ড. মো. জামাল উদ্দিন
প্রকাশ : ০৫ জানুয়ারি ২০২৫, ০২:০১ এএম
আপডেট : ০৫ জানুয়ারি ২০২৫, ০৯:৫২ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

সবজির দামের উত্থানপতনের প্রতিকার

সবজির দামের উত্থানপতনের প্রতিকার

বাজারে প্রায় সব সবজির দাম বেশ কম! বেশিদিন হয়নি এসব সবজির দাম নিয়ে বাজার ছিল রীতিমতো সরগরম। সরকারের সমালোচনা করতেও পিছপা হয়নি অনেকে। কম দামে সবজি পেলে ভোক্তাদের মুখে হাসি ফোটে। অনুযোগ বা অভিযোগ আর থাকে না। সরকারের দিকেও তীর ছোড়ে না। কিন্তু যে কৃষক মাথার ঘাম পায়ে ফেলে অনেক শ্রমের বিনিময়ে এসব ফসল ফলান, তারা যখন দাম পান না, তখন উৎপাদনে আগ্রহ হারান। যদিও নিজেদের প্রয়োজনে বা দাম পাওয়ার আশায় পরবর্তী বছর আবার উৎপাদনে পা বাড়ান। এ ছাড়া তাদের কাছে আর বিকল্পও নেই। উৎপাদন খরচ পুষিয়ে কৃষক কিছু লাভ করতে না পারলে তাদের মুখ মলিন হয়। সম্প্রতি মুলা ও ফুলকপির দাম না পাওয়ার কারণে অনেক কৃষককে মাঠেই ফুলকপি নষ্ট করতে দেখা যায়। এটি কৃষকের ক্ষোভ, রাগ, দুঃখ, অভিমান থেকেই হচ্ছে বলা যায়। কৃষক পণ্যের ন্যায্য দাম পাক, সেটা কে না চায়?

কৃষক চায় ন্যায্যমূল্য, ভোক্তা চায় কম মূল্য আর ব্যবসায়ীরা চায় বেশি মূল্য। এ তিন মূল্যের সমন্বয় করে একটি স্থিতিশীল বা ভারসাম্য মূল্য নির্ধারণ করা বেশ চ্যালেঞ্জিং হলেও এটি করা দরকার। আর তা করতে হলে মূল্য কমিশন গঠনের বিকল্প নেই। বাজারে সবজির দাম উৎপাদন, সরবরাহ ও চাহিদা—এ তিন চলকের ওপর নির্ভর করে। উৎপাদন বৃদ্ধি পেলে সরবরাহ বাড়বে, এটি স্বাভাবিক। তবে চাহিদার তুলনায় সরবরাহ বেশি হলে হয় দাম কমবে, না হয় সবজি পচবে! কারণ সবজি সংরক্ষণের মতো ব্যবস্থা আমাদের দেশে এখনো গড়ে ওঠেনি। বেশিরভাগ সবজি দ্রুত পচনশীল। এসব পচনশীল সবজি যত দ্রুত বিক্রি করা যায় ততই ভালো। তাজা সবজির চাহিদা হরহামেশাই বেশি থাকে। এলাকাভিত্তিক চাহিদার তুলনায় সরবরাহ যখন বেড়ে যায়, তখন দাম কমে যায়। বেশিদিন হয়নি যখন সবজির দাম বেশ চড়া ছিল, তখন অনেকে উৎপাদন কম হওয়া, সরবরাহে বিঘ্ন ঘটা বা সিন্ডিকেটকে দায়ী করেছেন। সবজির ক্ষেত্রে সিন্ডিকেট বেশি কার্যকর হওয়ার কথা নয়। কেননা বেশিরভাগ সবজি দ্রুত পচনশীল। এটি ধরে রেখে বা গোপনে মজুত রেখে কয়দিনই বা রাখতে পারবে। রাখতে গেলেই এটির তাজাভাব নষ্ট হবে, ফলে এসব সবজি ভোক্তারা কিনতে চাইবে না।

তবে আলুর দাম বৃদ্ধির ক্ষেত্রে এ কথা প্রযোজ্য না। আলু সংরক্ষণ করে ৩-৬ মাস বা বছরখানেকও রাখা যায়। এটি সংরক্ষণ করার মতো সুযোগও আছে। তাই আলুর ক্ষেত্রে সিন্ডিকেট তৈরি হওয়ার সুযোগ থাকে। কিন্তু যখন কাঁচামরিচের দাম আকাশচুম্বী হয়ে যায়, তখন উৎপাদন ঘাটতিকে দায়ী করা যায়। কেননা কাঁচামরিচ দ্রুত পচনশীল। শীত মৌসুমে কাঁচামরিচ অধিক উৎপাদন হওয়ার কারণে বাজারে সরবরাহ বেড়েছে, তাই দামও বেশ কম। সবজি সরবরাহ চেইন আগে যা ছিল, বর্তমানেও তাই আছে। মাস দুয়েক আগে প্রায় সব সবজির দাম ছিল আকাশচুম্বী। সেসব সবজির দাম এখন বেশ কম। এর অন্যতম কারণ উৎপাদন বেড়েছে, তাই সরবরাহও বেড়েছে। তাই বলা যায়, সবজির দামের উত্থানপতন নির্ভর করে এর উৎপাদন কম-বেশি হওয়ার কারণে। তাই অমৌসুমে সবজি উৎপাদন বৃদ্ধির ওপর অধিক গুরুত্ব দিতে হবে। তবে অমৌসুমে আবহাওয়াজনিত কারণ যেমন বন্যা, অতিবৃষ্টি ও ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে উৎপাদন বাধাগ্রস্ত হয়। এর জন্য জলবায়ু সহনশীল জাত উদ্ভাবন, বিস্তার দরকার।

শস্য বীমা চালুসহ কৃষকপর্যায়ে জলবায়ু অভিযোজন ক্ষমতা বৃদ্ধি বা কৌশলগুলো রপ্ত করা গেলে এর কিছুটা সুরাহা মিলবে। জলবায়ু অভিযোজন কৌশল হিসেবে বলা যায়, পলি টানেলে বা গ্রিনহাউসে বাণিজ্যিকভাবে সবজি উৎপাদনে কৃষকদের উপকরণ ও কারিগরি সহায়তা প্রদান করা গেলে বছরব্যাপী সবজি উৎপাদন বাড়বে। প্রতিটি বসতবাড়ির ছোট্ট জায়গায়ও যদি পলি টানেলে সারা বছর উৎপাদনে আগ্রহ বাড়ানো যায়, তাহলে প্রতিটি পরিবারের সবজির চাহিদা মিটবে এবং বাজারের ওপর চাপ কমবে। আধুনিক কৃষি বলতে প্রযুক্তির ব্যবহারকে বোঝায়। তবে পলি টানেল ব্যবহারে পরিবেশ সুরক্ষার বিষয়টিও বিবেচনায় রাখতে হবে। এর জন্য পরিবেশসম্মত পলিশেড উৎপাদন ও ব্যবহারে গুরুত্ব দিতে হবে। অমৌসুমে সবজির বাণিজ্যিক চাষাবাদে যে এলাকায় যেসব সবজি বেশি উৎপাদন হয়, সেসব জায়গায় অধিক উৎপাদনে গুরুত্ব দিতে হবে। এরপর সরবরাহ চেইন ঠিক রেখে সুষ্ঠু ও কার্যকর বাজার ব্যবস্থা গড়ে তুলে সারা দেশে অমৌসুমে সবজির সরবরাহ বাড়াতে পারলে দামের উত্থান তুলনামূলক কম হবে। শীত মৌসুমে সবজির উৎপাদন তুলনামূলকভাবে অনেক বেড়ে যায়। ফলে স্থানীয় বাজারে এসব সবজির সরবরাহ বাড়ে। ফলে দাম অনেক কমে যায়। দাম কমলে ভোক্তারা খুশি, কিন্তু কৃষকের উৎপাদন খরচ ওঠে না, এলে তারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ ক্ষেত্রে উৎপাদন খরচ কমাতে কৃষককে উদ্বুদ্ধ করতে হবে।

কৃষকের ক্ষতি রোধ করতে হলে যে এলাকায় অধিক উৎপাদন হবে, সেখান থেকে সবজি অন্যত্র দ্রুত সরবরাহ করার সুব্যবস্থা থাকতে হবে। এর জন্য দরকার প্রতিটি জেলায় বা উপজেলায় ন্যূনতম একটি করে ‘কৃষক বাজার’ গড়ে তোলা। সেখানে পণ্য সংগ্রহ ও সরবরাহ এর একটি ব্যবস্থাপনা কমিটি থাকবে, তারা কৃষকের কাছ থেকে ন্যায্য দামে পণ্য গ্রহণ করে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বাজার অনুসন্ধান করে চাহিদা মাফিক দ্রুততার সহিত পণ্য সরবরাহ করবে। আর কৃষককে পণ্যের ন্যায্যমূল্য বুঝিয়ে দেবে। সেটি চুক্তির মাধ্যমে ‘বিক্রয়োত্তর মূল্য পরিশোধ’-এ নীতিতেও হতে পারে। প্রতিটি জেলায় ‘কৃষক বাজার’ গড়ে তুলতে বেসরকারি কোম্পানি বা ধনী কৃষি উদ্যোক্তারা এগিয়ে আসতে পারেন। সেক্ষেত্রে জেলা বা স্থানীয় প্রশাসন, কৃষি অফিস, কৃষি বিপণন অধিদপ্তর, বিএসটিআই, ভোক্তা অধিকার, পরিবহন সেক্টর—সবাই সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে কৃষক বাজার কমিটিকে সহায়তা প্রদান করতে পারে।

তবে এ কাজটি সফলভাবে এগিয়ে নিতে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতার প্রয়োজন আছে। প্রতিটি উপজেলায় একটি করে ‘কৃষক বাজার’ গড়ে তোলার মাধ্যমে দেশের এক কৃষক বাজারের সঙ্গে অন্য কৃষক বাজারের কানেকটিভিটি বাড়াতে পারলে এর টেকসই বাড়বে। মৌসুম অনুযায়ী এলাকাভিক্তিক সবজির চাহিদা ও সঠিক উৎপাদন তথ্য জানা থাকলে পরিকল্পনা গ্রহণ সহজ হয়। একটি স্থায়ী ‘কৃষক বাজার’ গড়ে তোলার মাধ্যমে মৌসুমে সবজি উদ্বৃত্ত এলাকা থেকে সবজি ঘাটতি এলাকায় নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ বাড়াতে হবে। সবজি সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণ বিষয়টিও ভাবা যেতে পারে, যাতে কৃষক ন্যায্যমূল্য পায়। মৌসুম অনুযায়ী এলাকাভিত্তিক সবজির চাহিদা, উৎপাদন, জোগান, তথ্য সংগ্রহ ও সংরক্ষণের মাধ্যমে একটি ডাটাবেজ তৈরি করা যেতে পারে। এর ওপর ভিত্তি করে প্রতিটি সবজির একটি ভারসাম্য দাম নির্ধারিত হতে পারে। কৃষক সংগঠনকে শক্তিশালীকরণের মধ্য দিয়ে একটি কার্যকর ও দক্ষ বাজার ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা গেলে অমৌসুম বা মৌসুমে সবজির দামের উত্থানপতন অনেকটা রোধ করা সম্ভব।

লেখক: কৃষি অর্থনীতিবিদ, গবেষক ও কলামিস্ট

Email: [email protected]

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

কেইনের হ্যাটট্রিকে লেইপজিগকে উড়িয়ে দিল বায়ার্ন

নিখোঁজের একদিন পর যুবকের মরদেহ মিলল পুকুরে

বিশ্বকাপের গ্রুপ পর্বের ড্রয়ের তারিখ ঘোষণা করলেন ট্রাম্প

এশিয়া কাপ দলে জায়গা পেয়ে সোহানের কৃতজ্ঞতার বার্তা

ঘুষ কেলেঙ্কারিতে পুলিশ কর্মকর্তা প্রত্যাহার

প্রবীণদের বিশেষ যত্ন নিয়ে বার্ধক্যের প্রস্তুতি নিন: স্বাস্থ্য সচিব

বিভুরঞ্জন সরকারের মৃত্যু অনাকাঙ্ক্ষিত: রাষ্ট্রদূত আনসারী

লা লিগার কাছে যে অনুরোধ করতে চায় বার্সা

‘নির্বাচনে আমলাদেরকে নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করে গ্রহণযোগ্যতার প্রমাণ দিতে হবে’

সাবেক এডিসি শচীন মৌলিক কারাগারে

১০

পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ঢাকা আসছেন শনিবার, যেসব বিষয়ে আলোচনা

১১

সিদ্ধিরগঞ্জে হেফাজতে ইসলামের শানে রিসালাত সম্মেলন

১২

শেষ দিনেও ‘জুলাই সনদ’ নিয়ে মতামত দেয়নি ৭ রাজনৈতিক দল

১৩

ইউরোপের লিগগুলোতে দল কমানোর প্রস্তাব ব্রাজিল কোচ আনচেলত্তির

১৪

নেপালে মার্কিন কর্মকর্তার সঙ্গে বৈঠকের প্রচার, তাসনিম জারার ব্যাখ্যা

১৫

মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ে মৃত্যুর মিছিল, তিন বছরে প্রাণ হারান ১৮৩ জন

১৬

স্বর্ণ ব্যবসায়ীর বাড়িতে দুর্ধর্ষ ডাকাতি 

১৭

সুদ দিতে না পারায় বসতঘরে তালা, বারান্দায় রিকশাচালকের পরিবার

১৮

দেশ বাঁচাতে পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন দিতে হবে : চরমোনাই পীর

১৯

এএসপির বাসায় চাঁদাবাজি-ভাঙচুর, যুবলীগ নেতা গ্রেপ্তার

২০
X