০০ জনের অধিক। অগ্নিকাণ্ডের পরদিন আশুলিয়া থানায় অজ্ঞাতপরিচয় আসামিদের বিরুদ্ধে একটি মামলা হয়। তদন্তের পর ২০১৩ সালে ১৩ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করেন সিআইডি পুলিশের ইন্সপেক্টর এ কে এম মহসীনুজ্জামান। অভিযোগপত্রে প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক দেলোয়ার হোসেন, তার স্ত্রীসহ ১৩ জনকে অভিযুক্ত করা হয়। অভিযোগপত্রের ১০ বছর পরও বিচারকাজ শেষ হয়নি। ওই মামলায় ১০৪ জন সাক্ষীর মধ্যে হাতেগোনা কয়েকজন সাক্ষ্য দিয়েছেন। দেলোয়ার গ্রেপ্তার হলেও জামিনে বেরিয়ে তিনি এখন ক্ষমতাসীন দলের একজন নেতা।

নিমতলীর ঘটনার ৯ বছর পর ২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি রাত সাড়ে ১০টার দিকে চকবাজার মডেল থানার চুড়িহাট্টা শাহি জামে মসজিদের সামনে রাস্তায় চলন্ত একটি প্রাইভেটকারের গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরিত হয়। এতে পাশের বিদ্যুতের ট্রান্সমিটারে আগুন লাগে। একই সঙ্গে পাশে আরেকটি প্রাইভেটকারে আগুন লাগলে সেই গাড়ির গ্যাস সিলিন্ডারও বিস্ফোরিত হয়। নন্দকুমার দত্ত রোডের চুড়িহাট্টার রাস্তায় বিল্ডিংয়ের সামনে একটি পিকআপভ্যান গ্যাস সিলিন্ডার ভর্তি অবস্থায় দাঁড়িয়ে ছিল। ওই পিকআপের সিলিন্ডারগুলো বিস্ফোরিত হয়ে বাড়ির নিচতলা ও রাজমহল হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্টে আগুন লাগে। ওই রাতে চুড়িহাট্টার অগ্নিকাণ্ডে ৭১ জন মারা যায়। ওই ঘটনায় স্থানীয় মো. আসিফ আহমেদ বাদী হয়ে চকবাজার থানায় মামলা করেন। মামলাটি তদন্ত করে ঘটনার প্রায় তিন বছর পর ‘ওয়াহেদ ম্যানশন’ ভবনের মালিক দুই ভাইসহ ৮ জনকে দায়ী করে অভিযোগপত্র দেন তদন্ত কর্মকর্তা। ২০২৩ সালের ৩১ জানুয়ারি আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন আদালত। গত বছরের ১৭ অক্টোবর মামলার বাদী সাক্ষ্য দেন। তবে তার জেরা এখনো শেষ হয়নি। আগামী ২১ মার্চ মামলাটির পরবর্তী তারিখ ধার্য রয়েছে। এই মামলায় মোট সাক্ষী করা হয়েছে ১৬৭ জনকে।

২০২১ সালের ৮ জুলাই বিকেলে রূপগঞ্জের কর্ণগোপ এলাকায় হাসেম ফুড অ্যান্ড বেভারেজ লিমিটেডের কারখানার ছয়তলা ভবনে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। আগুন দেখে ভবন থেকে লাফিয়ে পড়ে তিনজনের মৃত্যু হয়। আগুনে পুড়ে ৫১ জনের মৃত্যু হয়। তারা ওই কারখানার শ্রমিক ও কর্মচারী। ওই ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে কারখানার মালিক আবুল হাসেমসহ আটজনের নাম উল্লেখ করে এবং অজ্ঞাতপরিচয় আরও কয়েকজনকে আসামি করে রূপগঞ্জ থানায় মামলা করেন। মামলাটি এখনো তদন্তাধীন।

২০১৯ সালের ২৮ মার্চ বনানীর কামাল আতাতুর্ক অ্যাভিনিউয়ের পাশের ১৭ নম্বর সড়কে ফারুক রূপায়ণ (এফআর) টাওয়ারে আগুনের ঘটনায় ঘটনাস্থলে ২৫ জন এবং হাসপাতালে একজন নিহত হন। এ ঘটনায় করা মামলা এখনো বিচারাধীন। বেইলি রোডে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার পর সাবেক মন্ত্রী অ্যাডভোকেট শ ম রেজাউল করিম গতকাল এক ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছেন, বনানীর এফআর টাওয়ারের ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে ছিল, আমাদের ভবনগুলোর অব্যবস্থাপনা এবং দেখভাল করার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত বিভিন্ন সংস্থার ব্যর্থতা। উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন তদন্ত কমিটি করেছিলাম একজন অতিরিক্ত সচিবের নেতৃত্বে। তদন্তে ৬২ জনের দায় নিরূপণ হয়েছিল ভবন নির্মাণ এবং তদারকির সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের মধ্য থেকে।

স্ট্যাটাসে তিনি আরও লেখেন, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ অনুসারে দায়ীদের এ-সংক্রান্ত তথ্য দিয়েছিলাম দুর্নীতি দমন কমিশনকে। অপ্রিয় হলেও সত্য, তদন্ত রিপোর্টে যাদের দায় নিরপেক্ষ হয়েছিল তাদের সবার বিরুদ্ধে মামলা রুজু করা হয়নি। আরও আশ্চর্য যে, তদন্ত শেষে অনেককেই বাদ দিয়ে দেওয়া হয় সেই মামলার অভিযোগপত্র থেকে। যাদের দায় উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন একটি কমিটি নির্ধারণ করেছিল, তাদের চেয়ে অনেক নিম্ন পর্যায়ের কর্মকর্তারা এ দায়ীদের অব্যাহতি দিয়ে দিলেন। অতি দ্রুততার সঙ্গে তাদের জামিন হয়ে গেল। এমনও নজির রয়েছে, কোনো কোনো আসামিকে এক দিনের জন্যও জেলহাজতে যেতে হয়নি। বিচারে শাস্তি হওয়া তো অনেক দূরের কথা।’

তিনি লিখেছেন, এভাবেই অপরাধের বিচার প্রক্রিয়াকে ভূলুণ্ঠিত করে দিয়ে বিচারহীনতার সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রভাবশালীদের হাত অনেক লম্বা। তারা সবকিছুই ম্যানেজ করে ফেলতে পারেন। বেইলি রোডের নির্মমতা আমাদের হৃদয়কে স্পর্শ করলেও অনেকেই এসব অগ্নি ঘটনায় দায়ীদের বাঁচানোর জন্যই তৎপর হয়ে যান। নারায়ণগঞ্জের হাশেম ফুডের ঘটনায় পোড়া দেহগুলো স্বজনদের হাতে হস্তান্তর করার আগেই জামিন হয়ে গেল আসামিদের। আমাদের বিবেক কি নির্বাক হয়ে এসব দেখেই যাবে?

ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ূয়া বলেন, অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার পর তদন্ত কর্তৃপক্ষ প্রকৃত অর্থে তদন্তেই যান না। যেসব বড় ঘটনায় মামলা হয়, সেখানে আসামি রাখা হয় অজ্ঞাতনামাদের। কোনো কোনো ক্ষেত্রে মামলায় দু-একজন অভিযুক্তের নাম সুনির্দিষ্টভাবে থাকলেও তাতে বিবরণ এমনভাবে লেখা হয় যে, যেখানে সাক্ষ্য-প্রমাণ জোগাড় করা দুঃসাধ্য হয়ে পড়ে। এ কারণেই অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় সুনির্দিষ্টভাবে দায় ও অবহেলা থাকার পরও প্রায় প্রতিটি ঘটনায় দোষীরা পার পেয়ে যাচ্ছে।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

টানা ৮ ঘণ্টা অবরুদ্ধ জবির ভিসি

৬৪ জেলার নেতাকর্মীদের নতুন বার্তা দিল এনসিপি

ম্যানইউর জয়হীন ধারা অব্যাহত, এবার ফুলহামের মাঠে ড্র

ব্র্যাক ও ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোক্তা-পেশাজীবীদের নিয়ে ‘আগামীর পথ’ অনুষ্ঠিত

প্রথম ক্রিকেটার হিসেবে টি-টোয়েন্টিতে সাকিবের অনন্য কীর্তি

জুলাই যোদ্ধা শহীদ তানভীরের চাচা খুন

ভরা জোয়ারে ডুবে যায় বিদ্যালয়, শঙ্কায় অভিভাবক-শিক্ষার্থী

যেভাবে গ্রেপ্তার হলেন তৌহিদ আফ্রিদি

তারের পর এবার চুরি হলো সেতুর রিফ্লেক্টর লাইট

‘এবার আমাদের পালা’ স্বরূপ আচরণ উদ্বেগজনকভাবে বাড়ছে : টিআইবি

১০

ভূমি অধিগ্রহণে আটকে আছে ইউলুপ, ইউটার্নে মরছে মানুষ!

১১

কনে দেখতে যাওয়ার পথে নৌকাডুবি : নিখোঁজ দুজনের মরদেহ উদ্ধার

১২

থাইল্যান্ডের ক্লাবে আবার ভাইরাল ‘কাঁচা বাদাম গার্ল’ অঞ্জলি

১৩

চাকসুতে সমকামিতা সমর্থক ও মাদকাসক্তদের প্রার্থিতা বাতিলের দাবি

১৪

ঠাকুরগাঁওয়ের মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় নিহত ১

১৫

শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে ১০ শয্যার এইচডিইউ উদ্বোধন

১৬

এবার তৌহিদ আফ্রিদি গ্রেপ্তার

১৭

রাকসুতে প্রথম দিনে ৫ জনের মনোনয়ন সংগ্রহ 

১৮

ফিলিস্তিনিদের ৩০০০ জলপাই গাছ উপড়ে ফেলল ইসরায়েলি বাহিনী

১৯

দেশে ১ কোটি কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হবে : টুকু

২০
X