ড. এস এম জাহাঙ্গীর আলম
প্রকাশ : ০৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ০২:৫৯ এএম
আপডেট : ০৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৮:১২ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

দূষণ ও যানজট কমাতে কার্যকর উদ্যোগ আবশ্যক

দূষণ ও যানজট কমাতে কার্যকর উদ্যোগ আবশ্যক

রাজধানী ঢাকা নাগরিক জীবনের জন্য ক্রমেই হুমকির কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। বায়ুদূষণ, শব্দদূষণ, আলোদূষণসহ নানাবিধ কারণে নাগরিক জীবন হুমকির মুখে পড়ছে। যানবাহনের চাপ বাড়ছে অস্বাভাবিকভাবে। বিআরটিএর হিসাবে, ২০১০ সালে ঢাকায় মোটরযানের সংখ্যা ছিল ২১ লাখ ৬৬ হাজার ৩৮৯টি, যা বেড়ে ২০২৩-এ দাঁড়ায় ৫৭ লাখ ৫৫ হাজার ১টিতে। আর গোটা বাংলাদেশে একই সময়ের ব্যবধানে ১৪ লাখ ২৭ হাজার ৩৬৮টি থেকে ৬১ লাখ ৭৫ হাজার ৮৩৮টিতে। অযান্ত্রিক যানে তো কোনো হিসাব নেই। রাজধানীতে এখন দিনের বেলায়ও হেডলাইট জ্বালিয়ে মোটরযান চলে। আর রাত ১২টায়ও যানজট লেগে থাকে।

গবেষণায় দেখা গেছে, আবাসিক অঞ্চলে গড় শব্দের মান ৯৭ ডেসিবেল, যা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমোদিত গড় আওয়াজ মান ৫০ ডেসিবেলের অনেক ঊর্ধ্বে। উচ্চশব্দের মাত্রা মানুষের মধ্যে কার্ডিওভাসকুলার প্রাব এবং করোনারি আর্টারি ডিজিজ তৈরিতে ভূমিকা রাখে। প্রাণীদের মধ্যে শব্দদূষণ মৃত্যুর ঝুঁকি বাড়িয়ে দিতে পারে, প্রজনন, নেভিগেশনে প্রভাব ফেলতে পারে এবং স্থায়ীভাবে শ্রবণ অঙ্গের ক্ষতিসাধন করতে পারে। মানুষের কান যে কোনো শব্দের ব্যাপারে যথেষ্ট সংবেদী। তাই তীব্র শব্দ কানের পর্দাতে বেশ জোরে ধাক্কা দেয়, যা কানের পর্দা নষ্টও করে দিতে পারে। শিশুদের ক্ষেত্রে এর ক্ষতিকর প্রভাব সুদূরপ্রসারী হতে পারে। শিশু বয়সে শব্দের অধিক তারতম্যের জন্য বৃদ্ধ বয়সে তাদের কানের বিভিন্ন সমস্যা দেখা যায়। দলগতভাবে বিভিন্ন অঞ্চলে শব্দদূষণের কারণ অনুসন্ধান করে দেখা গেছে, যেসব অঞ্চলে দূষণের মাত্রা বেশি, সেখানে নিম্নলিখিত অসুবিধা বা ক্ষতিকর প্রভাব মানুষের মধ্যে পড়েছে: (ক) দূষণ প্রভাবিত এলাকার মানুষের মেজাজ খিটখিটে হচ্ছে; (খ) আচরণে অস্বাভাবিকতা ও মানসিক উত্তেজনা দেখা যাচ্ছে; (গ) মানুষকে ক্লান্ত, অবসাদগ্রস্ত ও কাজে অমনোযোগী করে তুলছে; (ঘ) বয়স্ক মানুষের স্মৃতিশক্তি হ্রাস পাচ্ছে এবং (ঙ) এমনকি বধির হওয়ার মতো খবরও পাওয়া যাচ্ছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) তথ্য বলছে, বিশ্বের ৯০ শতাংশ মানুষ শ্বাসপ্রশ্বাসে দূষিত বাতাস গ্রহণ করে থাকে। এ বাতাসে রয়েছে ফুসফুসের জন্য ক্ষতিকর সব গ্যাস ও অতি সূক্ষ্ম বস্তুকণা। দূষিত এ বাতাসের সংস্পর্শে এলে দেখা দিতে পারে শ্বাসকষ্ট, কাশি, হাঁপানি, এমনকি বুকব্যথাও। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য বলছে, বিশ্বের ৯০ শতাংশ মানুষ শ্বাসপ্রশ্বাসে দূষিত বাতাস গ্রহণ করে। বিশ্বে প্রতি বছর মানুষের মৃত্যুর বড় একটি কারণ হৃদরোগ। এ তথ্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার। আর বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনারি ধমনি বন্ধের সঙ্গে বায়ুদূষণের সরাসরি সংযোগ রয়েছে। করোনারি ধমনির মাধ্যমেই হৃৎপিণ্ডে রক্ত, অক্সিজেনসহ নানা পুষ্টি উপাদান সরবরাহ হয়।

দূষিত বাতাসের মধ্যে শ্বাস নিলে ক্ষতিকর কণাগুলো রক্ত শোষণ করে নেয়। এরপর সেগুলো রক্তের মাধ্যমে সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ে। পাশাপাশি শরীরের রোগ প্রতিরোধব্যবস্থা কণাগুলোকে ব্যাকটেরিয়া হিসেবে শনাক্ত করে। এর প্রতিক্রিয়ায় হৃৎপিণ্ডের ধমনিগুলো সংকুচিত হয়ে যায়, দুর্বল হয়ে পড়ে পেশি। এসবের জেরে হৃদরোগে আক্রান্তের ঝুঁকি বাড়ে। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, স্ট্রোকসহ মস্তিষ্কের নানা সমস্যার সঙ্গে সংযোগ রয়েছে বায়ুদূষণের। এমনকি মস্তিষ্কের কার্যকারিতার ওপর বায়ুদূষণ মারাত্মক আকারে প্রভাব ফেলতে পারে বলে সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে। গবেষকদের দাবি, উচ্চমাত্রার বায়ুদূষণ শিশুদের বোধক্ষমতা ক্ষতিগ্রস্ত করে তুলতে পারে। দুর্বল করে দিতে পারে প্রাপ্তবয়স্কদের বোধশক্তি। পাশাপাশি বিষণ্নতার একটি কারণও হয়ে উঠতে পারে বায়ুদূষণ। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, স্ট্রোকসহ মস্তিষ্কের নানা সমস্যার সৃষ্টি করে। বায়ুদূষণের কারণে ক্ষতি হতে পারে ত্বকেরও। দূষিত কণা প্রথম সংস্পর্শে আসে ত্বকের। এর জেরে শিশুরা নানা চর্মরোগে আক্রান্ত হয়।

বাতাসের দূষিত কণা প্রথম সংস্পর্শে এসে শিশুরা নানা চর্মরোগে আক্রান্ত হয়। বায়ুদূষণের ক্ষতির ঝুঁকি থেকে বাদ পড়ে না চোখও। তবে লোকভেদে এ ক্ষতির উপসর্গ ভিন্ন হতে পারে। অনেকের ক্ষেত্রেই কোনো উপসর্গ দেখা দেয় না। অনেকেই আবার চোখে শুষ্কতা, অস্বস্তি ও ব্যথার মতো নানা সমস্যার মুখে পড়তে পারে। ওজোন ও নাইট্রোজেন ডাইঅক্সাইডের সংস্পর্শে এলেও চোখের ব্যথা দেখা দিতে পারে। কন্টাক্ট লেন্সও ডেকে আনতে পারে একই ধরনের জটিলতা।

ঢাকার বায়ুদূষণ বাড়ছেই। সাধারণত বর্ষা শেষে দূষণ বাড়তে থাকে। এ ধারা এবারও অব্যাহত আছে। সকাল সাড়ে ৮টার দিকে বিশ্বের ১২১টি শহরের মধ্যে বায়ুদূষণে রাজধানী ঢাকার অবস্থান চতুর্থ। এ সময় আইকিউএয়ারের বাতাসের মানসূচকে ঢাকার স্কোর ১৬৩। বাতাসের এই মান ‘অস্বাস্থ্যকর’ বলে বিবেচনা করা হয়। বায়ুদূষণের পরিস্থিতি নিয়মিত তুলে ধরে সুইজারল্যান্ডভিত্তিক প্রতিষ্ঠান আইকিউএয়ার। বাতাসের মান নিয়ে তৈরি করা এই লাইভ বা তাৎক্ষণিক সূচক একটি নির্দিষ্ট শহরের বাতাস কতটা নির্মল বা দূষিত, সে সম্পর্কে মানুষকে তথ্য দেয় ও সতর্ক করে। ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহারের কারণে রাজধানী ঢাকায় যানজট বাড়ছে। প্রতিদিন যানজটে প্রায় ৮২ লাখ কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে বলে তথ্য উঠে এসেছে বিশ্ব ব্যক্তিগত গাড়িমুক্ত দিবসের আলোচনা সভায়। এ দেশের ধূমপায়ীরা সিগারেট ফুঁকে বছরে প্রায় ৩৮ হাজার কোটি টাকার শুল্ককর দেন। প্রতিটি শলাকার দামের ৬০-৮০ শতাংশই তাদের শুল্ককর হিসেবে দিতে হয়।

বিদায়ী ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সিগারেট খাত থেকে সব মিলিয়ে ৩৭ হাজার ৯১৫ কোটি টাকার শুল্ককর আদায় হয়েছে। ৩১টি কোম্পানি সিগারেট বিক্রির বিপরীতে সরকারকে এই শুল্ককর দিয়েছে, যা মূলত ধূমপায়ীদের পকেট থেকেই যায়। সিগারেটের ওপর মূল্য সংযোজন কর (মূসক বা ভ্যাট) ও সম্পূরক শুল্ক আদায় করে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) ভ্যাট বিভাগ। এ বিভাগের গত অর্থবছরের সাময়িক হিসাবে শুল্ককর আদায়ের চিত্রটি পাওয়া গেছে। ধূমপানে শরীরের তাপমাত্রা বেড়ে যায়, রক্তচাপ বাড়ে, কাজকর্ম ও চলাচল বাড়ে, মেলাটোনিন, থাইরোট্রপিন, প্রোল্যাকটিন ও কটিকোট্রপিন ইত্যাদি হরমোন নিঃসরণ কমে যায়। রাতের শরীরের তাপমাত্রা ও রক্তচাপ কমে যায় এবং মেলাটনিনসহ অন্য কিছু হরমোনের ক্ষরণ বেড়ে যায়। দৈনিক এ আবর্তন এবং বাৎসরিক ঋতুচক্রের সঙ্গে আমাদের বন্ধন বায়োলজিক্যালি সেটআপ হয়ে রয়েছে বংশানুক্রমে। এ সেটআপের ছন্দপতন ঘটাচ্ছে তথাকথিত উন্নয়নের তহবিলে গড়ে ওঠা রাতের আলোকসজ্জা। আমরা রাত জেগে আলোর বন্যায় অন্দরমহলে পড়াশোনা, কাজকর্ম করি, কম্পিউটার চালাই, টিভির সামনে কারণে-অকারণে হাঁ করে বসে থাকি। তখন আমাদের শারীরবৃত্তীয় কাজ এলোমেলো হয়ে যায়। লাখ লাখ বছর ধরে গড়ে ওঠা অভিযোজন প্রক্রিয়া বিপর্যস্ত হয়। আর ক্যান্সারের মতো মরণব্যাধি তো আছেই। সব মিলিয়ে রাজধানী ঢাকার জনজীবন হুমকির কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। বর্তমান সরকার যানজট কমানোসহ রাজধানী ঢাকায় স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনার জন্য বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছে, যা বাস্তবায়ন করা জরুরি। কারণ ঢাকায় বায়ুদূষণ, শব্দদূষণ, যানজট যেভাবে বাড়ছে; তা নিয়ন্ত্রণ করা না হলে অদূর ভবিষ্যতে পরিস্থিতি জটিল আকার ধারণ করবে।

লেখক: সাবেক কর কমিশনার

প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান-ন্যাশনাল এফএফ ফাউন্ডেশন

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

গাজায় মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে ১৪ হাজার শিশু, সময় মাত্র ৪৮ ঘণ্টা

উপদেষ্টাদের জন্য ব্যক্তিগত গাড়ি কেনার প্রস্তাব ফিরিয়ে দিল সরকার

বিএনপির ৮ দিনের নতুন কর্মসূচি ঘোষণা

ফের শাহবাগ অবরোধ ছাত্রদলের 

ধেয়ে আসছে পাহাড়ি ঢল, ডুবতে পারে ৪ জেলা

ইসরায়েলকে ‘ত্যাগ’ করতে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র!

ধর্ষণের অভিযোগে কারাগারে নোবেল, মুখ খুললেন সাবেক স্ত্রী 

কারামুক্ত হওয়ার পর নুসরাত ফারিয়ার ফেসবুক পোস্ট

স্ত্রীসহ পল্লবী থানার সাবেক ওসি হাসেমের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা

সন্ধ্যা ৬টার মধ্যে যেসব জেলায় হতে পারে ঝড়

১০

নির্বাচন পেছানোর ষড়যন্ত্র হচ্ছে : মির্জা ফখরুল

১১

হান্নান মাসুদের জিম্মায় ছেড়ে দেওয়া হলো তিন সমন্বয়ককে

১২

অস্ত্র-গুলি বিক্রির সময় হাতেনাতে যুবক গ্রেপ্তার

১৩

পাকিস্তান সফরে ম্যাচ সংখ্যা কমছে লিটনদের

১৪

দুদকের তলবে সাড়া নেই স্বাস্থ্য উপদেষ্টার দুই পিওর

১৫

সংস্কার ও নির্বাচনকে মুখোমুখি করা আরেকটা অপরাধ : নজরুল ইসলাম

১৬

পড়াশোনা কম জানায় প্রশিক্ষণার্থী নারীকে অপদস্থ করলেন কৃষি কর্মকর্তা

১৭

নোবেল ও তরুণীকে নিয়ে নতুন তথ্য দিলেন আইনজীবী 

১৮

কারামুক্ত হলেন নুসরাত ফারিয়া

১৯

জোরপূর্বক ধর্ষণের মামলায় গায়ক নোবেল কারাগারে

২০
X