নবগঠিত রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) এখন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। দলটি যে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে গঠিত হয়েছে, তা কতদূর সফলতা পাবে তা নিয়ে নানাজন নানা কথা বলছেন। এতদিন যারা দেশে বিএনপি-আওয়ামী লীগের মাঝখানে তৃতীয় আরেকটি রাজনৈতিক শক্তির অভ্যুদয় প্রত্যাশা করছিলেন, তারাও এখন সংশয়াভিভূত। তারা বলছেন, একটি গণঅভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপটে দলটি জন্ম নিলেও তা ব্যাপক জনসমর্থন পাবে কি না, তাতে সন্দেহ রয়েছে। দলটির সামনে রয়েছে দুস্তর পারাবার। সে পারাবার লঙ্ঘন করে তটে পৌঁছা অত্যন্ত কঠিন। যদিও দলটির শীর্ষ নেতারা বলছেন, তারা আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনশো আসনেই প্রার্থী দেবেন। এরই মধ্যে খবর বেরিয়েছে, এনসিপি নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে এবং প্রার্থী বাছাইও শুরু করে দিয়েছে। (কালবেলা, ৭ মার্চ ২০২৫)। কালবেলার প্রতিবেদনে দলটির সম্ভাব্য প্রার্থী হিসেবে যাদের নাম এসেছে তারা গত বছর জুলাই-আগস্ট আন্দোলনের পর থেকে আলোচিত হলেও জাতীয় রাজনীতিতে তাদের তেমন কোনো পরিচিতি বা অবস্থান নেই। ওই নেতাদের প্রত্যেকের আসনে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের জাঁদরেল নেতারা রয়েছেন, যারা প্রার্থী হবেন। তাদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে রাজনীতিতে একেবারেই নবীন এসব প্রার্থী কতটা সুবিধা করতে পারবেন, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে।
এদিকে জন্মলাভের পরপরই দলটি জড়িয়ে গেছে নানা বিতর্কে। পূর্বাহ্ণে অপরাপর দলগুলো থেকে অভিযোগ উঠেছিল, দলটি অন্তর্বর্তী সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা পাচ্ছে। বিতর্ক এড়াতে সরকারের তথ্য উপদেষ্টার পদ ছেড়ে দলটির আহ্বায়ক হয়েছেন নাহিদ ইসলাম। তিনি পদ ছাড়লেও তার দুই সহকর্মী এখনো সরকারে রয়েছে। জনমনের ধারণা, এই দল গঠনের পেছনে তাদের প্রচ্ছন্ন ভূমিকা রয়েছে। কেউ কেউ মনে করেন, স্বাধীনতার পর জাসদ গঠনের ক্ষেত্রে সিরাজুল আলম খানের যে ভূমিকা ছিল, এনসিপি গঠনে সরকারের সঙ্গে সম্পৃক্ত কারও কারও তেমন ভূমিকা থাকতে পারে।
অত্যন্ত জাঁকালো একটি অনুষ্ঠানে আত্মপ্রকাশ ঘটেছে জাতীয় নাগরিক পার্টির। বাংলাদেশে অনেক রাজনৈতিক দল আত্মপ্রকাশ করেছে। তবে খোলা ময়দানে হাজার হাজার মানুষের সমাবেশ ঘটিয়ে কোনো দলের জন্মলাভের নজির নেই। ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠিত হয়েছিল ঢাকার টিকাটুলীর রোজ গার্ডেন নামের বাড়িতে মাত্র আড়াইশ প্রতিনিধির সম্মেলনে। ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর জিয়াউর রহমান বিএনপির আত্মপ্রকাশের ঘোষণা দিয়েছিলেন রমনা রেস্তোরাঁয় সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে। ১৯৮৬ সালের ১ জানুয়ারি জাতীয় পার্টি গঠনের ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে কর্মিসভায়। এ ছাড়া বিভিন্ন সময়ে যেসব রাজনৈতিক দল গঠিত হয়েছে, সেগুলোর কোনোটাই বিশালাকার জনসমাবেশ করে ঘোষিত হয়নি। সে হিসেবে জাতীয় নাগরিক পার্টির আত্মপ্রকাশের অনুষ্ঠান ব্যতিক্রম ঘটনা। পত্রিকার খবরে বলা হয়েছে, রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে দলটির সমর্থক ও নেতাকর্মীরা বাস-ট্রাকে করে ব্যান্ডপার্টি সহযোগ আনন্দ করতে করতে অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছে। অভিযোগ উঠেছে সেসব বাস সরকারিভাবে রিকুইজিশনের।
দলটির আত্মপ্রকাশের মাত্র দুই সপ্তাহের মাথায় তিনজন নেতা দলত্যাগ করেছেন। তারা হলেন যুগ্ম সংগঠক (উত্তরাঞ্চল) হানিফ খান, যুগ্ম মুখ্য সমন্বয়ক আবদুজ জাহের ও আবু হানিফ। এই তিন নেতা ফিরে গেছেন তাদের পূর্বতন সংগঠন গণ অধিকার পরিষদে। কালবেলার উল্লিখিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আগামী নির্বাচনে মনোনয়ন পাওয়ার প্রলোভনে তারা এনসিপিতে যোগ দিয়েছিলেন। তবে দলে সুবিধাজনক জায়গা না পেয়ে এবং ‘ভুল বুঝতে পেরে’ ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে গেছেন। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা বলছেন, দিন গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে এমন ঘটনা আরও ঘটতে পারে।
এদিকে এনসিপি ও বিএনপির মধ্যে চলছে বাগ্যুদ্ধ। দল দুটির নেতারা পরস্পরের প্রতি নিক্ষেপ করে চলেছেন বাক্যগেলা। এ বিষয়ে গত ৮ মার্চ কালবেলার ‘বিএনপি-এনসিপি বাগ্যুদ্ধে তপ্ত হচ্ছে রাজনীতির মাঠ’ শীর্ষক প্রতিবেদন আগস্ট অভ্যুত্থান-পরবর্তী নানা ইস্যুতে প্রবীণ ও নবীন এই দল দুটির মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টির কথা তুলে ধরা হয়েছে। বিশেষত নির্বাচন ইস্যুতে দুই দলের অবস্থান একেবারে উত্তর মেরু-দক্ষিণ মেরু। বিএনপি চাচ্ছে দ্রুত নির্বাচন। অন্যদিকে এনসিপি সংস্কার, হাসিনা ও আওয়ামী লীগের বিচার, জুলাই ঘোষণাপত্র প্রকাশ, গণপরিষদ নির্বাচনকে প্রাধান্য দিচ্ছে। ফলে এই মুহূর্তে দেশের বৃহত্তম দল বিএনপির সঙ্গে নবপ্রতিষ্ঠিত দল এনসিপির দ্বন্দ্ব অনেকটাই প্রকাশ্য।
এদিকে জাতীয় নাগরিক পার্টির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামের একটি বক্তব্য রাজনৈতিক অঙ্গনে তুমুল বিতর্কের সৃষ্টি করেছে। আন্তর্জাতিক বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে সম্প্রতি তিনি বলেছেন, ‘বর্তমান আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ও পুলিশিং ব্যবস্থায় আমি মনে করি না এ বছর একটি জাতীয় নির্বাচন করা সম্ভব হবে।’ (কালবেলা, ৭ মার্চ)। রাজনৈতিক মহলে তার মন্তব্যের তীব্র প্রতিক্রিয়া ও এখতিয়ার নিয়ে প্রশ্ন উঠলে পরদিন তিনি বলেন, ‘এ বছর নির্বাচন সম্ভব নয়, এভাবে বলিনি। আমি বলেছিলাম, এখন দেশের যে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, পুলিশ যেরকম নাজুক অবস্থায় আছে, এরকম নাজুক অবস্থায় নির্বাচন করা কঠিন হবে।’ তিনি বলেছেন, ‘আমরা যদি রাজনৈতিক ঐকমত্যে পৌঁছতে পারি তাহলে কাঙ্ক্ষিত সময়ের মধ্যেই গণপরিষদ ও জাতীয় সংসদ নির্বাচন সম্ভব।’ (কালবেলা, ৮ মার্চ)।
এনসিপি নেতাদের গণপরিষদ নির্বাচনের দাবি নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। কোন প্রেক্ষাপটে একটি দেশে গণপরিষদ গঠিত হতে পারে সেটা এনসিপি নেতাদের তা জানা আছে কি না, এ প্রশ্নও দেখা দিয়েছে। এ দেশের ইতিহাসে দুবার গণপরিষদ গঠিত হয়েছিল। প্রথমবার ১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষ ভাগ হয়ে পাকিস্তান ও ভারত নামে দুটি পৃথক রাষ্ট্র জন্ম নেওয়ার পর। আর দ্বিতীয়বার ১৯৭১-এ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর। সাতচল্লিশে গণপরিষদ গঠিত হয়েছিল ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনের অধীনে ১৯৪৬ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে পাকিস্তান ও ভারতে জয়ী আইনসভার সদস্যদের নিয়ে। আর ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের গণপরিষদ গঠিত হয়েছিল ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বিজয়ী পাকিস্তান জাতীয় পরিষদ ও পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যদের সমন্বয়ে। দুটি গণপরিষদই গঠিত হয়েছিল একটি বৈপ্লবিক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে দুটি নতুন রাষ্ট্রের অভ্যুদয়ের প্রেক্ষাপটে। নতুন সংবিধান প্রণয়নের লক্ষ্যে গঠিত হয়েছিল সে গণপরিষদ। কিন্তু ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট হাসিনা-সরকারের পতন হলেও রাষ্ট্রের কোনো পরিবর্তন হয়নি। বরং অন্তর্বর্তী সরকার শপথ নিয়েছে ১৯৭২ সালের প্রণীত (পরে ১৫ বার সংশোধিত) সংবিধানের আওতায়। এজন্য উদ্ভূত প্রেক্ষাপটে সংবিধান সংশোধনের প্রয়োজন হলেও নতুন সংবিধানের প্রশ্ন অবান্তর। ফলে কথিত গণপরিষদ গঠনও অনাবশ্যক। সংবিধান সংস্কার কমিশন যে সুপারিশ করবে, তার বাস্তবায়ন করবে পরবতী নির্বাচিত জাতীয় সংসদ। অভিজ্ঞমহলের ধারণা, নতুন দলটিতে বা তাদের পেছনে কোনো প্রজ্ঞাবান রাজিনৈতিক ব্যক্তিত্ব না থাকায় উদ্যোক্তারা খেই হারিয়ে ফেলছেন।
নবগঠিত এই দলটি কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছতে পারবে কি না, তা এখনই বলার সময় আসেনি। তবে অতীতে নতুন দল গঠন ও সেগুলোর সংগঠিত হওয়ার যে নজির রয়েছে, তার সঙ্গে এনসিপির কোনো সাজুয্য নেই। ১৯৪৯ সালে আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠিত হয় ভারতবর্ষ বিভাগপূর্ব মুসলিম লীগ, কংগ্রেস ও বামপন্থি রাজনীতিকদের সমন্বয়ে। মূলধারাটি এসেছিল মুসলিম লীগ থেকে। ন্যাপও গঠিত হয়েছিল আওয়ামী লীগ থেকে বেরিয়ে আসা ও প্রগতিবাদী বামধারার নেতাদের নিয়ে। ১৯৭৮ সালে জিয়াউর রহমান গঠন করেন বিএনপি। এই দলটির গঠনপ্রক্রিয়ার দিকে খেয়াল করলে দেখা যায়, মুজিব সরকারের আমলে রাজনৈতিক অধিকারবঞ্চিত এবং দমনপীড়নের শিকার ব্যক্তিদের সমাগম ঘটেছিল সেখানে। এর মূল স্রোতধারা এসেছে ভাসানী ন্যাপ থেকে। পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করায় স্বাধীন বাংলাদেশে রাজনৈতিক অধিকারবঞ্চিত মুসলিম লীগ, রাষ্ট্রক্ষমতায় যেতে উন্মুখ ইউনাইটেড পিপলস পার্টি, সাম্যবাদী দল ইত্যাদি বামধারার রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরাও বিএনপিতে সমবেত হয়েছিল। অন্যদিকে ১৯৮৬ সালে রাষ্ট্রপতি এইচএম এরশাদ যখন জাতীয় পার্টি গঠন করেন, তখন তাতে শামিল হন বিএনপি, ডেমোক্রেটিক লীগসহ কতিপয় দলের শীর্ষস্থানীয় নেতারা। সে হিসেবে নতুন দল জাতীয় নাগরিক পার্টি একেবারেই ব্যতিক্রম। এখনো পর্যন্ত বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের ছাত্রনেতাদের বাইরে একজনও পরিচিত রাজনৈতিক মুখ দলটিতে দেখা যায়নি। অনেকে অবশ্য বলছেন যে, দলটি পূর্ণাঙ্গ রূপ নিলে বা আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ঘনিয়ে এলে মনোনয়ন পেতে ইচ্ছুক কিছু দলছুট নেতার সমাবেশ হয়তো ঘটতে পারে দলটিতে। তবে তাতে দলটির গণভিত্তি তৈরি হবে কি না, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে।
বিএনপির আজকের যে গণভিত্তি তার পেছনে রয়েছে দুটি মূল কারণ। একটি বাকশালী দুঃশাসনোত্তর সময়ে রাষ্ট্রপতি জিয়ার অপেক্ষাকৃত সুশাসন; যা জনমনে স্বস্তি এনে দিয়েছিল, অন্যটি বিপুলসংখ্যক মানুষের আওয়ামী লীগের ওপর ক্ষুব্ধতা। পাশাপাশি মুজিব সরকারের ভারতের প্রতি নতজানু নীতির বিপরীতে জিয়াউর রহমানের স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতিও জনগণকে তার প্রতি আকৃষ্ট করে। ফলে তিনি যখন একটি নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করলেন, তখন নেতারা তো বটেই, সারা দেশের প্রান্তিক জনগণও তাতে স্বতঃস্ফূর্তভাবে শামিল হয়েছিল। যে কারণে সেদিনের সে অঙ্কুরিত দলটি এখন পত্রপল্লবে বিকশিত হয়ে মহিরুহের রূপ নিয়েছে। মনে পড়ে ১৯৮১ সালে ৩০ মে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান নিহত হওয়ার পরে অনেক রাজনৈতিক বোদ্ধাই মন্তব্য করেছিলেন, জিয়ার মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে বিএনপির সূর্যও অস্তমিত হয়ে যাবে। কিন্তু সময় বলছে, বিএনপির সূর্য অস্তমিত হয়নি, বরং বাংলাদেশের রাজনৈতিক আকাশে প্রখর কিরণ নিয়েই জ্বলজ্বল করছে। পনেরো বছর নির্যাতনের স্টিমরোলারের নিচে থেকেও দলটি দমে যায়নি। এর কারণ গণভিত্তি। এ গণভিত্তি অর্জিত হতে পারে দুভাবে। এক. প্রতিষ্ঠাতার ব্যক্তিগত ইমেজ। দুই. দলের গণমুখী কর্মসূচি। নবগঠিত এনসিপিতে এখন পর্যন্ত দুটির একটিরও উপস্থিতি দৃশ্যমান হয়নি। দলটিতে এমন কোনো জাতীয় ব্যক্তিত্বের নাম নেই, যার ডাকে মানুষ ছুটে আসবে। দলটির কর্মসূচিও জনগণের কাছে স্পষ্ট নয়। ফলে এই দল কতটুকু গণভিত্তি অর্জন করতে পারবে, তা এক বিরাট প্রশ্নবোধক চিহ্ন।
লেখক: সাংবাদিক ও রাজনীতি বিশ্লেষক
মন্তব্য করুন