ময়মনসিংহের মুক্তাগাছার মাহবুবুর রহমান আকন্দ। প্রায় ছয় বছর আগে ভাগ্যান্বেষণে পাড়ি জমিয়েছিলেন মালয়েশিয়ায়। সব কিছু ঠিকঠাকই চলছিল। গত বছর ধরা পড়েন দেশটির পুলিশের হাতে। জেল হয় তিন মাসের। তবে ছয় মাস পার হলেও মুক্তি মেলেনি মাহবুবের। একইভাবে সাজা শেষ হওয়ার এক মাস পার হলেও বন্দিজীবন কাটছে চট্টগ্রামের বাঁশখালীর শাহিদুল ইসলাম নামের আরও এক ব্যক্তির। তাদের মতো মালয়েশিয়ার বিভিন্ন বন্দিশিবিরে আটকে আছেন ১৫৯ জন বাংলাদেশি। সাজার মেয়াদ শেষ হওয়ার পরও ট্রাভেল পাসের জন্য তাদের মুক্তি মিলছে না।
অভিযোগ রয়েছে, বিন্দিশিবিরে তাদের ঠিকমতো খাবার দেওয়া হচ্ছে না। চলছে নির্যাতনও। তাদের জিম্মি করে মোটা অঙ্কের অর্থ আদায়ের অভিযোগ রয়েছে এনজেড ওয়ার্ল্ড ট্রাভেলস নামের একটি কোম্পানির বিরুদ্ধে। তাদের চাহিদামতো টাকা দিলে মেলে দূতাবাসের ট্রাভেল পাস। এই চক্রে জড়িত রয়েছেন মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশি দূতাবাসের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও এক কর্মচারী।
নিয়ম অনুযায়ী, মালয়েশিয়ায় কোনো বিদেশি আটক হলে তাকে প্রথমে থানায় রাখা হয়। এরপর প্রয়োজনীয় কাগজপত্র চাওয়া হয়। কাগজপত্র নিয়ে পরিচিতজন বা যে কোম্পানিতে তিনি কাজ করেন, সেই কোম্পানির মালিক থানায় যোগাযোগ করেন। কাগজপত্র যাচাই-বাছাই করে সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে ছেড়ে দেওয়া হয়। কেউ যোগাযোগ না করলে বা কাগজপত্র না থাকলে সর্বোচ্চ ১৪ দিন পর্যন্ত থানায় আটক রাখার বিধান রয়েছে। এই ১৪ দিনের মধ্যে কেউ যোগাযোগ না করলে দেওয়া হয় মামলা। মামলায় অপরাধ ভেদে ২ মাস থেকে ১০ বছর পর্যন্ত সাজার বিধান রয়েছে। সেইসঙ্গে জেলখানা কর্তৃপক্ষ সংশ্লিষ্ট দেশের দূতাবাস বরাবর আটকৃত ব্যক্তির তথ্য প্রেরণ করে। দূতাবাস সেসব তথ্য নিয়ে দেশে ওই ব্যক্তির ঠিকানা বা সংশ্লিষ্ট থানায় পাঠায়। আটককৃত ব্যক্তির পরিচয় নিশ্চিত করে থানা থেকে দূতাবাসে মেইল পাঠানো হয়। আটককৃত ব্যক্তির পরিচয় শনাক্তের পর তার পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করে দূতাবাস থেকে ইস্যু করা হয় ট্রাভেল পাস ও বিমানের টিকিট। টিকিটের টাকা পরিবার থেকে বহন করা হয়। আর সাজা খাটার মেয়াদ শেষ হলে আটক ব্যক্তি দূতাবাসের তত্ত্বাবধানে ফিরে আসেন দেশে। তবে নিয়ম এমন হলেও বাস্তবে ঘটে তার উল্টো।
আটক ব্যক্তিদের পরিবার থেকে এমন একাধিক অভিযোগ এলে এনজেড ওয়ার্ল্ড ট্রাভেলস ও কালবেলার মালয়েশিয়া প্রতিনিধির মাধ্যমে দূতাবাসে দীর্ঘ এক মাস ধরে খোঁজখবর নেওয়া হয়। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, দূতাবাসের শ্রম শাখার এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এবং এক কর্মচারীর যোগসাজশে এনজেড ওয়ার্ল্ড ট্রাভেল নামের কোম্পানিটির সঙ্গে তৈরি হয়েছে একটি সিন্ডিকেট। বছর দুয়েক আগে ওই কর্মকর্তা বদলি হয়ে মালয়েশিয়ায় যান। সেখানে গিয়েই গড়ে তোলেন এই সিন্ডিকেট। এই চক্রে আরও জড়িত রয়েছেন মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশি দূতাবাসের একজন চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী। ওই কর্মচারী মালয়েশিয়ান ভাষায় পারদর্শী হওয়ায় দূতাবাসে তার প্রচণ্ড প্রতাপ। মালয়েশিয়া থেকে ঢাকার একটি রিটার্ন টিকিটের মূল্য ৬০০ থেকে ৮০০ রিঙ্গিত হলেও এনজেডকে দিতে হয় ২ হাজার ১৫০ মালয়েশিয়ান রিঙ্গিত। এর পরই মুক্তি মেলে বন্দিশিবির থেকে।
দূতাবাস এবং বিভিন্ন জেলখানায় আটক হওয়া বাংলাদেশিদের তালিকা সংগ্রহ করেন এই ট্রাভেল এজেন্সির কর্মকর্তারা। এরপর সেই তালিকা ধরে ফোন দেওয়া হয় বাংলাদেশে বসবাসরত আটকৃতের স্বজনদের। তাদের কাছ থেকে দাবি করা হয় মোটা অঙ্কের টাকা। টাকা দিলে এনজেডের সবুজ সংকেত পেলেই ট্রাভেল পাস ইস্যু করে দূতাবাস। যারা টাকা দিতে রাজি হন না, তাদের সাজা শেষ হওয়ার পরও বন্দিশিবিরে আটক থাকতে হয়। এনজেডের কর্মকর্তারা সারাক্ষণ দূতাবাসের আশপাশে ঘোরাঘুরি করেন। দূতাবাসের কর্মকর্তাদের সঙ্গে রয়েছে তাদের সখ্য। এ ছাড়া স্থানীয় জেলখানা এবং বন্দিশিবিরগুলোতেও রয়েছে তাদের বিশাল সিন্ডিকেট। এই সিন্ডিকেটের চোখ এড়িয়ে একজন বন্দিও বের হতে পারেন না। কেউ প্রতিবাদ করলে নেমে আসে নির্যাতন। বন্ধ করে দেওয়া হয় খাবার। এরপর তাদের দিয়ে ফোন দেওয়ানো হয় দেশে থাকা পরিবারের কাছে। বৈধ বাংলাদেশিদেরও পুলিশ দিয়ে বিভিন্নভাবে হেনস্তা করা হয়।
গত বুধবার দেওয়া দূতাবাসের তথ্যমতে, সাজা শেষ হওয়ার পরও বর্তমানে মালয়েশিয়ার বিভিন্ন বন্দিশিবিরে আটক আছেন ১৫৯ জন বাংলাদেশি। আর আটক হয়ে জেল খাটছেন ৫৮৪ জন।
ভুক্তভোগী মাহবুবুর রহমান আকন্দের স্ত্রী কালবেলাকে বলেন, ‘আমার স্বামীর সাজা তিন মাসের কথা বলছিল। এখন তো ছয় মাস হয়া গেছে। আইতেছে না, সমস্যাটা কী বুঝতেছি না। এর মধ্যে একটা লোক একদিন মালয়েশিয়া থেকে ফোন দিছিল। বলে টাকা দেন। সে ৪৭ হাজার টাকা চায়। এহন টাকা যে দিব আমরা তো তারে চিনি না। সাজা শেষ হয়ে গেছে এখনো আসে না, এহন এইটা নিয়ে অনেক টেনশনে আছি।’
এই নারীর কাছ থেকে নম্বর নিয়ে ওই ব্যক্তির সঙ্গে যোগাযোগ করে দৈনিক কালবেলা। নম্বর +৬০১১১১১১৮০১৬। এই নম্বরের হোয়াটসঅ্যাপে দেখা যায় একটি বিজনেস অ্যাকাউন্ট। অ্যাকাউন্ট নাম ‘এনজেড ট্রাভেলস (আবির)’। এ ছাড়া অ্যাকাউন্টের প্রোফাইল এবং কভার ফটোতে এনজেড ট্রাভেল এজেন্সির লোগোসহ ছবি দেওয়া রয়েছে। এই নম্বরের ট্রুকলারেও এনজেড ট্রাভেল এজেন্সির লোগো সংবলিত ছবি দেখা যায়। একজন আটকে পড়া বাংলাদেশির স্বজন সেজে তাকে ছাড়ানোর জন্য কথা বলেন এই প্রতিবেদক। ওই ব্যক্তি কল ধরে নম্বরটি পরিবর্তন করেছেন জানিয়ে +৬০১১১১১১৬৯৯ নম্বরে যোগাযোগ করতে বলেন। এই নম্বরে ফোন দিলে একই ব্যক্তি ধরে বলেন, ‘কার কথা যেন বললেন, আকন্দ না?’ এরপর হ্যাঁ বললে তিনি বলেন, ‘আমাকে মাত্র পুলিশ ধরেছে, গাড়ির কাগজপত্র চেক করতেছে। পরে কথা বলব।’ পরে ফোন দেওয়া হলে তিনি আর ধরেননি।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে এনজেড ওয়ার্ল্ড ট্রাভেল এজেন্সির বিজনেস ডেভেলপমেন্ট বিভাগের পরিচালক মোহাম্মদ জিল্লুকে ফোন দেওয়া হয়। তিনি কালবেলাকে বলেন, ‘রাজু নামে একজন আপনাকে ফোন দেবে। সে জেলখাটা বাংলাদেশিদের ছাড়াতে কাজ করে। বিষয়টি নিয়ে আমাদের সঙ্গে কয়েকবার দূতাবাসের মিটিং হয়েছে। ওই মিটিংগুলোতে ও অ্যাটেন্ট করেছে। ও আপনাকে পুরো বিষয়টা বলতে পারবে। এর কিছুক্ষণ পর মোস্তফা ইমরান রাজু নামের একজন ফোন দিয়ে নিজেকে বাংলাদেশি একটি বেসরকারি স্যাটেলাইট টেলিভিশনের মালয়েশিয়া প্রতিনিধি ও এনজেড ট্রাভেলসের ব্র্যান্ড ডেভেলপমেন্ট ম্যানেজার হিসেবে পরিচয় দেন। এরপর তিনি কালবেলাকে বলেন, ‘এই কাজ এনজেড আগে করত। এখন করে না। তবে কিছু মানুষ এনজেডের নাম করে এই ধরনের কাজ করতে পারে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে এনজেডের সঙ্গে গত ২৬ ফেব্রুয়ারি দূতাবাসে একটি মিটিং হয়। মিটিংয়ে দূতাবাসের পক্ষ থেকে একটি সতর্কতা নোটিশ এবং এনজেডের পক্ষ থেকে একটি নোটিশ দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। দূতাবাস অলরেডি তাদের নোটিশ দিয়ে দিয়েছে। আমরাও সবার কাছে আমাদের মেসেজ পৌঁছে দিয়েছি।’ এরপর ওই ব্যক্তি ২৩ ফেব্রুয়ারির স্বাক্ষরিত একটি নোটিশ হোয়াটসঅ্যাপে পাঠান। সেখান এনজেড এই কাজের সঙ্গে জড়িত নয় লেখা রয়েছে।
এদিকে বেশ কয়েকদিন ধরে সাজার মেয়াদ শেষ হওয়ার পরও মালয়েশিয়ার বিভিন্ন বন্দিশিবিরে আটকে থাকা বাংলাদেশিদের তথ্য চাওয়া হয় দূতাবাসের কর্মকর্তাদের কাছে। তবে দূতাবাসের কর্মকর্তাদের থেকে কোনো তথ্য মেলেনি। এর পরই গত ২৭ ফেব্রুয়ারি দূতাবাস থেকে একটি সতর্কতা নোটিশ জারি করা হয়। নোটিশে বলা হয়, ‘বিভিন্ন ডিটেনশন ক্যাম্পে অবস্থানরত বাংলাদেশিদের কাছে কোনো কোনো ব্যক্তি বাংলাদেশ হাইকমিশনের কর্মকর্তা-কর্মচারী পরিচয় দিয়ে নিজেকে উপস্থাপন করেন এবং টিকিট বিক্রির ক্ষেত্রে সহায়তার প্রস্তাব দেন, এ বিষয়ে সব প্রবাসীকে সতর্ক থাকার অনুরোধ করা হচ্ছে। এ ধরনের কার্যক্রমের সঙ্গে বাংলাদেশ হাইকমিশন সংশ্লিষ্ট নয়। নোটিশ দেওয়ার পরের দিন বুধবার দূতাবাস থেকে তথ্য দেওয়া হয়।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ দূতাবাসের কাউন্সিল (লেবার) মো. শরিফুল ইসলাম কালবেলাকে বলেন, ‘আমাদের কাছেও এমন একটি অভিযোগ এসেছে। যে কারণে আমরা দূতাবাস থেকে একটি সতর্কতা নোটিশ দিয়েছি। যারা এ ধরনের অনৈতিক কাজে জড়িত থাকবে বা করবে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সঙ্গে সঙ্গে প্রবাসীদের সতর্ক থাকতে হবে, যাতে তারা ভুল পথে পা না বাড়ায়।’