রীতা ভৌমিক
প্রকাশ : ০৮ মার্চ ২০২৪, ০৩:৩৫ এএম
আপডেট : ০৮ মার্চ ২০২৪, ০৭:৩৩ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
আন্তর্জাতিক নারী দিবস আজ

সমঅধিকার প্রতিষ্ঠায় বিনিয়োগ এখনো সীমিত

সমঅধিকার প্রতিষ্ঠায় বিনিয়োগ এখনো সীমিত

আজ আন্তর্জাতিক নারী দিবস। একশ বছরেরও বেশি সময় ধরে সারা বিশ্বে দিবসটি উদযাপিত হয়ে আসছে। শ্রমিক আন্দোলন থেকে উদ্ভূত হওয়া নারী দিবসের ধারণা পরবর্তী সময়ে স্বীকৃতি পায় জাতিসংঘের। ‘নারীর সমঅধিকার, সমসুযোগ এগিয়ে নিতে হোক বিনিয়োগ’ শীর্ষক প্রতিপাদ্য সামনে রেখে এ বছর পালিত হবে দিবসটি। নানা সেক্টরে নারীরা এখন নেতৃত্ব দিলেও সংখ্যাটা পুরুষের তুলনায় বেশ কম। বিশেষ করে বেসরকারি খাতে নারীদের অংশগ্রহণ বাড়লেও বিনিয়োগ জটিলতায় অনেকেরই উদ্যোগ শেষ পর্যন্ত সফলতার মুখ দেখে না। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতাও এ ক্ষেত্রে আশানুরূপ নয়। নারী উন্নয়নের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত খাতগুলোতে প্রতি বছর বরাদ্দ বাড়লেও মোট বাজেটের তুলনায় তা অতি সামান্য। অন্যদিকে পারিবারিক সম্পদ, শ্রমের মজুরিসহ নানা ধরনের বৈষম্য নারীর অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। বিশষজ্ঞদের মতে, সব ক্ষেত্রে নারীর সম অংশীদারত্ব নিশ্চিত করতে হলে সরকারকেই উদ্যোগ নিতে।

প্রতি বছর বিশ্বের প্রায় সব দেশেই মহাসমারোহে উদযাপন করা হয় নারী দিবস। এই নারী দিবসের প্রথম বীজ রোপিত হয় ১৯০৮ সালে। নিউইয়র্ক শহরের রাস্তায় কর্মঘণ্টা কমিয়ে আনা, বেতন বৃদ্ধি এবং ভোটাধিকারের দাবিতে নারীদের বিশাল এক র্যালির মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী নারী আন্দোলনের সূচনা হয়। পরে ১৯০৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সোশ্যালিস্ট পার্টি সর্বপ্রথম জাতীয় নারী দিবস ঘোষণা করে। সেসময় যুক্তরাষ্ট্রসহ ইউরোপের কয়েকটি রাষ্ট্র নারী অধিকারকে গুরুত্ব দিয়ে দিবসটি পালন শুরু করে। ১৯১০ সালে কোপেনহেগেনে কর্মজীবী নারীদের এক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে এ ধারণাটি বৈশ্বিক পরিচিতি লাভ করে। নারী অধিকার কর্মী ক্লারা জেটকিন সম্মেলনে উপস্থিত ১৭ দেশের ১০০ জন নারীর সামনে নারী দিবসের প্রস্তাব করেন। উপস্থিত সবাই তার প্রস্তাব সর্বসম্মতভাবে গ্রহণ করেন। এরপর ১৯১১ সালে অস্ট্রিয়া, ডেনমার্ক, জার্মানি এবং সুইজারল্যান্ডে প্রথমবারের মতো পালিত হয় আন্তর্জাতিক নারী দিবস।

তবে ক্লারা জেটকিন নারী দিবস উদযাপনের নির্দিষ্ট কোনো তারিখ উল্লেখ করেননি। ১৯১৭ সালে রুশ নারীরা ‘রুটি এবং শান্তি’ এই দাবিতে তৎকালীন জারের বিরুদ্ধে ধর্মঘট শুরু করেন। আন্দোলনের একপর্যায়ে গদি ছাড়তে বাধ্য হন জার। আনুষ্ঠানিকভাবে ভোটাধিকার পান নারীরা। ওই সময় গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার অনুযায়ী নারীদের ধর্মঘট শুরু হয়েছিল ৮ মার্চ। পরে নারী অধিকার কর্মীদের সিদ্ধান্ত অনুসারে ৮ মার্চকেই আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে উদযাপনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এবার সারা বিশ্ব উদযাপন করছে ১১৩তম বিশ্ব নারী দিবস।

আন্তর্জাতিক নারী দিবসের বয়স শত বছর পার হলেও এখনো অনেক ক্ষেত্রে নারী অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়নি। উন্নত বিশ্বে নারীরা যথাযথ মূল্যায়ন এবং বিনিয়োগে অনুকূল সুবিধা পেলেও পৃথিবীর অনেক প্রান্তে এখনো তারা অবহেলিত। এশিয়া এবং আফ্রিকার অনেক দেশে যথাযথ পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে নারীরা মেধার বিকাশ ঘটাতে পারছেন না। এর মধ্যে অনেক দেশে সামাজিকভাবেই নানা ধরনের বাধা তৈরি করা হচ্ছে। তবে গত কয়েক দশকে বাংলাদেশে নারীদের বিস্ময়কর উত্থান ঘটেছে। বেড়েছে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতাও। তবে সামগ্রিক প্রয়োজনের তুলনায় তা অনেক কম।

বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০১৩-১৪ অর্থবছরের বাজেটে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের জন্য বরাদ্দ ছিল ১ হাজার ৩০৫ কোটি টাকা, যা মোট বাজেটের শূন্য দশমিক ৬৫ শতাংশ। এক দশক পর ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের জন্য বরাদ্দ করা হয় ৪ হাজার ৭৫৫ কোটি টাকা। বরাদ্দের এই পরিমাণ মোট বাজেটের দশমিক ৬২ শতাংশ। অর্থাৎ গত এক দশকে জাতীয় বাজেটের আকার বিপুল পরিমাণে বাড়লেও তাতে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অংশীদারত্ব কমেছে। বাজেটের এই চিত্র থেকে বোঝা যায়, নারীর জন্য যে বরাদ্দের কথা বলা হয়েছে, তা যথেষ্ট নয়।

যদিও জাতীয় বাজেটের সঙ্গে প্রতি বছর যে জেন্ডার বাজেটের হিসাব দেওয়া হচ্ছে, তাতে নারী উন্নয়নে বাজেটের অবদান অনেক গুণ বেশি দেখানো হচ্ছে। সরকারের হিসাবে ২০১৩-১৪ অর্থবছরে মোট বাজেটের ২৬.৭৪ শতাংশ (৬৪ হাজার ৮৭ কোটি টাকা) নারী উন্নয়নে ভূমিকা রেখেছে। আর দশ বছর পর ২০২৩-২৪ অর্থবছরে এ হার দাঁড়িয়েছে ৩৪.৩৭ শতাংশ (২ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৭ কোটি টাকা)।

বিশেষজ্ঞদের মতে, এই হিসাব শুধুমাত্র কাগজে-কলমে। নারীর সমঅধিকার, সমসুযোগের মাধ্যমে বিনিয়োগকে কীভাবে এগিয়ে নিয়ে যাবে তা দশ বছরের বাজেট পর্যালোচনা করলে দেখা যায় বরাদ্দ বেড়েছে মাত্র ৭.৬৩ শতাংশ।

অন্যদিকে জেন্ডার বাজেটে ‘উৎপাদন, শ্রমবাজার ও আয়বর্ধক কাজে নারীর অধিকতর অংশগ্রহণ’ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় এই খাতে, ২০২১-২২ অর্থবছরে ১৪ হাজার ১০৮ কোটি টাকা, অর্থাৎ ৪৪.৮ শতাংশ বরাদ্দ ছিল।

২০২৩-২৪ অর্থবছরে ১৪ হাজার ১৩২ কোটি টাকা অর্থাৎ ৪১.১ শতাংশ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক সায়মা হক বিদিশা কালবেলাকে বলেন, বিনিয়োগকে জেন্ডার বাজেটের সমার্থক হিসেবে চিন্তা করলে সঠিক হবে না। জেন্ডার বাজেট শুধু নারীদের জন্য বাজেট নয়। বরং বাজেটের জেন্ডারভিত্তিক একটা বিশ্লেষণ। এক্ষেত্রে জেন্ডার বাজেটের ট্রেন্ড দেখে বা গতিপ্রকৃতির সঙ্গে নারীর জন্য বিনিয়োগকে এক করে দেখা সঠিক উপায় নয়। আমাদের দেখা দরকার, বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ খাতে মন্ত্রণালয়গুলোতে যে প্রকল্প নেওয়া হচ্ছে সেগুলোতে নারীদের বিভিন্ন সমস্যা ও চ্যালেঞ্জকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে কি না।

উদাহরণ স্বরূপ তিনি বলেন, একটি বিদ্যালয়ে ছেলে-মেয়ে উভয়ই পড়েছে। সেখানে ৫০ শতাংশ নারীর জন্য বরাদ্দ বলা হচ্ছে। এখানে নারীর জন্য বিনিয়োগ সেভাবে হচ্ছে না। এই বিনিয়োগের মধ্যে নারী-পুরুষ উভয়ই থাকছে। একটি কর্মজীবী হোস্টেলে বিনিয়োগ করা হলো। সেটা একেবারে নারীর জন্য বিনিয়োগ। নারীর জন্য যে চ্যালেঞ্জগুলো রয়েছে তা মোকাবিলা করার জন্য প্রয়োজন বিনিয়োগ। এক্ষেত্রে আমাদের দেখা দরকার, নারীদের সমস্যাগুলোকে চিহ্নিত করে সুনির্দিষ্ট যে চ্যালেঞ্জ রয়েছে তা নিরসনে সরকার কী ধরনের প্রকল্প নিয়েছে। এদিক থেকে বিবেচনা করলে সার্বিকভাবে আমাদের অনেক প্রকল্পই রয়েছে। শিক্ষা, দক্ষতা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে প্রকল্প রয়েছে। কিন্তু আমাদের চাহিদার কথা ভেবে নারী-পুরুষের বিভিন্ন জায়গার ব্যবধান কমানোর জন্য আরও অনেক বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। কিছু কিছু বিনিয়োগ প্রচলিত। সেগুলোর মধ্যে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, দক্ষতা বৃদ্ধি, কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে বিনিয়োগ যেমন আছে, পাশাপাশি আমাদের বিনিয়োগগুলো করতে হবে ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ নিয়ে। অর্থাৎ এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন, অটোমেশিন, ফোরর্থ ইন্টারন্যাশনালের চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলার জন্য বিনিয়োগ করা হচ্ছে কি না!

তিনি আরও বলেন, আমাদের কিছু মৌলিক সমস্যাও রয়েছে। বাল্যবিয়ে ও নারীর প্রতি সহিংসতার মতো ক্ষেত্রগুলোতে সঠিক বিনিয়োগ দরকার। নারীর প্রতি সহিংসতা কমাতে হলে সামাজিক পরিবর্তনের পাশাপাশি বিনিয়োগেরও প্রয়োজন রয়েছে। বিশৃঙ্খলার ক্ষেত্রে, বিভিন্ন জায়গায় নির্যাতনের শিকার নারীদের নিরাপত্তার জন্য আবাসনের ব্যবস্থা করতে হবে। বাল্যবিয়ের ক্ষেত্রে জেন্ডার সংবেদনশীল নয়, মানসিকতা পরিবর্তনের জন্য তহবিলের দরকার আছে।

জেন্ডার উইমেন অ্যান্ড স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক ড. তানিয়া হক কালবেলাকে বলেন, বড় আকার থেকে ধরে ক্ষুদ্র পর্যায়ে বলা যায় পারিবারিক বাজেটও গুরুত্বপূর্ণ। পরিবার হচ্ছে আসল গণ্ডি। সেখানে মেয়ের জন্য কম খরচ করা হয়। এই চিন্তাভাবনার জায়গা পরিবর্তন করে জেন্ডার সমতা প্রতিষ্ঠা করা দরকার। একই খাতে একই খরচ করলে চলবে না। কারণ নারী-পুরুষের খরচের খাত হবে ভিন্ন। কারণ দুজনের চাহিদা ভিন্ন। এজন্যই জাতীয়-কেন্দ্রীয় পর্যায়ে চাহিদা অনুযায়ী বিনিয়োগের ক্ষেত্রে আমাদের ইতিবাচক দৃষ্টি দিতে হবে। কোন কোন খাতে বাজেটে আর্থিক বরাদ্দ হলে শুধু নারীর উন্নয়ন না সত্যিকারের ক্ষমতায়নের বাধার জায়গাগুলো দূর হবে সেগুলো খুঁজে বের করতে হবে। কাঠামোগত, শিক্ষা, আচরণগত ইত্যাদিতে নারীকে জায়গা করে দিতে হবে।

তিনি আরও বলেন, বাজেট কতটা বরাদ্দ হচ্ছে সেটা দেখা দরকার। তা প্রয়োগ হচ্ছে কি না, কতটা কাজ হয়েছে এর হিসাব নেই। বাজেট বরাদ্দের পর তা কোথায় যায় আমরা জানি না। সেটা ওই কাজে খরচ হচ্ছে কি না বা তা কোনো প্রভাব ফেলতে পারছে কি না তা যাচাই করা উচিত। এর ভিত্তিতে পরবর্তী বাজেট হবে। সে ভিত্তিতে আমাদের কাজ করা দরকার।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

ফুটবল ও ক্রিকেট, দুই বিশ্বকাপেই খেলবে যেসব দেশ

চুল পড়া আর খুশকির সমস্যা বাড়াচ্ছেন নিজের ৬ অভ্যাসে

তাসফিনের হাত পুনঃসংযোজন এক বিরল সাফল্য : রিজভী

অভিযানে আটকের পর বহিষ্কৃত যুবদল নেতার মৃত্যু

নির্বাচনে জনগণই তাদের ভোট পাহারা দেবে : সালাহউদ্দিন আহমদ

কারাবন্দি ইমরান খানের সঙ্গে সাক্ষাৎ নিষিদ্ধ করল পাকিস্তান সরকার

১ যুগের নতুন দিগন্তে কুবিসাস

তারেক রহমানের নেতৃত্বে নির্বাচনে অংশ নেবে বিএনপি : আমীর খসরু 

দুর্যোগ মোকাবিলায় স্কাউটদের ভূমিকা অনন্য : শিক্ষা উপদেষ্টা

আইজিপি বাহারুলকে বরখাস্তের দাবিতে প্রধান উপদেষ্টাকে আইনজীবীর চিঠি

১০

নেইমারের বিশ্বকাপ খেলা নিয়ে নতুন তথ্য জানালেন আনচেলত্তি

১১

ভারতে আজহারির নামে ‘মাহফিলের’ প্রচারণা, যা জানা গেল

১২

পুলিশ সদস্যের ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার

১৩

অতিরিক্ত খাওয়া থামানোর সহজ ১০ উপায়

১৪

ভারত বাদ, বাংলাদেশ-চীনকে নিয়ে জোটের প্রস্তাব পাকিস্তানের

১৫

ফুটবল বিশ্বকাপে ফিফার নিরপেক্ষতা নিয়ে গুরুতর বিতর্ক

১৬

পাকিস্তান আফগানিস্তান সীমান্তে তীব্র গোলাগুলি, নিহত ৪

১৭

ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে স্টোর অফিসার নিহত

১৮

পঞ্চগড়ে দেশের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা, স্থবির জনজীবন

১৯

ফিফার শান্তি পুরস্কার পেলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প

২০
X