

কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের সবুজে ঘেরা পরিসরটিতে প্রতিদিন নিত্যনতুন গল্প জন্ম নেয়— অর্জনের, সংগ্রামের, কখনও আবার সংকটের। এ গল্পগুলোকে ধারাবাহিকভাবে তুলে আনে যে সংগঠনটি, সেটি হলো কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতি (কুবিসাস)। প্রতিষ্ঠার পর এক যুগ পার করে আজ সংগঠনটি ক্যাম্পাস সাংবাদিকতার এক প্রাতিষ্ঠানিক রূপ বলেই বিবেচিত।
স্বপ্ন, সততা, দায়িত্ববোধ ও সত্য অনুসন্ধানের চেতনা নিয়ে কয়েকজন দায়িত্ববান শিক্ষার্থীদের হাত ধরে ক্যাম্পাস সাংবাদিকতার নতুন মানদণ্ড তৈরি করার প্রত্যয়ে এক বিকালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতি।
২০০৬ সালে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর পর সাংবাদিকতা শুরু হলেও প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নেয় ২০১৩ সালের ৬ ডিসেম্বর। শুরুতে সংখ্যা কম ছিল— কিন্তু সাহস ছিল বেশি। কয়েকজন নির্ভীক তরুণ-তরুণীর হাতে গড়া এই সংগঠন সময়ের পরিক্রমায় পরিণত হয়েছে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর নির্ভরতার জায়গায়। আমতলার আড্ডা থেকে শুরু হওয়া এ যাত্রা আজ বটবৃক্ষের মতো ছায়া দিয়েছে ক্যাম্পাসের বিবেকজাত সাংবাদিকতায়। সৎ তথ্য, নির্ভুল প্রতিবেদন আর নৈতিকতার অনুশীলন— এ তিনটি নীতিকে আঁকড়ে রেখে কুবিসাস কখনোই মিথ্যা, গোপন স্বার্থ বা পক্ষপাতের সংস্কৃতিতে নিজেকে বিলিয়ে দেয়নি। ১২ বছরের এ যাত্রা তাই কেবল বয়সের সংখ্যা নয়; এটি এক নিরন্তর সাধনা, দায়িত্ববোধের স্কুল এবং সত্যের প্রতি গভীর নিষ্ঠা।
বিশ্ববিদ্যালয়ের নিত্যদিনের ঘটনা, অর্জন, অনিয়ম, আন্দোলন— সব ক্ষেত্রেই কুবিসাসের তরুণ সদস্যরা নিজেদের সময়, শ্রম, অ্যাকাডেমিক ব্যস্ততা এমনকি নিরাপত্তা পর্যন্ত ঝুঁকিতে ফেলে সত্য তুলে ধরেছে। এ সত্য তুলে ধরতে গিয়ে বারবার শাসকগোষ্ঠীর বিরাগভাজন হয়েছে কুবিসাস। তবুও প্রশাসনিক জটিলতা, রাজনৈতিক চাপ, ছাত্রসংগঠনের বাধা কিংবা প্রাণনাশের হুমকি— কিছুই তাদের পিছিয়ে দেয়নি। সাংবাদিকতার নীতিকে সামনে রেখে তারা বারবার দাঁড়িয়েছে দুর্বলতার পাশে এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে। এতে মাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বচ্ছতা বাড়েনি; প্রতিষ্ঠানের জবাবদিহিতার সংস্কৃতিও শক্ত ভিত্তি পেয়েছে।
শুরুতে ছিল অভিজ্ঞতার অভাব, সীমিত সম্পদ, প্রযুক্তিগত অক্ষমতা, সবকিছু মিলিয়ে পথ ছিল পিচ্ছিল। কিন্তু সেই পিচ্ছিল পথে হাতে হাত ধরে নিজের পথে হেঁটে চলে গেছে কুবিসাস। তাই ১২ বছরের এই পথচলা কেবল কোনো সংগঠনের বয়স নয়; এটি এক নিরন্তর সাধনা, দায়িত্ববোধ ও নৈতিকতার পাঠশালা।
শত পথ মাড়িয়ে চলার পরও এক স্বৈরাচার নিপাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে কুবিসাস। যখন সবকিছুই অন্ধকারে তখন প্রায় ১২ ঘণ্টা লাইভ দিয়ে শিক্ষার্থীদের মনোবল টিকে রাখেন। যেখানে জাতীয় দৈনিকের সাংবাদিকরা নিজের জীবনের ভয়ে পথ থেকে চলে গিয়েছিল তখন আলোর বাতি হয়ে ফিরে এসেছে কুবিসাস। শিক্ষার্থী নিরাপত্তা, আন্দোলন চলমান রাখা, শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সমন্বয় করাসহ পুরো কুমিল্লার আন্দোলনে এক যুগপৎ ভূমিকা রেখেছে কুবিসাস। এ সময় স্বৈরাচার শাসকের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়েই শিক্ষার্থীদের অগ্রভাগে ছিলেন কুবিসাস। এসময়ে রাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থার পক্ষ থেকে এসেছে মৃত্যুর ভয়। কিন্তু যে জীবন সত্যের প্রতি নিবেদিত তাকে দমায় কে? তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত কুবিসাস।
সাংবাদিকতা কখনোই কেবল উৎসবের গল্প নয়। ক্যাম্পাসে বিভিন্ন সময়েই ঘটেছে অনিয়ম, অব্যবস্থা, শিক্ষার্থীদের দুর্ভোগ বা প্রশাসনিক জটিলতা। এর প্রতিটিতেই কুবিসাসের কলম কথা বলেছে। চাপ, সমালোচনা, কঠিন পরিস্থিতি— সবকিছু মোকাবিলা করেও সংগঠনটি সত্যের পক্ষে অবিচল থেকেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার যে অগ্রগতি আজ দেখা যায়, তার পেছনে কুবিসাসের দায়িত্বশীল অবদান অস্বীকার করার উপায় নেই।
কুবিসাসকে শুধু একটি সংগঠন বলা খুব কম বলা হয়। এটি হয়ে উঠেছে একধরনের পরিবার— যেখানে সিনিয়র-জুনিয়র সম্পর্ক পেশাদারিত্বে সীমাবদ্ধ নয়; বরং সহযাত্রীর বন্ধন।
কুবিসাস শুধু সংবাদ প্রকাশ করেনি; এটি তৈরি করেছে একটি সাংবাদিকতা সংস্কৃতি। বিশ্ব এখন দ্রুত পরিবর্তনের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। ডিজিটাল ফেক নিউজ, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, সামাজিক মাধ্যমের অ্যালগরিদমিক প্রভাব— সবই সাংবাদিকতার জন্য নতুন চ্যালেঞ্জ। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে নিয়মিত আয়োজিত হয়েছে— রিপোর্টিং ও এডিটিং ওয়ার্কশপ, অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার প্রশিক্ষণ, ভুয়া তথ্য শনাক্তকরণ সেশন, মাল্টিমিডিয়া ও ডেটা জার্নালিজম কর্মশালা।
এই প্রশিক্ষণগুলো কুবিসাসের সদস্যদের শুধু দক্ষতা বাড়ায়নি, তৈরি করেছে সমালোচনামূলক চিন্তাও।
কুবিসাস ক্যাম্পাসের আলো ছাড়ানোর পর বহু সদস্য আজ প্রথম আলা, দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড, বণিক বার্তা, যুগান্তর, কালেরকণ্ঠ, কালবেলা, আজকের পত্রিকা, ডেইলি সান, সময় টিভিসহ বিভিন্ন শীর্ষ গণমাধ্যমে সফলতার স্বাক্ষর রেখে চলছে। পিছিয়ে নেই অন্যান্য ক্ষেত্রেও।
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতির এক যুগ পূর্তি তাই শুধুই একটি বার্ষিকী নয়; এটি একটি স্বপ্ন পূরণের গল্প, দায়িত্ববোধের পথচলা, সত্যের প্রতি অঙ্গীকার। যারা এই সংগঠন তৈরি করেছেন, যারা পথচলায় যুক্ত ছিলেন এবং আছেন— সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টা কুবিসাসকে আজকে এই অবস্থানে এনে দাঁড় করিয়েছে।
এই এক যুগের যাত্রা প্রমাণ করে— একটি কলম বদলে দিতে পারে ক্যাম্পাসের চিত্র, আর একটি সংগঠন বদলে দিতে পারে একটি প্রজন্মের চিন্তাধারা। এক যুগের গৌরবময় পথচলার জন্য কুবিসাস পরিবারের প্রতি রইল শুভেচ্ছা, শ্রদ্ধা ও আগামীর জন্য অফুরন্ত শুভকামনা।
মন্তব্য করুন