একটি কথা আমাদের দেশে প্রবাদ বাক্যের মতো চালু আছে—‘ভালো মানুষরা রাজনীতি করে না।’ কখন থেকে এ বাক্যটির প্রচলন, দিনক্ষণ হিসাব করে তা বলা যাবে না। তবে ধারণা করা যায়, দীর্ঘদিন ধরে রাজনৈতিক অঙ্গনে অসৎ, নীতি-আদর্শহীন ও দুর্বৃত্ত-দুর্জনের সমাগমের প্রাবল্যে এ অপ্রিয় সত্য কথাটির প্রচলন ঘটে থাকবে। এটা তো অস্বীকার করার উপায় নেই যে, আমাদের দেশের রাজনীতিতে এখন নীতি-আদর্শ অনেকটাই অপাঙক্তেয় হয়ে পড়েছে। রাজনীতিকরা মুখে নীতিকথা আওড়ালেও কাজে তার স্বাক্ষর রাখেন কদাচিৎ। সৎ, নিষ্ঠাবান ও নীতি-আদর্শে অবিচল নেতাকর্মী খুঁজে পাওয়া এখন দুষ্কর। রাজনীতিতে সৎ মানুষের এই যে মঙ্গা, এর জন্য দায়ী রাজনৈতিক নেতৃত্বের দৃষ্টিভঙ্গি। তারা পৃষ্ঠপোষকতা দেন না বলেই ভালো মানুষরা রাজনীতিতে জায়গা পান না। শুনতে খারাপ শোনা গেলেও স্বীকার করতে দ্বিধা থাকার কথা নয়, আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব ভালোদের চেয়ে মন্দদের কাছে টানেন বেশি। এর অবশ্য একটি কারণ আছে। মন্দ মানুষগুলোকে দিয়ে স্বার্থ হাসিলের যে অনৈতিক কাজটি সহজেই করিয়ে নেওয়া যায়, ভালো মানুষদের দ্বারা তা সম্ভব নয়। সেজন্যই নেতাদের পছন্দ মন্দ মানুষ। তবে সৎ ও আদর্শবান মানুষ রাজনীতিতে একেবারেই নেই বলাটা ঠিক হবে না। অবশ্যই ভালো মানুষরাও রাজনীতিতে আছেন। তবে সংখ্যায় তারা অতিনগণ্য। যারা আছেন, তারা আদর্শহীন, অসৎ আর লুটেরা-লুম্পেনদের দাপটে সদাসর্বদা ম্রিয়মাণ থাকেন। তারা দলের কোনো গুরুত্বপূর্ণ পদলাভ করতে পারেন না, নির্বাচনে মনোনয়ন পান না। অবহেলা-অবজ্ঞার শিকার হয়ে অনেকটা বৃন্তচ্যুত ফুলের মতো পড়ে থাকতে থাকতে একসময় শুকিয়ে যান। একপর্যায়ে রাজনীতিকে ‘গুড বাই’ জানাতে বাধ্য হন।
সাধারণ মানুষ এখন রাজনীতিকে ভালো চোখে দেখে না। তাদের কাছে রাজনীতি মানেই একশ্রেণির মানুষের বিত্তবৈভব গড়ার কলাকৌশল। রাজনীতিতে যোগ দিতে পারলেই নাকি ‘আলিবাবা চল্লিশ চোর’ গল্পের মতো রত্নভান্ডারের গোপন গুহা ‘চিচিং ফাঁক’ হয়ে খুলে যায়। কথাটি একেবারে অমূলক নয়। রাজনৈতিক জার্সি গায়ে দিয়ে বহু কপর্দকহীন ভবঘুরেকে জাদুমন্ত্রের বলে বেসুমার অর্থ-সম্পদের মালিক হতে দেখছে এ দেশের মানুষ। মুখে দেশ ও জনগণের স্বার্থের জন্য জান কোরবান করার কথা বললেও কাজে ঠিক উল্টোটা। কবি কামিনী রায় তার কবিতায় বলেছেন, “পরের কারণে স্বার্থ দিয়া বলি,/ এ জীবন মন সকলই দাও/ তার মত সুখ কোথাও কি আছে?/ আপনার কথা ভুলিয়া যাও”। কিন্তু আমাদের এত শ্রেণির রাজনীতিক আপন স্বার্থে বলি দেন দেশ ও জনগণের স্বার্থ। তারা নিজের কথা ভোলেন না, ভোলেন দেশ ও জনগণের কথা।
দেশে এখন এমন কোনো অভিভাবক খুঁজে পাওয়া যাবে না, যিনি বা যারা তাদের সন্তানকে রাজনীতিতে যোগ দিতে উৎসাহ দেন বা নিজেরা উৎসাহবোধ করেন। বরং তারা নানাভাবে সন্তানদের উপদেশ দেন রাজনীতি নামের কর্মটির চৌহদ্দি থেকে শতহাত দূরে থাকতে। প্রতি বছর বিশ-পঁচিশ লাখ কিশোর-কিশোরী এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হচ্ছে। তাদের মধ্যে যারা কৃতিত্বপূর্ণ রেজাল্ট করে, সংবাদমাধ্যমে তাদের সাক্ষাৎকার বেরোয়। জীবনের লক্ষ্য কী—এ প্রশ্নের উত্তরে কেউ ডাক্তার, কেউ ইঞ্জিনিয়ার, কেউ বিসিএস ক্যাডার, কেউবা জজ-ব্যারিস্টার হওয়ার আকাঙ্ক্ষার কথা জানায়। কিন্তু আজতক কাউকে বলতে শুনিনি, ‘আমি রাজনীতিক হব।’ বরং রাজনীতি সম্বন্ধে জানতে চাইলে তারা নেতিবাচক মনোভাব ব্যক্ত করে থাকে। একটি দেশের তরুণ সমাজের রাজনীতির প্রতি এই যে অনীহা, এটা একদিনে বা বিনা কারণে সৃষ্টি হয়নি। রাজনীতির কদর্য দিকগুলো দেখতে দেখতে তারা হয়ে পড়েছে বীতশ্রদ্ধ। ফলে মেধাবী ও সৎ ছেলেমেয়েরা এদিকে পা বাড়ায় না। এ সুযোগে সে জায়গাটা দখল করে নিচ্ছে অসৎ ব্যক্তিরা।
একটা সময় ছিল যখন মানুষ রাজনীতিকদের অতিশয় সম্মান করত। তখন রাজনীতিকদের পরিচয় ছিল দেশ ও জাতির খেদমতগার হিসেবে। তাদের দেখে তরুণ-যুবকরা রাজনীতিতে নাম লেখাত। নিজের গাঁটের পয়সা খরচ করে দলের জন্য কাজ করত তারা। ‘রাজনীতি করলে বিত্তবান হওয়া যায়’—এ ধারণাই কারও ছিল না সে সময়। বরং আমাদের অনেক প্রাতঃস্মরণীয় পূর্বসূরি রাজনীতিবিদ ছিলেন, যারা রাজনীতি করতে এসে সম্পদ খুইয়ে নিঃস্ব হয়েছেন। পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের (আজকের আওয়ামী লীগের পূর্ব প্রজন্ম) প্রতিষ্ঠাকালীন কোষাধ্যক্ষ ছিলেন ইয়ার মোহাম্মদ খান। পুরান ঢাকায় তার কারকুনবাড়ি লেনের বাড়িতেই দলটির প্রথম অফিস হয়েছিল। দলের সভাপতি মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ঢাকায় এলে সে অফিসেই থাকতেন। বেশ কয়েক বছর আগে মরহুম ইয়ার মোহাম্মদ খানের স্ত্রী একজন গবেষককে বলেছিলেন, ‘ঢাকায় ইয়ার মোহাম্মদ খানের বেশ কয়েকটি বাড়ি ছিল। তিনি একটি করে বাড়ি বিক্রি করেছেন আর দলের পেছনে খরচ করেছেন। আর আজকাল শুনি মানুষ নাকি রাজনীতিতে এসে বাড়ি-গাড়ি করে।’ তিনি যে এতটুকু বাড়িয়ে বলেননি, তা বর্তমানে রাজনৈতিক দলগুলোর একশ্রেণির নেতাকর্মীর দিকে তাকালেই বোঝা যায়।
গত বছর ৫ আগস্ট যে রাজত্বটির অবসান ঘটেছে, সেটার আমলনামার দিকে তাকালে চক্ষু চড়কগাছ না হয়ে যায় না। পিয়ন থেকে মন্ত্রী-এমপি, এমনকি স্বয়ং ‘মন্ত্রী-প্রধান’ ও তার স্বজন-সন্তানরা পর্যন্ত মেতে উঠেছিলেন লুটপাটের মহোৎসবে। এ লুটপাটের যারা কারিগর, তারা কিন্তু সাধারণ্যে পরিচিত ‘রাজনীতির মানুষ’ হিসেবেই। ফলে দোষটা সেই রাজনীতি নামের নন্দ ঘোষের ওপরই পড়ছে। অবশ্য এটাও সত্যি, সব আমলেই পিয়ন-চাপরাশি, আমলা-কামলা, মন্ত্রী-যন্ত্রীদের অর্থবিত্তে ফুলেফেঁপে ওঠার নজির রয়েছে। পরিমাণে কম আর বেশি। আর সেজন্যই আজকাল রাজনীতিতে সম্পৃক্ত মানুষদের দিকে লোকজন ট্যারা চোখে তাকায়। লোকটা রাজনীতি করে অথচ দুই নম্বরি পথে পয়সা কামায় না, এটা যেন বিশ্বাসযোগ্য নয়।
রাজনীতির এমন হতশ্রী দশার সময়ে দলে আদর্শবান ও মেধাবীদের স্থান করে দেওয়ার কথা বলেছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। গত ২০ জানুয়ারি দলটির সদস্য নবায়ন কর্মসূচির উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে তিনি বলেছেন, ‘দল পুনর্গঠনের পর আমরা রাষ্ট্রকেও পুনর্গঠন করব। ৩১ দফা কার্যকর করা হবে। সেজন্য মেধাবী, সৎ ও আদর্শবান মানুষকে দলে আনতে হবে। দলকে সমৃদ্ধ করতে হবে। আমাদের ভালো মানুষ দরকার।’ (দৈনিক কালবেলা, ২১ জানুয়ারি, ২০২৫)। তারেক রহমানের এ বক্তব্য সাধুবাদযোগ্য। বলা যায়, তিনি এ দেশের মানুষের মনের কথারই প্রতিধ্বনি করেছেন। কেননা, এ দেশের রাজনীতি আজ যে পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছে, তা থেকে সুস্থধারায় ফিরিয়ে আনতে হলে ভালো মানুষদের সম্পৃক্ত করার বিকল্প নেই। কিন্তু প্রশ্ন হলো, তা কি সম্ভব হবে? তিনি কি পারবেন তার দলের বিভিন্ন পর্যায়ে আসন গেড়ে বসে থাকা অসৎ ও দুর্নীতিবাজ নেতাকর্মীদের দল থেকে বের করে দিতে? আর যদি সে উদ্যোগ নেনও, তাহলে অবস্থা হয়তো দাঁড়াবে কম্বলের পশম বাছার মতো। ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগের পতনের পর ‘ক্ষমতার দোরগোড়ায় এসে গেছি’ ভেবে বিএনপির একশ্রেণির নেতাকর্মী সারা দেশে যেসব ন্যক্কারজনক ঘটনার জন্ম দিয়েছে, তাতে যে কারও আশাহত হওয়ার কথা। দখল, চাঁদাবাজিসহ নানা কিসিমের অপরাধে পাঁচ মাসে দলটির প্রায় দেড় হাজার নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। তারপরও কি তাদের অপকর্ম বন্ধ হয়েছে? তা ছাড়া দলকে নিয়ন্ত্রণ করতে পাঁচ মাসে যদি দেড় হাজার নেতাকর্মীকে বহিষ্কার করতে হয়, তাহলে পাঁচ বছরে কতজনকে শাস্তির গিলোটিনে দিতে হবে, ভাবলে আতঙ্কিত হতে হয়।
রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপির একটি আলাদা ঐতিহ্য রয়েছে। এমন একজন মানুষ এই দলটির প্রতিষ্ঠাতা, যিনি ছিলেন আক্ষরিক অর্থেই সৎ ও আদর্শবান, দুর্নীতি যাকে এতটুকু স্পর্শ করতে পারেনি। একজন সৎ ও সাচ্চা দেশপ্রেমিক হিসেবে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান সমাদৃত। একটি ঘটনা এখানে উল্লেখ করছি—১৯৮০ সালে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রীয় সফরে সম্ভবত মিশরে গিয়েছিলেন। তার সফরসঙ্গীদের মধ্যে ছিলেন জাতীয়তাবাদী যুবদলের কেন্দ্রীয় নেতা খোরশেদ আলম। দেশে আসার সময় তিনি একটি ভিসিআর নিয়ে এসেছিলেন। ভিভিআইপি ফ্লাইটে আসার সুবাদে তিনি শুল্ক পরিশোধ না করেই সেটা ছাড়িয়ে নিয়েছিলেন। কয়েক দিন পর জিয়াউর রহমান গিয়েছেন যশোরে। ফেরার পথে বিমানে পত্রিকায় দেখলেন যুবদল নেতার শুল্ক ফাঁকিসংক্রান্ত খবরটি। ঢাকায় ফিরে তিনি সঙ্গে সঙ্গে ওই যুবদল নেতাকে চিরতরে দল থেকে বহিষ্কার ও ভিসিআরের শুল্ক আদায়ের নির্দেশ দিয়েছিলেন।
সৎ রাজনীতিবিদ জিয়াউর রহমান প্রতিষ্ঠিত দলের কাছে তাই এ দেশের মানুষের প্রত্যাশা—এই দলে কোনো অসৎ লোকের যেন জায়গা না হয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলো, এই দলেও অসৎ ও সমাজে প্রশ্নবিদ্ধ কিছু মানুষের দেখা পাওয়া যায়; যারা ব্যক্তিগত স্বার্থ হাসিল করতে গিয়ে দলকে কলুষিত করেছে। বিএনপির শুভানুধ্যায়ী ও শুভাকাঙ্ক্ষীরা ওইসব অসৎ ও দুর্নীতিবাজের কবল থেকে দলকে উদ্ধারের কথা বলে আসছেন দীর্ঘদিন ধরেই। কিন্তু সে উদ্যোগ পরিলক্ষিত হয়নি। ঠিক এমনি সময়ে তারেক রহমানের বিএনপিতে সৎ, আদর্শবান ও ভালো মানুষের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করা ও সে কথা প্রকাশ্যে বলাকে অনেকেই ইতিবাচক সংকেত হিসেবে দেখছেন। এটাকে তারা এ দেশের গণমানুষের আকাঙ্ক্ষারই প্রতিফলন মনে করছেন। কেননা, এ দেশের মানুষ রাজনৈতিক দলে ভালো মানুষের সমাবেশ দেখতে চায়। গণমানুষের সে প্রত্যাশা পূরণের দায়িত্ব রাজনৈতিক নেতৃত্বের ওপরই বর্তায়।
একশ্রেণির অসৎ মানুষের কারণে রাজনীতি আজ কলুষিত। কিছু খারাপ মানুষের কারণে জনসেবার সবচেয়ে উৎকৃষ্ট এ মাধ্যমটি তার অতীত গৌরব হারিয়ে ফেলেছে। রাজনীতির সে হৃতগৌরব ফিরিয়ে আনা সম্ভব এ অঙ্গন থেকে খারাপ মানুষগুলোকে বিতাড়িত করে ভালো মানুষদের অংশগ্রহণের দ্বার অবারিত করে। আর এ ক্ষেত্রে বিএনপি নেতা তারেক রহমান প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করে তার বক্তব্যের যথাযথ প্রতিফলন ঘটিয়ে সৃষ্টি করতে পারেন নতুন ইতিহাস।
লেখক: সাংবাদিক ও রাজনীতি বিশ্লেষক