ড. সজল চৌধুরী
প্রকাশ : ০৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০২:৫৮ এএম
আপডেট : ০৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৮:১১ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

বন্যা পরিস্থিতিতে স্থপতিদের নতুন চ্যালেঞ্জ ও সুযোগ

বন্যা পরিস্থিতিতে স্থপতিদের নতুন চ্যালেঞ্জ ও সুযোগ

বাংলাদেশে বন্যা একটি স্বাভাবিক ঘটনা। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বন্যার তীব্রতা ও ঘনত্ব বেড়েছে। দেশের নিম্নাঞ্চলে অবস্থান এবং জনবহুল জনসংখ্যার কারণে বন্যা বাংলাদেশের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেশের নির্মিত পরিবেশ অর্থাৎ শহর ও গ্রামের অবকাঠামো এই প্রাকৃতিক দুর্যোগের মুখে অত্যন্ত অরক্ষিত। এই পরিস্থিতিতে স্থপতিদের ভূমিকা অপরিসীম। কারণ, তারা নির্মিত পরিবেশের নকশা এবং ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে জনজীবনের সুরক্ষা ও উন্নয়নে একটি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারেন। তারা একদিকে মানুষের বাসস্থানের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এবং অন্যদিকে পরিবেশ রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারেন।

বাংলাদেশ একটি নিম্নাঞ্চলীয় দেশ, যার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ প্রতি বছরই বন্যার পানিতে নিমজ্জিত থাকে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, সাম্প্রতিক বন্যায় দেশের প্রায় ২০ শতাংশ এলাকা প্লাবিত হয়েছে এবং ১০ মিলিয়নেরও বেশি মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কৃষি, অবকাঠামো, আবাসনসহ অর্থনৈতিক ক্ষতির পরিমাণ হাজার হাজার কোটি টাকা। এই পরিস্থিতি একদিকে যেমন ভয়ংকর, অন্যদিকে তেমনই আমাদের নির্মিত পরিবেশ স্থায়িত্ব এবং জনজীবনের সুরক্ষার প্রয়োজনীয়তা কি পুনরায় স্মরণ করিয়ে দেয়।

স্থপতিদের এই সময়ে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে। তাদের কাজ শুধু ভবন বা অবকাঠামো তৈরি করা নয়; বরং তাদের কাজ হলো এমন একটি নির্মিত পরিবেশ তৈরি করা, যা বন্যার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের মুখে স্থিতিশীল এবং টেকসই। এটি করার জন্য প্রথমত স্থপতিদের অবশ্যই বন্যা প্রতিরোধক নকশা অগ্রাধিকার দিতে হবে। বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী নির্মাণ পদ্ধতিতে বন্যার গুরুত্ব পর্যাপ্তভাবে বিবেচনা করা হয় না, যার ফলে বন্যার সময় অনেক ঘরবাড়ি এবং অবকাঠামো ধ্বংস হয়ে যায়। স্থপতিরা বন্যা মোকাবিলার জন্য কীভাবে নকশা ও পরিকল্পনা করবেন, তা বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত, বন্যাপ্রবণ এলাকায় স্থপতিদের এমন নকশা করতে হবে, যা পানি প্রবেশ রোধ করতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, উঁচু প্লিন্থ, খুঁটির ওপর নির্মাণ এবং ভাসমান ভিত্তি ব্যবহার করে ঘরবাড়ির নকশা করা যেতে পারে। এ ধরনের নকশা বন্যার সময় পানি থেকে বাড়িঘরকে রক্ষা করতে পারে এবং বন্যার ক্ষতি কমাতে পারে।

বাংলাদেশের প্রাকৃতিক ড্রেনেজ সিস্টেমের ওপর শহরের সম্প্রসারণের প্রভাবও বিশাল। নগর পরিকল্পনায় স্থপতিরা যদি প্রাকৃতিক জলাভূমি ও নদী-খালের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে পারেন, তাহলে শহরের বন্যা প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানো সম্ভব। ঢাকার উদাহরণ উল্লেখযোগ্য, যেখানে জলাভূমি ভরাট এবং অপরিকল্পিত নগরায়ণের কারণে বন্যার প্রভাব বৃদ্ধি পেয়েছে। যদি স্থপতিরা শহরের নকশায় সবুজ অবকাঠামো, যেমন সবুজ ছাদ এবং পানি শোষণকারী পেভমেন্ট অন্তর্ভুক্ত করেন, তাহলে পানি শোষণ ও বন্যা প্রতিরোধে উন্নতি ঘটানো সম্ভব।

বন্যা ব্যবস্থাপনায় ভূমি ব্যবহার পরিকল্পনা আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় ঘনবসতি স্থাপন প্রতিরোধ করে নিরাপদ স্থানে উন্নয়ন নিশ্চিত করা প্রয়োজন। এর জন্য পরিকল্পিত এলাকাগুলো পুনর্নির্ধারণ করা, নদীর পাড় এবং উপকূল বরাবর বাফার জোন তৈরি এবং বন্যাপ্রবণ এলাকায় কঠোর নির্মাণ কোড প্রয়োগ করা দরকার। এই প্রক্রিয়ায় স্থপতিরা ভূমি ব্যবহারের সঠিক পরিকল্পনা নিশ্চিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারেন। প্রকৌশল এবং প্রযুক্তি ব্যবহারে স্থপতিরা বন্যার স্থিতিস্থাপকতা বাড়াতে সহায়ক হতে পারেন। ভূতথ্য ব্যবস্থা (GIS) এবং রিমোট সেন্সিংয়ের সাহায্যে পরিকল্পনাকারীরা ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলো শনাক্ত করতে পারেন এবং বাস্তব সময়ে ভূমি ব্যবহার ও পানির স্তরের পরিবর্তনগুলো পর্যবেক্ষণ করতে পারেন। এই ধরনের প্রযুক্তি ব্যবহার করে বন্যার ঝুঁকি হ্রাসে স্থপতিরা নকশা এবং পরিকল্পনা আরও উন্নত করতে পারেন। গ্রামীণ এলাকায়ও স্থপতিদের বিশেষ ভূমিকা পালন করতে হবে। কৃষিভিত্তিক গ্রামীণ সমাজের অবকাঠামো এমনভাবে তৈরি করা উচিত, যা বন্যার সময় কৃষিজমি এবং বাড়িঘরকে সুরক্ষিত রাখতে পারে। এ ছাড়া স্থপতিদের ভূমি ব্যবহারের পরিকল্পনায় এমন নীতি গ্রহণ করতে হবে, যা ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় বসতি স্থাপনে নিরুৎসাহিত করে এবং নিরাপদ এলাকায় উন্নয়নকে উৎসাহিত করে।

স্থপতিদের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা হলো বন্যাপ্রবণ এলাকার মানুষের সচেতনতা বাড়ানো। অনেক মানুষ বন্যার ঝুঁকি সম্পর্কে সচেতন নন এবং তাদের ঘরবাড়ি রক্ষার প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম বা তথ্যও নেই। স্থপতি বন্যা-স্থিতিস্থাপক নকশা এবং বন্যা প্রতিরোধী উপকরণ ব্যবহার করে তাদের ঘরবাড়ি রক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় জ্ঞান সরবরাহ করতে পারেন। তা ছাড়া তারা স্থানীয় সম্প্রদায়ের সঙ্গে মিলে বন্যা ব্যবস্থাপনায় একটি সমন্বিত পদ্ধতি গ্রহণ করতে পারেন, যা স্থানীয় জ্ঞান এবং সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করবে।

স্থপতিদের সহযোগিতায় সরকার এবং বেসরকারি খাতের মধ্যে সমন্বয় বন্যার স্থিতিস্থাপকতা বৃদ্ধিতে সহায়ক হতে পারে। সরকার নীতি তৈরিতে এবং বাস্তবায়নে নেতৃত্ব দিতে পারে, যেখানে বেসরকারি খাতের স্থপতিরা সবুজ অবকাঠামোতে বিনিয়োগ করতে এবং বন্যা প্রতিরোধী নির্মাণ পদ্ধতি গ্রহণ করতে উৎসাহিত হতে পারেন। এভাবে স্থপতিরা সমন্বিত পরিকল্পনা এবং কার্যকর নকশার মাধ্যমে বাংলাদেশের বন্যা ব্যবস্থাপনায় একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারেন। এই দায়িত্ব পালন করার জন্য বিভিন্ন স্টেক হোল্ডারের সহযোগিতা জরুরি। স্থপতি, পরিকল্পনাকারী, প্রকৌশলী, সরকারি সংস্থা এবং স্থানীয় সম্প্রদায়কে একসঙ্গে কাজ করতে হবে বন্যা ব্যবস্থাপনার একটি সমন্বিত কৌশল তৈরি এবং বাস্তবায়নের জন্য। সরকার নীতি তৈরি এবং কার্যকরে নেতৃত্ব দিতে এবং বেসরকারি খাতকে বন্যা প্রতিরোধী অনুশীলন গ্রহণে উৎসাহিত করতে হবে।

সাম্প্রতিক বন্যা আমাদের দেশের নির্মিত পরিবেশের প্রতি যে চ্যালেঞ্জগুলো সৃষ্টি করেছে, তা তুলে ধরেছে। তবে এটি স্থপতিদের জন্য একটি সুযোগ সৃষ্টি করেছে, যাতে তারা ভবিষ্যতে বন্যা থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য আরও শক্তিশালী, টেকসই এবং সামগ্রিকভাবে সুস্থির নির্মিত পরিবেশ গড়ে তুলতে পারেন। সঠিক কৌশল এবং সহযোগিতার মাধ্যমে আমরা একটি নিরাপদ ভবিষ্যৎ গড়ে তুলতে পারি, যেখানে মানুষ ও পরিবেশ উভয়ই সুরক্ষিত থাকবে। বাংলাদেশের স্থপতি তাদের কাজের মাধ্যমে এই ভবিষ্যৎ গড়ে তোলার জন্য অপরিহার্য ভূমিকা পালন করছেন এবং তাদের দায়িত্ব এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

লেখক: স্থপতি, শিক্ষক (স্থাপত্য বিভাগ, চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়) এবং স্থাপত্য পরিবেশ বিষয়ক গবেষক

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

‘পিপিপি ডিভিশনাল কনফারেন্স চট্টগ্রাম ২০২৫’ অনুষ্ঠিত

৫ বছরের শিশু ধর্ষণ মামলার প্রধান আসামি গ্রেপ্তার 

চিন্ময় দাসের জামিন 

জেলে থেকেও অস্ত্র মামলায় আসামি স্বেচ্ছাসেবক দল নেতা

অভিনেতা সিদ্দিক ৭ দিনের রিমান্ডে

প্রধান উপদেষ্টার পক্ষ থেকে ৭০ ঘর পেলেন কুমিল্লার বন্যা দুর্গতরা

সাকিবকে টপকে টেস্টে অনন্য কীর্তি মিরাজের

আদালত অবমাননার অভিযোগে হাসিনাসহ দুজনকে কারণ দর্শানোর নির্দেশ

ভারতে চিকিৎসা না পেয়ে দেশে ফেরা শিশুদের পাশে পাকিস্তান সরকার

কর্ণফুলী নদী থেকে ক্ষুদে ক্রিকেটারের মরদেহ উদ্ধার

১০

গাজীপুরে দুই কারখানা বন্ধ ঘোষণা

১১

মিনিস্টার ফ্রিজ কিনুন হাম্বা জিতুন সিজন-০২

১২

পাকিস্তানের ধাওয়া খেয়ে পালাল ভারতের যুদ্ধবিমান

১৩

বাজারে কবে আসবে সাতক্ষীরার আম

১৪

ওয়াঘা সীমান্ত দিয়ে ভারত ছাড়ছেন শত শত পাকিস্তানি

১৫

সাদমানের পর মিরাজের শতকে বাংলাদেশের ২১৭ রানের লিড

১৬

আদালতে পুলিশকে ফাঁকি দিয়ে পালানো সেই ইকবাল গ্রেপ্তার

১৭

কর্মবিরতি ও উচ্ছৃঙ্খলতার অভিযোগে দুই কারখানা বন্ধ

১৮

হঠাৎ আকাশে উঠল পদ্মার পানি, ভিডিও ভাইরাল

১৯

বিএসইসির ২২ কর্মকর্তা সাময়িক বরখাস্ত  

২০
X