অধিকতর যোগ্য প্রার্থী থাকা সত্ত্বেও নিয়মবহির্ভূতভাবে পছন্দের ব্যক্তিকে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দিচ্ছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় (চবি) প্রশাসন। অভি বড়ুয়া নামে ওই প্রার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী প্রক্টর অরূপ বড়ুয়ার স্ত্রী। তাকে পালি বিভাগের প্রভাষক পদে নিয়োগের জন্য ভাইভা বোর্ডে সর্বোচ্চ সুপারিশ করা হয়েছে। এ বিষয়ে বিভাগীয় সভাপতির নোট অব ডিসেন্ট (দ্বিমত পোষণ) ও পরিকল্পনা কমিটির মতামত আমলে নেওয়া হয়নি। ধারণা করা হচ্ছে, আগামীকাল শুক্রবার অনুষ্ঠিতব্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫৪৪তম সিন্ডিকেট সভায় এ নিয়োগ চূড়ান্ত হবে। এদিকে প্রক্টর পত্নীর নিয়োগ নিয়ে পুরো বিশ্ববিদ্যালয়ে চলছে আলোচনা-সমালোচনা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, উপাচার্যের চার বছর মেয়াদ শেষ হতে চলেছে। তাই, অসম্পূর্ণ নিয়োগগুলো দ্রুত বাস্তবায়নে মরিয়া হয়ে উঠেছেন প্রশাসনপন্থিরা। এরই ধারাবাহিকতায় স্ত্রী অভি বড়ুয়াকে বিধিবহির্ভূত শিক্ষক পদে নিয়োগদানে অপচেষ্টা করছেন উপাচার্যের আস্থাভাজন সহকারী প্রক্টর। ওই প্রার্থী ২০০৩ সালে শিক্ষাজীবন শেষ করলেও গত ২০ বছরে তার চাকরির অভিজ্ঞতা, উচ্চতর ডিগ্রি বা প্রকাশনা নেই।
জানা গেছে, বিভাগীয় পরিকল্পনা কমিটি থেকে বাদ পড়া, ভাইভা পরীক্ষায় যথাযথ প্রশ্নের উত্তর দিতে না পারা এবং বিভাগের সভাপতি ও নিয়োগ বোর্ড সদস্যের নোট অব ডিসেন্ট তোয়াক্কা না করেই গত ১৩ মার্চ উপাচার্য অধ্যাপক ড. শিরীণ আখতারের উপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত ভাইভা বোর্ডে অভি বড়ুয়াকে নিয়োগে সর্বোচ্চ সুপারিশ করা হয়। নিয়মানুযায়ী স্থায়ী ও অস্থায়ী পদে দুজন প্রভাষক নিয়োগের কথা থাকলেও বিজ্ঞাপিত পদের বাইরে অতিরিক্ত আরও দুজনকে সুপারিশ করেছে বোর্ড, যা ইউজিসির নির্দেশনা ও বিশ্ববিদ্যালয় সংবিধির পরিপন্থি। এ কারণে গত ৮ এপ্রিল অন্যায়ভাবে শিক্ষক নিয়োগের অভিযোগ তুলে চবি উপাচার্য ও রেজিস্ট্রারকে প্রার্থী সজীব সিংহ ও বোধি মিত্র শ্রামনের পক্ষে লিগ্যাল নোটিশ পাঠিয়েছেন সুপ্রিম কোর্ট ও চট্টগ্রাম জজকোর্টের আইনজীবী মোহাম্মদ রাসেল।
বিভাগীয় সভাপতির ‘নোট অব ডিসেন্ট’: নানা অসংগতি ও বিজ্ঞাপিত পদের অতিরিক্ত নিয়োগের বিষয়ে ‘নোট অব ডিসেন্ট’ বা দ্বিমত পোষণ করেন বোর্ডের সদস্য ও পালি বিভাগের সভাপতি শাসনানন্দ বড়ুয়া রুপন। তা সত্ত্বেও উপাচার্যের উপস্থিতিতে অভি বড়ুয়াকে নিয়োগের জন্য সুপারিশকৃত চার প্রার্থীর মধ্যে সবার প্রথমেই রাখা হয়।
নিয়োগ বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, ওই নিয়োগ বোর্ডের সদস্য ছিলেন চারজন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পালি বিভাগের অধ্যাপক ড. দিলীপ কুমার বড়ুয়া, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পালি বিভাগের অধ্যাপক ড. জ্ঞান রত্ন শ্রমণ। এ ছাড়া পদাধিকার বলে নিয়োগ বোর্ডের সদস্য ছিলেন উপাচার্য অধ্যাপক ড. শিরীণ আখতার ও পালি বিভাগের সভাপতি শাসনানন্দ বড়ুয়া রুপন।
সভাপতি শাসনানন্দ বড়ুয়া বলেন, অভি বড়ুয়ার স্নাতক ও স্নাতকোত্তরের ফলাফল অন্যান্য প্রার্থীর তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে কম। এ ছাড়া বিভাগীয় পরিকল্পনা কমিটি সুপারিশ না করায়, নির্বাচনী বোর্ডে অসন্তোষজনক পারফর্ম করায় প্রভাষক পদে তাকে সুপারিশের ক্ষেত্রে দ্বিমত পোষণ করেছি।
পরিকল্পনা কমিটি থেকে বাদ পড়া:
বিভাগীয় সূত্র বলছে, নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পর গত বছরের ৩ মার্চ পালি বিভাগের তৎকালীন সভাপতি অধ্যাপক ড. জ্ঞান রত্ন শ্রমণ পরিকল্পনা কমিটির সভা আহ্বান করেন। অভি বড়ুয়া তার আবেদনে এমএ পরীক্ষায় প্রথম হয়েছেন বলে অসত্য তথ্য প্রদান করলেও দৃষ্টি এড়িয়ে যাওয়ায় তার আবেদনটি সুপারিশ করা হয়। দ্বিতীয় পর্যায়ে একই বছর ২৪ আগস্ট সহযোগী অধ্যাপক এর বিপরীতে একটি অস্থায়ী পদে প্রভাষক নিয়োগের জন্য আরেকটি বিজ্ঞাপন প্রকাশ করলে ২৭ জন ওই পদের জন্য আবেদন করেন।
নিয়মানুযায়ী সভাপতি শাসনানন্দ বড়ুয়া রুপন গত ৬ নভেম্বর পরিকল্পনা কমিটির সভা আহ্বান করেন। সভায় ২৭টি আবেদন যাচাই-বাছাই করে ২১টি গৃহীত হয়। আবেদনকারী অভি বড়ুয়া ও সুরভী বড়ুয়ার আবেদনপত্র তথা ফলাফল সংক্রান্ত অসত্য তথ্য দেওয়ায় জালিয়াতি হিসেবে চিহ্নিত হওয়ায় সুপারিশ না করার সিদ্ধান্ত হয়।
এদিকে বিভাগীয় পরিকল্পনা কমিটির সিদ্ধান্ত গোপনীয় হলেও প্রার্থী অরূপ বড়ুয়ার স্ত্রী হওয়ায় তার আবেদন সুপারিশ না করার সিদ্ধান্তটি জেনে যান। এ অবস্থায় সংশোধনী আবেদন করে অভি বড়ুয়া। কিন্তু বিভাগীয় পরিকল্পনা কমিটির সভায় তা সুপারিশ করা হয়নি।
অধ্যাপক শাসনানন্দ বড়ুয়া বলেন, তথ্য গোপন করা আবেদনকারী হলেন অভি বড়ুয়া। তাই বিভাগীয় পরিকল্পনা কমিটি তার আবেদনপত্রটি বাতিল করে।
আবেদনের শর্তাবলি পূরণ না করা:
মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকে শতকরা হিসেবে প্রাপ্ত নম্বর উল্লেখ করার শর্ত থাকলেও শিক্ষক নিয়োগ আবেদনে তিনি তা উল্লেখ করেননি। বিশ্ববিদ্যালয় বিধি অনুসারে, অসম্পূর্ণ ও ত্রুটিপূর্ণ দরখাস্ত সরাসরি বাতিলযোগ্য। তাই, সিদ্ধান্তটি প্রশাসনের অবগতির জন্য পাঠানো হয়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিভাগের কয়েকজন শিক্ষক কালবেলাকে বলেন, এ ধরনের অযোগ্য প্রার্থীকে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দিলে একাডেমিক কার্যক্রম ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক আব্দুল হক কালবেলাকে বলেন, প্রার্থী যদি আবেদনপত্রে অসত্য তথ্য দেন বা তথ্য গোপন করেন, তাহলে বিশ্ববিদ্যালয় অ্যাক্ট অনুযায়ী তাকে নিয়োগ দেওয়ার সুযোগ নেই, বরং নিয়োগ পেয়ে গেলেও তাকে বরখাস্ত করার নিয়ম আছে।
গত ২০ বছরে চাকরির অভিজ্ঞতা না থাকা: বিভাগীয় পরিকল্পনা কমিটি সূত্রে জানা গেছে, ৩৮ আবেদনকারীর মধ্যে স্নাতকের ফলাফলে অভি বড়ুয়া ২৬তম এবং স্নাতকোত্তরে ১৩তম অবস্থানে। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকে ৫০ দশমিক ২ শতাংশ নম্বর পেয়ে দ্বিতীয় বিভাগে উত্তীর্ণ হন তিনি। স্নাতক পরীক্ষায় ৩ দশমিক ৪৩ পেয়েছিলেন।
জ্যেষ্ঠ শিক্ষকরা বলছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যান্য বিভাগে এরূপ ফলাফলধারী শিক্ষকতার জন্য আবেদনের যোগ্যতাও রাখে না।
বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক মে. জাকির হোসেন কালবেলাকে বলেন, প্রথমত অধিকতর কম যোগ্য প্রার্থীকে বিশ্ববিদ্যালয় নিয়মানুযায়ী নিয়োগ দেওয়ার সুযোগ নেই। দ্বিতীয়ত, কেউ যদি অসত্য তথ্য দেয় এবং অনিয়মের আশ্রয় নেয়, এটা ফৌজদারি অপরাধ। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক বেনু কুমার দে বলেন, এটা খুবই কনফিডেনশিয়াল (গোপনীয়)। এ বিষয়ে কিছু বলতে পারব না।
উপাচার্য ও রেজিস্ট্রারকে লিগ্যাল নোটিশ: অন্যায়ভাবে শিক্ষক নিয়োগের অভিযোগ তুলে গত ৮ এপ্রিল চবি উপাচার্য অধ্যাপক ড. শিরীণ আখতার ও রেজিস্ট্রার কে এম নূর আহমেদকে প্রার্থী সজীব সিংহ ও বোধি মিত্র শ্রামনের পক্ষে লিগ্যাল নোটিশ পাঠিয়েছেন সুপ্রিম কোর্ট ও চট্টগ্রাম জজকোর্টের আইনজীবী মোহাম্মদ রাসেল। এ ছাড়া ওই নিয়োগ প্রক্রিয়াকে বাতিল করে যথাযথ প্রার্থীকে নিয়োগ না দিলে পরবর্তী সময়ে আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার হুঁশিয়ারি নোটিশে দেওয়া হয়।
আইনজীবী মোহাম্মদ রাসেল বলেন, আমার মক্কেলরা চবির পালি বিভাগের প্রভাষক পদে নিয়োগ পেতে যোগ্যতার শর্তাবলি পূরণ করে মৌখিক পরীক্ষায়ও মেধার স্বাক্ষর রেখেছেন। তা সত্ত্বেও অযোগ্য প্রার্থীকে নিয়োগ দেওয়ার অপচেষ্টা বিধায় আমার মক্কেলরা লিগ্যাল নোটিশের মাধ্যমে উল্লিখিত নিয়োগ প্রক্রিয়া বাতিল করে যথাযথ প্রার্থীদের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার জন্য বিনীত আবেদন জানাচ্ছে। অন্যথায় আমার মক্কেলরা যথাযথ আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বাধ্য হবে।
বিজ্ঞাপিত পদের অতিরিক্ত নিয়োগ: রেজিস্ট্রার অফিসের তথ্যমতে, গত বছরের ২৫ জানুয়ারি প্রকাশিত বিজ্ঞপ্তিতে পালি বিভাগে সহযোগী অধ্যাপকের বিপরীতে একটি স্থায়ী প্রভাষক পদে নিয়োগের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন পত্রিকায় বিজ্ঞাপন প্রকাশ করে। তারই আলোকে ওই পদের জন্য ৩৮ প্রার্থী আবেদন করেন।
এরপর দ্বিতীয় পর্যায়ে একই বছর ২৪ আগস্ট সহযোগী অধ্যাপকের বিপরীতে একটি অস্থায়ী পদে প্রভাষক নিয়োগের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন নতুন করে আরেকটি বিজ্ঞাপন প্রকাশন করে। বিজ্ঞাপনের আলোকে ২৭ জন ওই পদের জন্য আবেদন করেন।
নিয়মানুযায়ী স্থায়ী ও অস্থায়ী পদে দুজন প্রভাষক নিয়োগের কথা থাকলেও বিজ্ঞাপিত পদের অতিরিক্ত আরও দুই প্রার্থীকে সুপারিশ করে নিয়োগ বোর্ড, যা ইউজিসির নির্দেশনা ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় সংবিধির সম্পূর্ণ পরিপন্থি বলে মন্তব্য করেছেন বিভাগের সভাপতি শাসনানন্দ বড়ুয়া।
চবির হলুদ দলের আহ্বায়ক অধ্যাপক ড. মো. সেকান্দর চৌধুরী বলেন, বিজ্ঞাপিত পদের অতিরিক্ত নিয়োগ বিশ্ববিদ্যালয় স্পিরিটের সম্পূর্ণ বিরোধী। এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ড. মুস্তাফিজুর রহমান ছিদ্দিকী বলেন, সংবাদ মাধ্যমের বরাতে আমরা যতটুকু জেনেছি, তাতে এ রকম অযোগ্য প্রার্থীকে বিধিবহির্ভূত নিয়োগ দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। আশা করছি, বিজ্ঞ সিন্ডিকেট স্বচ্ছতা বজায় রাখবেন।
বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেট সদস্য অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আবুল মনছুর বলেন, নিয়োগের জন্য যে কেউ আবেদন করতেই পারে। তবে, সে যোগ্য কি না, সেটা প্রশ্ন।
ইউজিসি সদস্য অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আবু তাহের বলেন, ৭৩-এর অ্যাক্ট ও বিশ্ববিদ্যালয় সংবিধি অনুযায়ী শিক্ষক নিয়োগ না হলে তদন্ত সাপেক্ষে ইউজিসি ব্যবস্থা নেবে। নিয়মবহির্ভূত নিয়োগ প্রমাণিত হলে জড়িতদের নিয়মানুযায়ী শাস্তির আওতায় আনা হবে।
মন্তব্য করুন