রাফসান জানি
প্রকাশ : ০৫ এপ্রিল ২০২৪, ০৩:১৪ এএম
আপডেট : ০৫ এপ্রিল ২০২৪, ০৮:৩৭ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

পাহাড় নিয়ে নতুন দুশ্চিন্তা

ফের সেনা মোতায়েনের পরামর্শ
ছবি : সংগৃহীত
ছবি : সংগৃহীত

শান্তি আলোচনা চলাকালেই দুটি ব্যাংকের তিনটি শাখায় হামলা হয়েছে। টাকা ও অস্ত্র লুট করার পাশাপাশি অপহরণ করা হয় একটি শাখার ম্যানেজারকে। পাহাড়ি সশস্ত্র সংগঠন কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টকে (কেএনএফ) এ ঘটনায় দায়ী করছে সরকার। তারা বান্দরবানের ৯টি উপজেলা নিয়ে স্বায়ত্তশাসনের দাবি করে আসছে। কেএনএফ এই হামলা ও অপহরণের মধ্য দিয়ে যতটা না টাকা-অস্ত্র লুট করতে চেয়েছে, তার চেয়ে বেশি নিজেদের অবস্থান ও সক্ষমতার জানান দিতে চেয়েছে বলে মনে করছেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা বলছেন, পাহাড়ে এই হামলা সূক্ষ্ম পরিকল্পনার মাধ্যমে বাস্তবায়ন করেছে কেএনএফ। পুরোপুরি সফল হতে না পারলেও নিজেদের আবার আলোচনায় আনতে পেরেছে তারা, যা নতুন করে দুশ্চিন্তার কারণ হতে পারে। এই হামলার আগাম তথ্য কারও কাছে না থাকাকে চরম গোয়েন্দা ব্যর্থতা বলছেন নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা। পাহাড়ে যাদের অপারেশনাল সক্ষমতা রয়েছে, তাদের হাতেই আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব দেওয়ার দাবি উঠছে। পাহাড়ের নিরাপত্তা বিষয়ে এক্সপার্টরা বান্দরবানে জড়ো হচ্ছেন বলে জানা গেছে।

ব্যাংক ডাকাতির ঘটনায় কেএনএফের সঙ্গে সব ধরনের আলোচনা বন্ধের ঘোষণা দিয়েছে শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটি। হামলাকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার হুঁশিয়ারি দিয়েছে সরকার। এদিকে, গতকাল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় সোনালী ব্যাংকের রুমা শাখার ম্যানেজার নেজাম উদ্দিনকে উদ্ধার করে র‌্যাব। পুলিশ ও আনসারের লুণ্ঠিত অস্ত্র উদ্ধারে অভিযানের কথা জানিয়েছেন পুলিশের চট্টগ্রাম রেঞ্চ ডিআইজি নুরে আলম মিনা।

গত মঙ্গলবার রাতে রুমা শহরে বিদ্যুৎ সংযোগ বন্ধ করে সোনালী ব্যাংকের শাখায় হামলা চালায় অস্ত্রধারী কেএনএফ সদস্যরা। মসজিদ থেকে রুমা শাখার ম্যানেজার নেজাম উদ্দীন ধরে ব্যাংকে নিয়ে যায় তারা। অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে মুসল্লিদের। ব্যাংক ম্যানেজারের মাধ্যমে ভল্টের টাকা নেওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু ম্যানেজারের চতুরায় তা পারেনি অস্ত্রধারীরা। তবে ওই এলাকায় নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা পুলিশ ও আনসার সদস্যদের অস্ত্র নিয়ে যায় কেএনএফ সদস্যরা। সঙ্গে অপহরণ করে নেজাম উদ্দীনকে। পরদিন দুপুরে থানচিতে দুটি ব্যাংকের শাখায় হানা দিয়ে কয়েক লাখ টাকা লুটে নেয় তারা। বান্দরবান পুলিশ জানিয়েছে, হামলাকারীরা দুটি এসএমজি ও এর ৬০টি গুলি, ৮টি চীনা রাইফেল ও ৩২০টি গুলি, ৪টি শটগান ও ৩৫টি কার্তুজ নিয়ে গেছে।

ব্যাংক লুটে জড়িতদের কঠোর শাস্তির হুঁশিয়ারি দিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল গতকাল বলেন, আমরা দেখছি, ব্যবস্থা নিচ্ছি। সব কিছুই করব, আগে সব কিছু জেনে নিচ্ছি। এর পেছনে কারা আছে, কোনো উদ্দেশ্য আছে কি না, কোনো ধরনের নাশকতা কিংবা কোনো পরিকল্পনা আছে কি না—এগুলো দেখে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেব। আমরা কোনো ছাড় দেব না। কঠিন ব্যবস্থা নেব।

এখানে ভূ-রাজনৈতিক কোনো ব্যাপার আছে কি না জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, আমাদের কাছে এখনো এ ধরনের কোনো তথ্য নেই। অনেক কিছুই হতে পারে কিন্তু না জেনে, তথ্য না পেয়ে আমরা বলতে পারছি না।

পরপর দুদিন ব্যাংকের হামলা, অস্ত্র-টাকা লুট ও ম্যানেজার অপহরণের পর কেএনএফের সঙ্গে সব ধরনের আলোচনা বন্ধ ঘোষণা করেছে জেলা পরিষদের শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটি। গতকাল সকালে শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটির সদস্যরা এক সংবাদ সম্মেলনে এ ঘোষণা দেন। এর আগে বুধবার শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটি এক জরুরি সভা আহ্বান করে। সভায় নেওয়া সিদ্ধান্ত তুলে ধরার জন্য সংবাদ সম্মেলন করা হয়।

কেএনএফের সদস্যদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার জন্য ২০২৩ সালের ২৯ মে জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ক্যশৈহ্লা মারমার নেতৃত্বে শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির সঙ্গে কেএনএফের কয়েক দফা অনলাইনে ও দুই দফা সশরীর বৈঠক হয়েছে। গত বছরের ৫ নভেম্বর ও গত ৫ মার্চ অনুষ্ঠিত সশরীর দুই দফা বৈঠকে দুটি সমঝোতা স্মারকও সই হয়। এতে তারা চাঁদাবাজি, অপহরণ, লুটপাটসহ সব ধরনের সন্ত্রাসী তৎপরতা বন্ধের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল; কিন্তু প্রতিশ্রুতির পর তারা রুমা ও থানচিতে সোনালী ও কৃষি ব্যাংকে ডাকাতি করে। কমিটি মনে করে, তাদের অতিসাম্প্রতিক ঘটনায় শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটির শান্তি আলোচনা বৈঠকসহ সব ধরনের কার্যক্রম প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। এ অবস্থায় শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটি কেএনএফের সঙ্গে কোনো ধরনের বৈঠক করবে না।

কেএনএফ প্রথম আলোচনায় আসে ২০২২ সালের জুন মাসে। তাদের হাতে রাঙামাটির বিলাইছড়িতে ৩ জন নিহত হন। এরপর একের পর এক হত্যা, লুট, অপহরণে নাম আসে কেএনএফের। শুধু ২০২৩ সালেই ৬ সেনা সদস্যসহ ২০ জনের বেশি তাদের গুলিতে প্রাণ হারান। অপহরণের ঘটনা ঘটছিল নিয়মিত। এরই মধ্যে নতুন জঙ্গি সংগঠন জামা’আতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়াকে টাকার বিনিময়ে পার্বত্য এলাকায় আশ্রয়, অস্ত্র সরবরাহ ও প্রশিক্ষণের অভিযোগ ওঠে কেএনএফের বিরুদ্ধে। এই প্রশিক্ষণের জন্য তারা তিন বছর মেয়াদি চুক্তি করেছিল।

র্যাবের মুখপাত্র কমান্ডার খন্দকার আল-মঈন জানান, জঙ্গিরা পাহাড়ে আশ্রয় নিয়ে প্রশিক্ষণ নিচ্ছে বিষয়টি জানতে পারার পর আমরা সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় অভিযান শুরু করি। ধারাবাহিক অভিযানে তাদের ট্রেনিং সেন্টার শনাক্ত, বিপুল পরিমাণ অস্ত্রসহ শতাধিক জঙ্গি সংগঠনের সদস্য ও কুকি-চিনের ২০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। আমাদের অভিযানের ফলে অনেকটা কোণঠাসা ছিল। সাম্প্রতিক সময়ে শান্তি কমিটি গঠন করা হয়। তাদের সঙ্গে শান্তি আলোচনা চলছিল। এ কারণে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কুকি-চিনের বিরুদ্ধে অভিযান বন্ধ রাখে।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সূত্রগুলো বলছে, কেএনএফেএর নেতৃত্ব দিচ্ছেন নাথান লনচও বম। তার বাড়ি রুমার ইডন বমপাড়া। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছেন। ছাত্রাবস্থায় পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয় জীবন শেষে ২০০৮ সালে কুকি-চিন ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (কেএনডিও) নামে একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। ২০১৯ সালের দিকে এই নাম পাল্টে করা হয় কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট। সংগঠনটি রাঙামাটি ও বান্দরবানের যে ৯টি উপজেলা নিয়ে স্বায়ত্তশাসিত রাজ্য গঠনের ঘোষণা দিয়েছে, এর মধ্যে আছে বান্দরবানের রুমা, থানচি, লামা, রোয়াংছড়ি ও আলীকদম উপজেলা; রাঙামাটির সাজেক উপত্যকা, বাঘাইছড়ি, বরকল, জুরাছড়ি ও বিলাইছড়ি উপজেলা। তাদের ঘোষিত রাজ্যে ৫ সম্প্রদায়ের লোকজন বসবাস করতে পারবে। তারা হলো বম, খুমি, খিয়াং, পাংখোয়া ও লুসাই। সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, পাহাড়ে এই পাঁচ সম্প্রদায়ের লোকসংখ্যা ২৫ হাজারের বেশি। কেএনএফের সশস্ত্র সদস্য হাজারের বেশি।

ব্যাংক তথা বান্দরবানের ওই এলাকাগুলোতে নিরাপত্তার চরম ঘাটতি ছিল বলে মনে করেন নিরাপত্তা বিশ্লেষক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন। তিনি কালবেলাকে বলেন, নিরাপত্তা ব্যবস্থা ভালো থাকলে এমনটা হতো না। নিরাপত্তা বলতে কিছুই নেই। পুলিশ তো এই ধরনের এলাকায় নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য বিশেষায়িতভাবে প্রশিক্ষিত নয়। কুকি-চিনের উদ্ভব যেখানে হয়েছে, সেখানে দাঁড় করিয়ে দিলেই নিরাপত্তা হয় না। আমি নিজে ওই এলাকায় দায়িত্ব পালন করেছি। সেনাবাহিনীকে উঠিয়ে আনার পর পুলিশ-র্যাব দিয়ে নিরাপত্তা দেওয়া যাচ্ছে না। তারা যে বিষয়ে পারদর্শী, এটা সেই কাজ নয়। উপজেলা শহরে সন্ধ্যায় লাইট বন্ধ করে হামলা করেছে। তাহলে সেটা পুলিশ টের পায়নি কেন। নিরাপত্তা ব্যবস্থা সঠিক থাকলে গোলাগুলি হতো, এত সহজে সন্ত্রাসীরা তাদের কাজ করে চলে যেতে পারত না।

পাহাড়ে নিজের অভিজ্ঞতা উল্লেখ করে তিনি বলেন, সামরিক বাহিনী যখন মোতায়েন ছিল, তখন এসব এলাকায় সব সময় সেনাবাহিনী থাকত, কমিউনিটি পেট্রোলিং থাকত। বহু বছর ওখানে থাকার কারণে আমরা গ্রাউন্ড থেকে তথ্য পেতাম। কার ছেলে কোথায় আছে, কী করছে, কার মুভমেন্ট সন্দেহজনক, সব তথ্য আমরা পেতাম। আমাদের গ্রাউন্ড লেভেলে স্ট্রং ইন্টেল ছিল।

কে এন এফ এই হামলাকে নতুন করে দুশ্চিন্তার কারণ হতে পারে বলে মনে করছেন তিনি। বান্দরবানের এই এলাকাগুলোতে সার্বক্ষণিক নজরদারির দরকার। সেজন্য সেনাবাহিনী মোতায়েন করা দরকার বলে জানান তিনি। সাবেক এই সেনা কর্মকর্তা বলেন, সার্বক্ষণিক নজরদারির জন্য যা যা করার দরকার তাই সরকারকে করতে হবে। তারা যে রাস্তায় আসে, সেই রাস্তায় যায় না। ফলে সেভাবে প্রস্তুতি রাখা লাগবে। এই ধরনের পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য সেনাবাহিনীর বিকল্প নেই। আশপাশে কয়েকটি জায়গায় ক্যান্টনমেন্ট আছে। সেনাবাহিনী এই এলাকায় কাজ করে অভ্যস্ত। ফলে এখানে তাদের কাজ করা সহজ।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

নারায়ণগঞ্জে কিশোরীকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণ, গ্রেপ্তার ৪

গোরস্থান, মাদ্রাসার দান বাক্স ভেঙে চুরি

‘শরীফ থেকে শরীফার গল্প’ বাদ দেওয়ার সুপারিশে এইচআরএফবি’র প্রতিবাদ

পলাশ ও এন্ড্রু কিশোরের ফিরিয়ে দেওয়া গান গেয়েই আসিফের বাজিমাত

রাইসির মৃত্যুতে শি’র মাতম

কর অঞ্চল-১৭, ঢাকায় ১০১ জনের বড় নিয়োগ

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে মাউশির ৯ নির্দেশনা

রাইসির মৃত্যুতে রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দিনের শোক

গভর্নর, ডেপুটি গভর্নরদের সব প্রোগ্রাম বর্জন / প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার না করলে কঠোর আন্দোলনের হুঁশিয়ারি

সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ গেল দুই মোটরসাইকেল আরোহীর

১০

সাভারে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত স্ত্রী, হাসপাতালে পুলিশ কর্মকর্তা

১১

ইরানের ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্রমন্ত্রীর নাম ঘোষণা

১২

খেলাধুলা-সংস্কৃতিতে দক্ষরাই বিশেষ মেধাসম্পন্ন : জবি উপাচার্য 

১৩

চেয়ারম্যান প্রার্থী রিয়াজকে ইসিতে সশরীরে তলব, প্রার্থিতা বাতিলের শঙ্কা

১৪

বজ্রপাতে রানওয়ের ক্ষতি, নামতে পারেনি বিমানের ফ্লাইট

১৫

ভদ্রতা দেখাব সর্বোচ্চ, আইনের প্রয়োগ হবে শতভাগ : এসপি সাতক্ষীরা 

১৬

ভাতিজার হাতে চাচা খুন, মামলা দায়ের

১৭

কুঁচিয়া বিক্রি করে সংসার চালান খোকন

১৮

আ.লীগ নেতার অন্তরঙ্গ ভিডিও ভাইরাল

১৯

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরির সুযোগ, আবেদন ফি ৩০০

২০
X