ড. আবদুল মান্নান চৌধুরী
প্রকাশ : ১৪ আগস্ট ২০২৩, ০২:২২ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

শাসক ও রাষ্ট্রনায়ক বঙ্গবন্ধুর মূল্যায়ন

শাসক ও রাষ্ট্রনায়ক বঙ্গবন্ধুর মূল্যায়ন

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট মহান জাতির মহান স্থপতি, মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক, বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কতিপয় বাংলাদেশি কর্তৃক প্রায় সপরিবারে নিহত হন। তার শাহাদাতবরণের পর যত সব মিথ্যা ভিত্তিহীন ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত গালগল্পের অবতারণা করেন অনেকেই; তার মধ্যে ছিলেন দেশের কতিপয় বুদ্ধিজীবী। তাদের মতে, বঙ্গবন্ধু হত্যার অন্যতম কারণ ছিল তার সাড়ে তিন বছরের শাসনামলের ব্যর্থতা। সেদিন তো বটেই, আজও সেসব বুদ্ধিজীবী বা তাদের বিভ্রান্ত উত্তরসূরি সেই ভাঙা রেকর্ড প্রায়ই বাজিয়ে থাকেন। আমার এ নিবন্ধনটি এসব লোকের জন্য নয়; নতুন প্রজন্মের জন্য। আশা করি নতুন প্রজন্ম ঠিকই বুঝে নেবে যে, আমাদের কতিপয় বুদ্ধিজীবী মানে যারা বুদ্ধি দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন কিংবা অন্যের তল্পিবাহক হয়ে মিথ্যাচারে লিপ্ত হন, তারা কতটা বিভ্রান্ত বা মিথ্যাচার?

বাংলাদেশ যখন শত্রুমুক্ত হয়, তখন রাষ্ট্রীয় কোষাগারে মাত্র ১ পাউন্ড জমা ছিল। রাস্তাঘাট, পুল, কালভার্ট, যোগাযোগব্যবস্থা তথা উন্নয়নের ভৌতিক কাঠামোগুলো ছিল বিধ্বস্ত। প্রায় চার কোটি লোক ছিল উদ্বাস্তু, এক কোটির প্রয়োজন ছিল তাৎক্ষণিক পুনর্বাসন। তদুপরি প্রায় পাঁচ লাখ বীরাঙ্গনার প্রয়োজন ছিল স্বাস্থ্যসেবা ও সম্মানজনক পুনর্বাসন। চারদিকে শুধু অভাব আর অভাব; চেতনায় ছিল ক্রমবর্ধমান প্রত্যাশার বিপ্লব। চারদিকে ছিল অস্ত্রের ঝনঝনানি এবং পলাতক যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধীদের পরিকল্পিত হত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ, সিভিল ও মিলিটারি প্রশাসনের অক্ষমতা এবং অথর্বতা, এমতাবস্থায় বঙ্গবন্ধু যা করেছেন তা ছিল বিশ্বে অনন্য। সাড়ে তিন বছরের অর্জনগুলো যে নিঃসন্দেহে অতুলনীয়, আমি তার কিছু নমুনা নিম্নে তুলে ধরছি—

১. ১৯৭২ সালে জানুয়ারি মাসে বঙ্গবন্ধুর ক্ষমতা গ্রহণের পর ১ মে নিম্ন বেতনভুক কর্মচারীদের বেতন বাড়িয়ে দেওয়া হয়। তারপর সরকারি কর্মচারীদের জন্য পে-স্কেল ঘোষণা করা হয়।

২. ১৯৭২ সালের ২৬ মার্চ প্রথম স্বাধীনতাবার্ষিকীতে ব্যাংক, বীমা, পাট শিল্প, বস্ত্র শিল্প, চিনি শিল্প, অভ্যন্তরীণ ও উপকূলীয় নৌপরিবহন খাতের বিরাট অংশ, ১৫ লাখ টাকার ঊর্ধ্বে নির্দিষ্ট সম্পত্তির অনুপস্থিত মালিকদের সব পরিত্যক্ত প্রতিষ্ঠান, বাংলাদেশ বিমান ও জাহাজ করপোরেশন জাতীয়করণের কথা ঘোষণা করা হয়।

৩. বাংলাদেশের কতিপয় ব্যাংককেও সরকারি পর্যায়ে আনা হয়। পাকিস্তানি মালিকানার এক বা একাধিক ব্যাংক একীভূত করে বাংলার ঐতিহ্যের সঙ্গে মিলিয়ে তাদের নামকরণ করা হয় সোনালী, রূপালী, পূবালী, উত্তরা ও অগ্রণী ব্যাংক; কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নামকরণ করা হয় বাংলাদেশ ব্যাংক। বিমান বহরের নামকরণ করা হয় বাংলাদেশ বিমান।

৪. সে সময় দেশে খাদ্য ঘাটতির পরিমাণ ছিল প্রায় ৩০ লাখ টন। এ ঘাটতি পূরণের জন্য প্রায় ২৭ লাখ টন খাদ্য বিদেশ থেকে আনার ব্যবস্থা করা হয়। দেশের শতকরা ৪৫ জনকে রেশনের আওতায় আনা হয়।

৫. মুক্তিযুদ্ধে ছোট-বড়সহ ধ্বংসপ্রাপ্ত রেল সেতুর সংখ্যা ছিল প্রায় ৩০০টি এবং ধ্বংসপ্রাপ্ত সড়ক ছিল ২৭৪টি। এর প্রায় সবই মেরামত করা হয়।

৬. ধ্বংসপ্রাপ্ত প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো পুনরায় দাঁড় করানো হয় এবং সব প্রাথমিক বিদ্যালয়কে জাতীয়করণ করা হয়।

৭. বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে সর্বস্তরের মুক্তিযোদ্ধারা তার অথবা তার প্রতিনিধির কাছে অস্ত্র জমা দেন। মুক্তিযোদ্ধাদের সমাজ জীবনে সম্মানজনক পুনর্বাসনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়। প্রত্যেক শহীদ পরিবারকে সান্ত্বনামূলক পত্র প্রেরণ ও আর্থিক সাহায্য প্রদান করা হয়।

৮. বঙ্গবন্ধু স্বল্প সময়ের মধ্যে দেশকে একটি অত্যন্ত মর্যাদাসম্পন্ন শাসনতন্ত্র উপহার দেন। ন্যূনতম দশ মাস সময়ের মধ্যে যে শাসনতন্ত্র তিনি উপহার দেন, তা করতে পাকিস্তানের লেগেছিল ৯ বছর এবং ভারতের লেগেছিল তিন বছর।

৯. বঙ্গবন্ধু সরকারের সাফল্যের আরেকটি দিক হচ্ছে অত্যন্ত স্বল্প সময়ের মধ্যে বাংলাদেশে অবস্থানরত ভারতীয় সেনাবাহিনীর সম্মানে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন। বঙ্গবন্ধুর অনুরোধে মহীয়সী শ্রীমতি ইন্ধিরা গান্ধী ত্বরিত ব্যবস্থা নিয়েছিলেন।

১০. জাতিসংঘসহ সব আন্তর্জাতিক সংগঠনে সদস্যপদ লাভসহ পাকিস্তান এবং আরও ১৩৯টি দেশের স্বীকৃতিপ্রাপ্তি বঙ্গবন্ধু সরকারের কূটনৈতিক সাফল্যের অন্যতম দিক। সে আমলে গৃহীত বৈদেশিক নীতি তথা ‘সকলের জন্য বন্ধুত্ব, কারো জন্য বৈরিতা নয়’, আজও বলবৎ। এ কারণে বাংলাদেশ বৃহৎ শক্তির টানাপোড়েন থেকেও স্বস্তির মধ্যে রয়েছে।

১১. একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে শিক্ষাঙ্গনগুলোকে তিনি পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করেন এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্য একটি গণতান্ত্রিক অ্যাক্ট প্রবর্তন করেন যার নাম বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ, ১৯৭৩।

১২. তিনি শিক্ষাব্যবস্থাকে একটি স্বাধীন দেশের উপযোগী করে তোলার জন্য বিজ্ঞানী কুদরত-ই-খুদার নেতৃত্বে একটি শিক্ষা কমিশন গঠন করেন, যার রিপোর্ট আজও প্রাসঙ্গিক বলেই শেখ হাসিনার সরকার তার সামগ্রিক বাস্তবায়নে ব্রতী।

১৩. দেশের অর্থনৈতিক পুনরুজ্জীবন ও সাংস্কৃতিক বিকাশ ছিল তার শাসন আমলের প্রধান লক্ষ্য। তাই জাতীয় প্রতিষ্ঠান বাংলা একাডেমিকে তিনি ঢেলে সাজানোর চেষ্টা করেন এবং সাংস্কৃতিক বিকাশের জন্য শিল্পকলা একাডেমি প্রতিষ্ঠা করেন।

১৪. বঙ্গবন্ধু ২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা মাফ করে দেন এবং জমির মালিকানা ১০০ বিঘায় স্থির করেন।

১৫. ভূমিহীন কৃষকরা যাতে বাঁচতে পারে, সে জন্য তিনি ভূমি বণ্টন ব্যবস্থার পরিবর্তন করেন। কৃষকদের ঋণ মওকুফ করেন এবং কৃষকরা যাতে স্বল্পমূল্যে বীজ ও সার লাভ করতে পারে, সে জন্য যথাযথ ব্যবস্থা চালু করেন। তিনি কৃষিতে সমবায়ের উদ্যোগ এমনভাবে নিয়েছিলেন যাতে ভূমিমালিক, ভূমিশ্রমিক, সরকার এবং সাধারণ জনগণ উপকৃত হয়।

১৬. দেশকে স্বনির্ভর ও সমৃদ্ধ করার জন্য বঙ্গবন্ধুর আন্তরিকতা ছিল গভীর এবং আগ্রহ ছিল প্রচণ্ড। সে কারণে যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশে অর্থনৈতিক সংকট সৃষ্টির সম্ভাবনাকে প্রাথমিকভাবে প্রতিহত করা সম্ভব হয় এবং প্রবৃদ্ধির হার ৭.৮ শতাংশে দাঁড়ায়।

১৭. পুলিশ বাহিনীর সীমাবদ্ধতা কাটাতে নিরাপত্তা বাহিনীকে তিনি এমনভাবে পুনর্বিন্যাস করেন, যাতে আইনশৃঙ্খলার উন্নতি সাধিত হয়।

১৮. দেড় বছরের মধ্যে পরিকল্পনা কমিশন প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা প্রণয়ন সমাপ্ত করে। এসব ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তা এবং তার অবস্থানই প্রধান ভূমিকা পালন করেছে।

১৯. গণতন্ত্র তথা দেশের ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব স্তরের মানুষের সমঅধিকার প্রতিষ্ঠার উদার নীতিতে বিশ্বাসী হয়ে তিনি ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রের বদলে একটি আদর্শ ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র গঠনের বাস্তব পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। তার ধর্মনিরপেক্ষতা কিন্তু পশ্চিমা Secularism নয়, তা ছিল সব ধর্মের মানুষ নিজ নিজ ধর্ম নির্বিবাদে পালন করার অঙ্গীকার ও বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ।

২০. তার আমলে যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের বিপর্যস্ত যোগাযোগব্যবস্থা এবং অচল বন্দরগুলো সচল করার সফল উদ্যোগ নেওয়া হয় ও স্বল্পতম সময়ের মধ্যে যুদ্ধে নিহত শহীদ পরিবার ও পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধাদের দেশ-বিদেশে চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের বাস্তব পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়।

২১. চাকরির ক্ষেত্রে মুক্তিযোদ্ধাদের অগ্রাধিকার প্রদান করে হাজার হাজার মুক্তিযোদ্ধার জন্য চাকরির ব্যবস্থা করা হয়।

২২. সেনাবাহিনী, বিডিআর, পুলিশ বাহিনী পুনর্গঠন, আধুনিকীকরণ ও উন্নয়নের ব্যবস্থা নেওয়া হয়। বঙ্গবন্ধু আমলেই স্থাপিত হয় মিলিটারি একাডেমি।

২৩. তিনি ইসলামিক ফাউন্ডেশন, পিজি হাসপাতাল, মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট গঠন করেন এবং শেষোক্তটির নামে পরিত্যক্ত সম্পত্তির মালিকানা হস্তান্তর করেন।

২৪. ভারত প্রত্যাগত এক কোটি শরণার্থীর পুনর্বাসন আর দেশের অভ্যন্তরে ভিটেমাটি ও সহায় সম্পদহারা প্রায় তিন কোটি মানুষের পুনর্বাসন তিনিই সফলভাবে সমাপ্ত করেন।

২৫. প্রায় ৪ লাখ ৬৯ হাজার মতান্তরে ৫ লাখ লাঞ্ছিতা ও পরিত্যক্তদের শুধু অভিভাবকত্বই নয়, সসম্মানে পুনর্বাসনের ব্যবস্থাও ছিল তার সময়ের অনবদ্য কীর্তি। এ ব্যাপারে বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব অনন্য ভূমিকা পালন করেন।

লেখক : বীর মুক্তিযোদ্ধা ও বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

ন্যূনতম কর একটা কালাকানুন : এনবিআর চেয়ারম্যান

ঈদে মিলাদুন্নবীর ছুটি যেদিন

শপথ নিলেন হাইকোর্টের ২৫ বিচারপতি

সাকিবের প্রিয় ‘শিকারের’ তালিকায় তামিম, দেখে নিন পুরো তালিকা

‘ভয়ংকর আফ্রিদির’ মুখোশ খুললেন তানভীর রাহী

ঢাকায় বিজিবি-বিএসএফ মহাপরিচালক পর্যায়ের সীমান্ত সম্মেলন শুরু

তথ্য গোপন করে প্রধান শিক্ষক, অতঃপর...

পুঁজিবাজারের প্রতারক চক্র গোয়েন্দা সংস্থার নজরে: ডিএসই

পরিবর্তন হচ্ছে বাংলাদেশ জেলের নাম 

চট্টগ্রামে সেপটিক ট্যাঙ্কে নেমে ২ শ্রমিকের মৃত্যু

১০

রাতে খাওয়ার পরও ক্ষুধা লাগার কারণ জেনে নিন

১১

বৃষ্টি-গরম নিয়ে নতুন বার্তা দিল আবহাওয়া অফিস

১২

প্রেমের স্মৃতি টেনে কিমের সঙ্গে দেখা করতে চাইলেন ট্রাম্প

১৩

কমলাপুর রেলস্টেশনে নারীকে কুপিয়ে হত্যা, প্রেমিক আটক

১৪

নদীভাঙনের কবলে শতবর্ষী স্কুল, হুমকিতে মাঠ ও শহীদ মিনার

১৫

আবারও সেরা ব্রাজিল, কলম্বিয়াকে হারিয়ে জিতল টানা তৃতীয় শিরোপা

১৬

দুদিন বন্ধ থাকবে ঢাবি মেট্রো স্টেশন

১৭

‘দৈনিক আজকের কণ্ঠ’ নামের পেজটি গুজব তৈরির প্ল্যাটফর্ম : বাংলাফ্যাক্ট

১৮

সরকারি ইজারাবিহীন বালুমহালে মোবাইল কোর্টের হানা

১৯

পর্দায় শুভশ্রীর সঙ্গে নিজেকে দেখে অশ্রুসিক্ত দেব

২০
X