ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে যুদ্ধবিরতি চুক্তির প্রথম ধাপে স্বাক্ষরের পর সব শর্ত ও বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া নিয়ে সমঝোতা হয়েছে। এর ফলে যুদ্ধবিধ্বস্ত গাজা উপত্যকায় ফিরছেন বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনিরা। তবে তারা ফিরবেন কোথায়? সব জায়গাতো ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। রাস্তাঘাট নেই। বাড়িঘর গুঁড়িয়ে গেছে। ধ্বংসাবশেষের নিচে চাপা পড়ে আছে প্রিয়জনের মরদেহ। এমন পরিস্থিতিতে নিজভূমে ফেরা ফিলিস্তিনিদের জন্য পদে পদে চ্যালেঞ্জিং হবে।
গাজা পুনর্গঠন
গাজার ফিলিস্তিনিরা স্থায়ী যুদ্ধবিরতির আশায় রয়েছেন। তবে যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার পরও তারা নিজেদের শহর, গ্রাম পুনর্গঠনের দীর্ঘ ও জটিল পথেই থাকবেন। আর তাদের স্বাভাবিক জীবনে ফেরাও হবে কষ্টকর। এখন গাজাকে বাসযোগ্য করাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী, গাজা পুনর্গঠনের জন্য ৫০ বিলিয়ন ডলারের বেশি খরচ হবে। আর পুরো উপত্যকাকে ফের বাসযোগ্য করতে কমপক্ষে ১৫ বছর সময় লাগতে পারে।
গাজার ৯০ শতাংশের বেশি আবাসন ধ্বংস করা হয়েছে। দুই বছর ধরে চলা ইসরায়েলি আগ্রাসনে মসজিদ, বিদ্যালয়, হাসপাতালগুলোরও প্রায় শতভাগ গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। এ পরিস্থিতিতে যদি ইসরায়েলের অবৈধ অবরোধ বড় সমস্যা না করে, তাহলেই গাজা পুনর্গঠন সম্ভব। অবশ্য ব্রুকিংস ইনস্টিটিউশনের ২০১৭ সালের প্রতিবেদন বলছে, এর আগে ছোট ছোট যুদ্ধের পরও ইসরায়েলি অবরোধ গাজা পুনর্গঠনকে অনেক কঠিন করেছে। দোহায় অবস্থানরত গাজা বিশেষজ্ঞ আজমি কেশাউই আলজাজিরাকে বলেছেন, যুদ্ধোত্তর যে কোনো পরিকল্পনায় ইসরায়েলের ওপর আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক চাপ থাকা আবশ্যক, যাতে নির্মাণসামগ্রী প্রবেশ করতে পারে। ফিলিস্তিনিরা তাদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করবেন। তবে এই বিশেষজ্ঞ বলছেন, ‘কেবল তাদের ইচ্ছা থাকাটাই যথেষ্ট নয়। এটি কেবল তাদের ওপরই নির্ভর করে না।’
দলীয় সংঘাত, অস্থিরতা
ট্রাম্পের পরিকল্পনার একটি শর্ত হলো—হামাসকে ক্ষমতা ছাড়তে হবে। তবে গাজার ভবিষ্যতের জন্য পুনর্গঠন গুরুত্বপূর্ণ হলেও ভয় রয়েছে যে, হামাস ক্ষমতা ছাড়লে উপত্যকাটি অরাজকতা ও সংঘাতে জড়িয়ে পড়তে পারে। গাজাভিত্তিক সাংবাদিক ইয়াসের আল-বানা বলছিলেন, ‘গাজায় হামাস সরকারের একটি সুবিধা হলো তারা নিরাপত্তা বজায় রাখে।’ গাজায় গণহত্যা চালানোর সময় ইসরায়েল স্বেচ্ছায় গাজার নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের হত্যা করেছে। এ ছাড়া সেখানকার বিভিন্ন কুখ্যাত গোষ্ঠীকে সমর্থন দিয়েছে। এসব গোষ্ঠী ত্রাণ চুরি করে নিয়ে বিক্রির মাধ্যমে সর্বোচ্চ লাভ তুলে নিয়েছে। যদিও গোষ্ঠীগুলো এখন সমস্যা তৈরি করছে, তবে কেশাওয়ি মনে করেন, ইসরায়েল গাজা ছাড়লে তারা টিকে থাকবে না। কারণ ফিলিস্তিনি সমাজ এমন লোকেদের উপেক্ষা করবে, যারা অধিকাংশের চোখে বিশ্বাসঘাতক। তবে দলীয় সংঘাত, বিশেষ করে ফাতাহ ও হামাসের মধ্যে সংঘাত সমস্যার কারণ হতে পারে বলে তিনি সতর্ক করেন।
আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত পশ্চিম তীরের ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের নিয়ন্ত্রণ ফাতাহর হাতে। আর গাজা নিয়ন্ত্রণ করে হামাস। ইসরায়েলের সঙ্গে যুদ্ধে গোষ্ঠীটি অনেকাংশেই দুর্বল হয়ে পড়েছে। ২০০৬ সালে হামাস নির্বাচনে জিতে গেলে ফাতাহর সঙ্গে বিরোধ চূড়ান্ত রূপ নেয়। এই দুই গোষ্ঠীর মধ্যে দ্বন্দ্বের সূচনা ১৯৯৩ সালের অসলো চুক্তির সময় থেকে। হামাসকে নির্মূল করতে যুক্তরাষ্ট্র ফাতাহকে সমর্থন দেয়, যা পরিস্থিতিকে গৃহযুদ্ধের দিকে ঠেলে দেয়। ২০০৭ সালের জুনে হামাস ফাতাহকে উৎখাত করে। এতে জাতীয় আন্দোলনের মধ্যে বিভাজন স্থায়ী হয়ে যায়।
দীর্ঘস্থায়ী ট্রমা
গাজায় থাকতে বাধ্য ফিলিস্তিনিদের মানসিক ট্রমার সঙ্গে লড়তে হবে। ইসরায়েলি হামলায় তারা পরিবার, বন্ধু, বাড়ি আর ভবিষ্যৎ সব হারিয়েছেন। এসব ক্ষতি মেনে নেওয়ার বা শোক প্রকাশ করার জন্যও তাদের সময় হয়নি। গাজার ফিলিস্তিনিদের লড়াই কেবল শারীরিক নয়, মানসিকভাবেও অত্যন্ত কঠিন। যুদ্ধ শুরুর আগে ২০২২ সালে সেভ দ্য চিলড্রেনের এক সমীক্ষায় দেখা যায়, গাজার পাঁচটি শিশুর মধ্যে চারটিই অবসাদ, শোক ও ভয়ের মধ্যে জীবনযাপন করছে। ডক্টরস উইদাউট বর্ডারস (এমএসএফ) জানায়, গাজার ফিলিস্তিনিদের ওপর চালানো এই গণহত্যার কারণে যে সামষ্টিক ট্রমা এসেছে, তা অতীতের সাধারণ যুদ্ধ বা বিপর্যয়ের চেয়ে অনেক গভীর ও ভয়ংকর।
গত বছর জর্দানের আম্মানে এমএসএফের মনোরোগ বিশেষজ্ঞ আহমদ মাহমুদ আল-সালেম গাজার শিশুদের চিকিৎসা দেন। তিনি দেখেন, বেশিরভাগ শিশু জীবনধারণ করছে জ্বলজ্বলে দুঃস্বপ্ন, অবসাদ ও অনিদ্রার মধ্যে।
মন্তব্য করুন