মাওলানা মিজানুর রহমান
প্রকাশ : ১৫ আগস্ট ২০২৫, ১২:০০ এএম
আপডেট : ১৫ আগস্ট ২০২৫, ০৮:০৯ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

মানুষের দোষ প্রকাশ করা অনুচিত

মানুষের দোষ প্রকাশ করা অনুচিত

ইসলাম নেতিবাচক বিষয় প্রকাশ করা পছন্দ করে না। দোষ, পাপ ও অপরাধ নিজের হোক বা অন্যের; তা আলোচনা করা অনুচিত। নিজের অন্যায় কর্ম অন্যদের সামনে প্রকাশ করা সম্পর্কে হাদিসে এসেছে, রাসুল (সা.) বলেন, ‘আমার উম্মতের সব ব্যক্তির গুনাহ ক্ষমা করে দেওয়া হবে, তবে ওইসব লোক ছাড়া, যারা নিজেদের পাপ ও অপরাধ জনসমক্ষে প্রকাশ করে। নিজেদের অপরাধ প্রকাশ করার অর্থ হচ্ছে কেউ রাতে কোনো গুনাহ করে, অতঃপর যখন সকাল হয় সে নিজেই তা মানুষকে বলে বেড়ায়, গত রাতে আমি এই এই কাজ করেছি। অথচ রাতে তার প্রতিপালক সেটাকে গোপন রেখেছেন এবং অবিরত তার প্রতিপালক তা গোপন রাখছিলেন এবং সে দিনের বেলায় কোনো গুনাহের কাজ করে আর যখন রাত হয়; সে তা মানুষকে বলে বেড়ায়, যদিও আল্লাহ তা গোপন রেখেছিলেন।’ (মুসলিম: ২৯৯০)। নিজের কোনো পাপ হয়ে গেলে তা তো গোপন করতেই হবে, অন্য কোনো ব্যক্তির পাপ ও অপরাধও যদি চোখে পড়ে যায় সেটাও গোপন করা উচিত। হাদিসে এসেছে, ‘যে ব্যক্তি তার মুসলিম ভাইয়ের গোপন (অপরাধের) বিষয় গোপন রাখবে, আল্লাহ কেয়ামতের দিন তার গোপন (অপরাধের) বিষয় গোপন রাখবেন। আর যে ব্যক্তি তার মুসলিম ভাইয়ের গোপন বিষয় ফাঁস করে দেবে, আল্লাহ তার গোপন বিষয় ফাঁস করে দেবেন, এমনকি এই কারণে তাকে তার ঘরে পর্যন্ত অপদস্থ করবেন।’ (ইবনে মাজা: ২৫৪৬)

প্রকাশ্যে বা গোপনে পাপ করা যেমন উচিত নয়, তেমনি কখনো গোপনে পাপ হয়ে গেলে তা লোকসমাজে প্রকাশ করাও উচিত নয়। পাপের কথা প্রকাশ্যে বলে বেড়ালে আড় ভেঙে যায় এবং সমাজে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। সাধারণত সামাজিকতা, চক্ষুলজ্জা ও অপমানের ভয় অনেক সময় মানুষকে অনেক খারাপ কাজ করা থেকে বিরত রাখে। হতে পারে এ ভয়টাই একদিন তাকে আল্লাহর দিকে নিয়ে যাবে, যখন সে তার ভুল বুঝতে পারবে এবং তার কৃত অপরাধের জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইবে। কিন্তু যখন তার অপরাধ জনসমক্ষে প্রকাশ করে দেওয়া হয় তখন সেই ভয় বা চক্ষুলজ্জা আর তার মাঝে কাজ করে না। সে তখন ভাবতে থাকে, কী হবে আর ভালো থেকে, ক্ষতি যা হওয়ার তা তো হয়েই গেছে, লোকজন তো জেনেই গেছে এরই মধ্যে, তখন সে প্রকাশ্যে পাপকাজে লিপ্ত হতে থাকে। তা ছাড়া বারবার পাপের কথা বলতে থাকলে মানুষের অন্তর থেকে পাপের ভয় দূর হয়ে যায়। তখন পাপকে আর পাপ বলে মনেই হয় না। যে পাপের কথা বলে বেড়াতে লজ্জাবোধ করে না, একই পাপে লিপ্ত হওয়া তার জন্য অসম্ভব কিছু নয়। আর এভাবেই সমাজে পাপ ছড়িয়ে পড়তে থাকে। আল্লাহতায়ালা বলেছেন, ‘আল্লাহ কোনো মন্দ বিষয় প্রকাশ করা পছন্দ করেন না। তবে কারও প্রতি জুলুম হয়ে থাকলে সে কথা আলাদা। আল্লাহ সর্বশ্রোতা, সর্ববিষয়ে জ্ঞাত।’ (সুরা নিসা: ১৪৮)।

অন্যের পাপ ও দোষ অনুসন্ধান করতেও কঠোরভাবে নিষেধ করা হয়েছে ইসলামে। কোনো মানুষই চায় না, তার গোপনীয় বিষয়গুলো অন্য কেউ খুঁজে বের করে মানুষের কাছে তা প্রকাশ করুক। বরং সবাই চায়, তার গোপনীয় বিষয়গুলো যেন প্রকাশ না পায়। তাই অন্যের দোষত্রুটি খুঁজে বেড়ানো মানুষের কাছে একটি নিন্দনীয় স্বভাব। শুধু তাই নয়, এমন স্বভাব মহান আল্লাহর কাছেও অপছন্দনীয়। এজন্য পরের দোষ খুঁজে বেড়ানো ইসলামে সম্পূর্ণরূপে নিষেধ করা হয়েছে। এ সম্পর্কে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘হে ইমানদারগণ! তোমরা একে অন্যের গোপনীয় বিষয় সন্ধান কোরো না।’ (সুরা হুজরাত: ১২)। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা মুসলমানদের দোষত্রুটি, ভুলভ্রান্তি খুঁজে বের কোরো না। যে ব্যক্তি অন্যের দোষ খুঁজে বেড়ায় ও প্রকাশ করে, স্বয়ং আল্লাহ তার দোষ প্রকাশ করে দেন। আর আল্লাহ যার দোষত্রুটি প্রকাশ করেন তাকে নিজের বাড়িতেই লাঞ্ছিত করেন।’ (আবু দাউদ: ৪৮৮০)। অন্যের দোষ গোপন রাখা একটি মানবীয় গুণ। এতে মানুষ বিশ্বস্ত প্রমাণিত হয়; যে লোক দোষ বলে বেড়ায়, সে সবার বিশ্বস্ততা হারায়। সম্পর্কও নষ্ট হয়। উত্তম চরিত্রের দাবি হলো মানুষের দোষত্রুটি গোপন রাখা এবং কথাচ্ছলে কারও কাছে প্রকাশ না করা। মানুষের দোষ ও পাপ গোপন করার অনেক সওয়াব রয়েছে। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘যে কেউ অন্যের দোষ গোপন রাখবে, আল্লাহ কেয়ামতের দিন তার দোষ ঢেকে রাখবেন।’ (বোখারি: ২৪৪২)

আমরা যদি সোনালি যুগের সোনালি মানুষ সাহাবিদের দিকে তাকাই, তাহলে আমরা এ ব্যাপারে তাদের জীবনের বাস্তব আমল সম্পর্কে জানতে পারব। ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হজরত ওমর (রা.) একদিন কোনো কাজে এক রাতে বাইরে বের হলেন। তার সঙ্গে ইবনে মাসউদ (রা.) ছিলেন। এক জায়গায় তারা আগুনের আলো দেখতে পেলেন। বিষয়টি তদন্ত করতে উভয়ই সেদিকে চলতে লাগলেন। একসময় তারা আগুনের উৎসস্থান খুঁজে পেয়ে এক ঘরের সামনে উপনীত হলেন। ইবনে মাসউদ (রা.)-কে বাইরে রেখে ওমর (রা.) ভেতরে প্রবেশ করলেন। তখন গভীর রাত। ভেতরে গিয়ে দেখলেন, ঘরে প্রদীপ জ্বলছে। সেখানে এক বৃদ্ধ বসে আছেন। তার সামনে পান করার মতো কিছু একটা রাখা আছে। আর এক দাসী তাকে গান শোনাচ্ছে। বৃদ্ধ লোকটি তাদের প্রবেশের বিষয়টি টের পায়নি। যখন টের পেল ততক্ষণে ওমর (রা.) তার একেবারে কাছে পৌঁছে গেছেন। ওমর (রা.) বললেন, ‘আজ রাতের মতো এমন খারাপ দৃশ্য আমি আর কখনো দেখিনি। একজন বৃদ্ধ মানুষ, যে বলতে গেলে মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে, সে এমন মন্দ কাজে লিপ্ত!’ বৃদ্ধ লোকটি মাথা তুলে বলল, ‘আপনি যা বলেছেন, সেটা সঠিক। কিন্তু আপনি নিজে যা করেছেন, তা এর চেয়েও জঘন্য। আপনি অন্যের ঘরে ঢুকে দোষ সন্ধান করেছেন। অথচ আল্লাহতায়ালা এ ধরনের দোষ খুঁজে বেড়াতে নিষেধ করেছেন। তা ছাড়া আপনি অনুমতি ছাড়াই ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়েছেন।’ ওমর (রা.) নিজের ভুল বুঝতে পারলেন এবং চোখ থেকে অনুতাপের অশ্রু ঝরল। ওমর (রা.) সেখান থেকে চলে গেলেন। দীর্ঘদিন পর দেখা গেল, ওই বৃদ্ধ লোকটি ওমর (রা.)-এর দরবারে এসে মজলিসের শেষ প্রান্তে কিছুটা আড়াল হয়ে বসে পড়ল। হজরত ওমর (রা.) তাকে দেখে ফেললেন এবং বললেন, ‘বৃদ্ধ লোকটিকে আমার কাছে নিয়ে এসো।’ এদিকে বৃদ্ধ লোকটি ধরে নিল যে, সেদিন ওমর (রা.) নিজের চোখে যা দেখেছেন, তার জন্য আজ শাস্তি অবধারিত। বৃদ্ধ লোকটিকে তার কাছে নিয়ে আসা হলে ওমর (রা.) তার একেবারে বাহুসংলগ্ন করে তার কানের কাছে মুখ নিয়ে বললেন, ‘ভালো করে শুনে রাখো, আল্লাহর শপথ করে বলছি, সে রাতে আমি তোমাকে যা করতে দেখেছি, তা অদ্যাবধি কাউকে বলিনি। তোমার দোষ গোপন করে রেখেছি। এমনকি ইবনে মাসউদ আমার সঙ্গে ছিল, তাকেও না।’ বৃদ্ধ লোকটি ওমর (রা.)-এর কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল, সেই সত্তার শপথ, যিনি মুহাম্মদ (সা.)-কে সত্যসহ রাসুল করে পাঠিয়েছেন, আমিও সেই কাজ আর কখনো করিনি। তখন ওমর (রা.) জোর আওয়াজে আল্লাহু আকবর বলে উঠলেন। কিন্তু আশপাশের কারও জানা ছিল না যে কেন হঠাৎ তিনি তাকবির ধ্বনি দিলেন। (হায়াতুস সাহাবা: ২/৫৩৮৮)

এ ঘটনায় আমাদের জন্য দুটি শিক্ষণীয় বিষয় রয়েছে—এক. অন্যের দোষত্রুটি খুঁজে বেড়ানো যাবে না। যদিও সে শাসক হয়। আর অনিচ্ছাসত্ত্বেও যদি অন্যের দোষ চোখে পড়ে, তাহলে সেটা গোপন করে রাখতে হবে। দুই. অন্যের ঘরে প্রবেশ করার আগে অবশ্যই তার অনুমতি গ্রহণ করতে হবে। আমরা যদি নিজেরাই নিজেদের আমল সম্পর্কে একটু চিন্তা করি, তাহলে দেখা যাবে আমরা প্রত্যেকেই রাতের আঁধারে অথবা একা নিরালায় শয়তানের খপ্পরে পড়ে কমবেশি অনেক বড় অপরাধ করে ফেলেছি, যে অপরাধের কথা একমাত্র আল্লাহ ছাড়া কেউই জানে না। তাইতো বলা হয়, পিতামাতার গোপনীয় অপরাধের কথা যদি সন্তান জানত, তাহলে কোনো সন্তানই পিতামাতাকে ঘৃণায় সম্মান করত না। আবার সন্তানের গোপনীয় অপরাধের কথা যদি কোনো পিতামাতা জানতেন, তাহলে পিতামাতা কখনো তাকে সন্তান বলে পরিচয় দিতেন না। সুতরাং কেউ যদি চায় তার দোষগুলো যেন আল্লাহতায়ালা গোপন করে রাখে, তাহলে সে যেন অন্য মুসলমান ভাইয়ের দোষগুলো গোপন করে রাখে। এ সম্পর্কে রাসুল (সা.) স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো মুসলিমের দোষ গোপন করে রাখবে, মহান আল্লাহতায়ালা দুনিয়া ও পরকালে তার দোষ গোপন করে রাখবেন।’ (মুসলিম: ৬৪৭২)

আল্লাহতায়ালা নিজে দয়াপরবশ হয়ে বান্দার অনেক অপরাধ গোপন করে রাখেন। কিন্তু দুর্ভাগা অনেক মানুষই চায় না যে, তার গোপন অপরাধগুলো গোপন থাক। তাইতো অনেক মানুষই রাতের আঁধারে তাদের কৃত অপরাধগুলো দিনের আলোতে অন্যের কাছে নির্লজ্জভাবে প্রকাশ করে দেয়, যা আল্লাহর বিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। যে নিজের গোপনীয় বিষয় নিজেই অন্যের কাছে প্রকাশ করে, আল্লাহতায়ালা তার গোপনীয় অপরাধগুলো কখনো ক্ষমা করেন না। এ সম্পর্কে হাদিসে বর্ণিত আছে—রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘আমার উম্মতের সবার গুনাহ ক্ষমা করে দেওয়া হবে। কিন্তু নিজেরা নিজেদের দোষত্রুটি জাহিরকারীদের পাপ ক্ষমা করা হবে না। কিছু কিছু মানুষ নিজেদের পাপকর্ম ও দোষত্রুটি এমনভাবে প্রকাশ করে, যেমন কোনো ব্যক্তি রজনীতে কোনো অপকর্ম করে। এরপর প্রভাত হয়। মহান আল্লাহ পাক তার কর্মফলগুলো গোপন করে রেখেছেন। এরপর সে সকালবেলা বলে, হে অমুক! আমি গত রাতে এমন এমন কাজ করেছি। অথচ সে রাতযাপন করেছিল এমন অবস্থায় যে, মহান আল্লাহতায়ালা অপরাধগুলো গোপন করে রেখেছিলেন আর ভোরবেলা সে মহান আল্লাহর গোপনীয়তাকে প্রকাশ করে দেয়।’ (বোখারি: ৬০৬৯)।

হাদিস থেকে আমাদের শিক্ষা হচ্ছে, আমরা কখনো আমাদের কৃত অপরাধগুলো অন্যের কাছে অযাচিতভাবে প্রকাশ করব না। অন্যের কোনো দোষ-দুর্বলতাও মানুষের সামনে প্রকাশ করব না।

লেখক: ইমাম ও খতিব

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

অ্যাম্বুলেন্স সিন্ডিকেটের বাধায় প্রাণ গেল নবজাতকের

বিয়ের অনুষ্ঠানেই বিশাল টাকার মালিক দম্পতি, স্কুল নির্মাণে দান করলেন দেড় কোটি

স্বাধীনতা দিবসে দীর্ঘতম ভাষণ দিয়ে মোদির রেকর্ড

মেসির চেয়েও বেশি বিক্রি হচ্ছে সন হিউং মিনের জার্সি!

সাজেকে যাচ্ছিলেন ৬ বন্ধু, অতঃপর...

বর্জ্যপানি বিশ্লেষণ / মেথ, কোকেইন ও হেরোইন ব্যবহারে নতুন রেকর্ড

জলাধার, মাঠ ও পার্ক সংরক্ষণে ডিএনসিসির চিঠি

বৈধ না হলে নির্বাচনের কোনো মানে নেই : ড. ইউনূস

গণমাধ্যমে লুকিয়ে থাকা গণহত্যার সহযোগীদের দ্রুত বিচার দাবি জেআরজেএর

নির্বাচনের আগে রাকসুর ফান্ড নিয়ে যত প্রশ্ন

১০

সিপিএলের প্রথম ম্যাচে ব্যর্থ সাকিব

১১

যুদ্ধ শেষের শর্ত জানালেন নেতানিয়াহু

১২

পুরান ঢাকায় সেনাবাহিনীর অভিযান, ৮ চাঁদাবাজ আটক 

১৩

বিমানের ভেতরে সিগারেট ধরিয়ে আসনের কভার জ্বালানোর চেষ্টা যুবতীর!

১৪

এনসিপি থেকে ২৫ নেতাকর্মীর পদত্যাগ

১৫

মুরাদনগরে শ্রেণিকক্ষে ছুরি প্রদর্শনের ভিডিও ভাইরাল, ৪ শিক্ষার্থী বহিষ্কার

১৬

সিলেটে খাল থেকে ভারতীয় নাগরিকের অর্ধগলিত লাশ উদ্ধার

১৭

এবার পাকিস্তানকে মোদির কঠোর হুঁশিয়ারি

১৮

ইলিশ খেলে দূরে থাকবে এই কঠিন ৪ রোগ

১৯

১৫ আগস্ট : টিভিতে আজকের খেলা

২০
X