আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে রাজনৈতিক পরিস্থিতি আরও জটিল হচ্ছে। পূর্বঘোষিত একদফা আন্দোলনের প্রথম কর্মসূচি নিয়ে আগামীকাল মঙ্গলবার থেকে ঢাকা মহানগরীতে দীর্ঘ পদযাত্রা নিয়ে আবারও মাঠে নামছে বিএনপি। অন্যদিকে, একই সময়ে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ শান্তি সমাবেশ ও উন্নয়ন যাত্রা নিয়ে থাকবে রাজপথে। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের মতে, নির্বাচনী ইস্যুতে যে কোনো ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি এড়াতে বড় দুই রাজনৈতিক দলকেই এগিয়ে আসতে হবে। এদিকে সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের বেসামরিক নিরাপত্তা, গণতন্ত্র ও মানবাধিকারবিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি আজরা জেয়ার নেতৃত্বে উচ্চপর্যায়ের একটি প্রতিনিধিদল চার দিনের ঢাকা সফর করেছে। বাংলাদেশের আসন্ন নির্বাচন ও মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে তারা সরকারের সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলোচনা করেছেন। একই সময়ের মধ্যে বাংলাদেশ সফর করছেন ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) প্রাক-নির্বাচনী প্রতিনিধিদল।
জানা যায়, বিদেশি এ কূটনীতিকদের নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে ভিন্ন ভিন্নভাবে অনড় অবস্থানের কথা জানিয়েছে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। উভয় দলই একদফা দাবিতে পৃথক কর্মসূচি নিয়ে রাজপথে আরও সক্রিয় হওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। এ ক্ষেত্রে নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি আদায়ে বিএনপির মনোযোগ এখন আন্দোলনে। আর ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগও বিরোধীদের আন্দোলনকে রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলার পাশাপাশি নির্বাচনের প্রস্তুতিও নিচ্ছে বলে প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে কথা বলে এমনই জানা গেছে।
একদফা দাবিতে আন্দোলনে অনড় বিএনপি : সরকারের পদত্যাগের দাবিতে গত বুধবার পূর্বঘোষণা মোতাবেক ব্যাপক শোডাউনের মাধ্যমে একদফা আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। এ একদফা দাবি আদায়ের লক্ষ্যে আন্দোলনেই অনড় বিএনপি। নতুন কর্মসূচি হিসেবে আগামীকাল মঙ্গলবার ও বুধবার ঢাকা মহানগরীসহ সারা দেশে মহানগরী ও জেলা পর্যায়ে পদযাত্রা করবে বিএনপি। এ কর্মসূচির বাইরে দলের অঙ্গসংগঠনের ঘোষিত তারুণ্যের সমাবেশ ও পদযাত্রা কর্মসূচিও চলবে। একইভাবে যুগপতের শরিক অন্যান্য দল ও জোটের পক্ষেও পৃথকভাবে একদফা আন্দোলনের নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়েছে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আব্দুল মঈন খান কালবেলাকে বলেন, গণতন্ত্রে বিশ্বাসী কূটনীতিকদের উপস্থিতিতেই দেশের একাধিক স্থানে বিএনপির নেতাকর্মীদের ওপর আওয়ামী লীগ সন্ত্রাসী হামলা করেছে। এটা তাদের চরিত্রের বহিঃপ্রকাশ। আমার মনে হয়, এটা তারা নির্বাচন পর্যন্ত করতে পারে। কেননা তারা ভিন্নমতকে সহ্য করে না। অতীতেও তারা একদলীয় বাকশাল প্রতিষ্ঠা করেছিল। তবে জনগণের আন্দোলনের শক্তির কাছে কোনো অপশক্তি দাঁড়াতে পারে না।
বিএনপিকে মাইকিং বন্ধের আদেশ ডিএমপির : এদিকে বিএনপিকে তাদের কর্মসূচির প্রচারে মাইকিং করা থেকে বিরত থাকতে বলেছে ডিএমপি। কারণ হিসেবে পুলিশের পক্ষ থেকে জনসাধারণের বিরক্তি ও শব্দদূষণ রোধের বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে। কাল মঙ্গলবার ও বুধবার পদযাত্রা কর্মসূচির প্রচারে জন্য ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপি ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে মাইকিং করার অনুমতি চেয়ে ডিএমপিতে আবেদন করেছিল। পরে সেই চিঠির জবাবে ডিএমপি জানিয়েছে, ঢাকা মহানগরী পুলিশ অধ্যাদেশ ১৯৭৬-এর ৩১ বিধি অনুযায়ী মহানগরীর জনসাধারণের বিরক্তিসহ শব্দদূষণ রোধ করতে মাইক্রোফোন, লাউড স্পিকার বা অন্য কোনো শব্দ জোরদার করার জন্য ব্যবহৃত যন্ত্র (মাইকিং) নিষিদ্ধ, সীমিত ও নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা ডিএমপি কমিশনারের রয়েছে। ওই বিধি অনুযায়ী জনসাধারণের বিরক্তিসহ শব্দদূষণ রোধ করতে মাইকিং করা থেকে বিরত থাকার জন্য বলা হলো।
রাজধানীতে পদযাত্রার রোডম্যাপ : গতকাল বিএনপির এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে, মঙ্গলবার গাবতলী থেকে রায়সাহেব বাজার মোড় (বাহাদুর শাহ পার্ক) পর্যন্ত পদযাত্রা হবে। সকাল ১০টায় গাবতলী থেকে শুরু করবে ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপি। পরে মগবাজারে যুক্ত হবে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপি। পদযাত্রাটি গাবতলী-টেকনিক্যাল মোড়-মিরপুর-১-মিরপুর-১০ গোলচত্বর-কাজীপাড়া-শেওড়াপাড়া-তালতলা (আগারগাঁও)-বিজয় সরণি-কারওয়ান বাজার-এফডিসি-মগবাজার-মালিবাগ-কাকরাইল-নয়াপল্টন (পার্টি অফিস)-ফকিরাপুল-মতিঝিল (শাপলা চত্বর)-ইত্তেফাক মোড়-দয়াগঞ্জ হয়ে রায়সাহেব বাজার মোড়ে গিয়ে শেষ হবে বিকেল ৪টায়। একই দাবিতে পরদিন বুধবার উত্তরার আব্দুল্লাহপুর থেকে যাত্রাবাড়ী (চৌরাস্তা) পর্যন্ত হবে পদযাত্রা কর্মসূচি। সকাল ১০টায় আব্দুল্লাহপুর থেকে ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপি যাত্রা করবে। পরে রামপুরা ব্রিজে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপি যুক্ত হবে। পদযাত্রাটি আব্দুল্লাহপুর-বিমানবন্দর-কুড়িল বিশ্বরোড-নতুন বাজার-বাড্ডা-রামপুরা ব্রিজ-আবুল হোটেল-খিলগাঁও-বাসাবো-মুগদাপাড়া-সায়েদাবাদ-যাত্রাবাড়ী (চৌরাস্তা) গিয়ে শেষ হবে বিকেল ৪টায়। এ ছাড়া আগামীকাল সারা দেশের সব জেলা ও মহানগরীতে সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত পদযাত্রা অনুষ্ঠিত হবে।
এদিকে পদযাত্রা এবং ২২ জুলাই তারুণ্যের সমাবেশ করা নিয়ে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনারের সঙ্গে বৈঠক করেছে বিএনপির প্রতিনিধিদল। কর্মসূচি পালনের মৌখিক অনুমতি দিয়েছে ডিএমপি। বিএনপি প্রতিনিধিদলে ছিলেন প্রচার সম্পাদক শহীদ উদ্দীন চৌধুরী এ্যানি, সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট আব্দুস সালাম আজাদ ও ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির সদস্যসচিব আমিনুল হক। পরে শহীদ উদ্দীন চৌধুরী এ্যানি বলেন, পুলিশ আমাদের কর্মসূচিতে সহযোগিতা করবে বলে জানিয়েছে। এখানে অনুমতির খুব একটা প্রয়োজন পড়ে না।
হামলা-মামলা থেমে নেই : এদিকে বাংলাদেশ সফরে আসা বিদেশি কূটনীতিকদের উপস্থিতির মধ্যেই দেশের বিভিন্ন জায়গায় বিএনপির কর্মসূচিতে ক্ষমতাসীন দলের বিরুদ্ধে হামলা ও আক্রমণের অভিযোগ উঠেছে। গত শুক্রবার নোয়াখালীতে বিএনপির পাঁচটি অঙ্গসংগঠনের যৌথ উদ্যোগে পদযাত্রা কর্মসূচি ছিল। সেখানে অংশ নিতে কুমিল্লার মুরাদনগরের সহস্রাধিক নেতাকর্মী ৬৫টি গাড়িবহর নিয়ে নোয়াখালীতে যাচ্ছিলেন। পথিমধ্যে কুমিল্লার লাকসামে স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা গাড়িবহরে হামলা চালিয়ে ৩০টি গাড়ি ভাঙচুর ও ৫৪ জনকে আহত করে। ১৩ জুলাই সন্ধ্যায় ঝিনাইদহে এক যুবদল নেতার হাতের কবজি ও পায়ের গোড়ালি বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়। জানা গেছে, ঝিনাইদহ সদরের পাগলাকানাই ইউনিয়ন যুবদলের সাধারণ সম্পাদক ও জেলা যুবদলের সদস্য লিটন মণ্ডল শহর থেকে বাড়ি ফিরছিলেন। এ সময় পাগলাকানাই ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের নেতা আবু সাইদ বিশ্বাসের নেতৃত্বে একদল সন্ত্রাসী লিটন মণ্ডলকে হত্যার উদ্দেশ্যে আক্রমণ করে। ধারালো অস্ত্র দিয়ে তার একটি হাত শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন করে, আরেকটি হাত ও একটি পা কেটে ঝুলন্ত অবস্থায় মৃত ভেবে ফেলে রেখে পালিয়ে যায়। এ ঘটনায় ১৩ জনকে আসামি করে মামলা হয়েছে। এ ছাড়া নারায়ণগঞ্জ, নোয়াখালী, ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, খুলনাসহ বিভিন্ন স্থানে বিএনপি নেতাকর্মীদের ওপর হামলা-মামলা অব্যাহত রয়েছে বলে বিএনপির অভিযোগ। গত ২৩ মে থেকে গত শনিবার পর্যন্ত বিএনপির নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মোট মামলা হয় ৩০০টি, মোট গ্রেপ্তার ১ হাজার জন এবং মোট আসামি প্রায় ১০ হাজার ৩০০ জন।
বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, শেখ হাসিনা ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য মরিয়া। সেজন্য তিনি ‘পোড়ামাটি নীতি’ অবলম্বন করেছেন। এই অবৈধ সরকারের পদত্যাগের জন্য আজ ছাত্র-শিক্ষক, শ্রমিকসহ গোটা দেশের মানুষ ফুঁসে উঠেছে। তাদের পতনের কাউন্ট ডাউন শুরু হয়েছে।
মাঠে থাকবে আওয়ামী লীগ : এদিকে ঢাকায় শান্তি ও উন্নয়ন শোভাযাত্রা করবে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। ১৮ ও ১৯ জুলাই দুই দিন এ শোভাযাত্রা অনুষ্ঠিত হবে। পাশাপাশি আগস্ট থেকে জেলা পর্যায়ে সমাবেশ করবে দলটি। গত শুক্রবার রাজধানীর ধানমন্ডিতে দলীয় সভাপতির রাজনৈতিক কার্যালয়ে সহযোগী সংগঠনের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকদের সঙ্গে বৈঠকে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের এ কর্মসূচির কথা জানান। তিনি বলেন, ১৮ জুলাই ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগ রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার ইনস্টিটিউশন থেকে ধানমন্ডি ৩২ পর্যন্ত এবং ১৯ তারিখে ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগ তেজগাঁওয়ে সাত রাস্তা মোড় থেকে মহাখালী পর্যন্ত শান্তি ও উন্নয়ন শোভাযাত্রা করবে। আর আগস্ট থেকেই জেলা পর্যায়ে শান্তি ও উন্নয়ন সমাবেশ করবেন দলীয় সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
‘অসাংবিধানিক পথে হাঁটছে বিএনপি’ : ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ বিরোধীদের রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলার পাশাপাশি নির্বাচনের প্রস্তুতিও নিচ্ছে। দলটির নেতারা জানান, বিএনপি অসাংবিধানিক পথে হাঁটছে; জনগণের আস্থা আছে সরকারের ওপর। আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম বলেন, তারা (বিএনপি) সবসময় বলে আসছে নির্বাচনে যাবে না, নির্বাচন করবে না, করতে দেবে না। এমনকি নির্বাচনকে প্রতিহত করবে। এজন্য সবাইকে ঘর থেকে বেরিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছে। এটি কি কোনো গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলের নেতারা উচ্চারণ করতে পারেন!
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল-আলম হানিফ বলেন, দেশের উন্নয়নে এ সরকারের গত ১৫ বছরের যে কর্মকাণ্ড, তাতে দেশের মানুষের আস্থা এখন সরকার ও শেখ হাসিনার ওপর আছে। কাজেই যে দেশের মানুষের আস্থা সরকারের ওপর আছে, তাকে সরানো সম্ভব হয় না।
সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার কালবেলাকে বলেন, আগামী নির্বাচন ইস্যুতে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বিদেশি কূটনীতিকরা বৈঠক করেছেন। কিন্তু আওয়ামী লীগ ও বিএনপির কর্মসূচি দেখে মনে হচ্ছে তারা বিপরীত মেরুতেই হাঁটছেন। সংঘাতময় পরিস্থিতি এড়াতে আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের পথ খুঁজতে হবে। এ ক্ষেত্রে সরকারকেই উদ্যোগ নিতে হবে। সুষ্ঠু নির্বাচন করা যেমন চ্যালেঞ্জ, তেমনি সেটা করতে পারলে সরকারের জন্য হবে গর্বের। রাজনৈতিক দলগুলোর শুভবুদ্ধির উদয় না হলে সংকট নিরসন হবে না।
মন্তব্য করুন