আবুল হাসনাত মো. শামীম
প্রকাশ : ১৭ এপ্রিল ২০২৫, ১২:০০ এএম
আপডেট : ১৭ এপ্রিল ২০২৫, ০৭:৩৮ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

মাটি, প্রতিবেশ ও আমাদের নববর্ষ

মাটি, প্রতিবেশ ও আমাদের নববর্ষ

বিশ্বের প্রতিটি জাতির নববর্ষের আয়োজন নানা দিক থেকে চিন্তা করতে গেলে অনেকটাই সর্বজনীন। তবে স্থান, কাল ও পাত্রভেদে এই সর্বজনীনতায় কিছু পার্থক্য দৃশ্যমান হয়। কারণ, সেখানে প্রকৃতি, প্রতিবেশ ও মাটির গঠন অভিন্ন না হয়ে হয় তুলনামূলক ভিন্ন। আর নববর্ষের আয়োজনে আমরা এ বিষয়টিকে যদি গুরুত্ব দিতে পারি, তাহলে তা আমাদের পরিবেশ সংরক্ষণে যেমন ভূমিকা রাখতে পারে; নববর্ষের আয়োজন হয় টেকসই এবং মানবিক ও জনবান্ধব।

পরিবেশ ও মৃত্তিকা বিজ্ঞানের একজন গবেষক হিসেবে যেটুকু জেনেছি, মাটি কেবল জলবায়ুকে প্রভাবিত করে না, জলবায়ুও মাটিকে প্রভাবিত করে। আমরা নববর্ষের আয়োজনগুলোয় এ বিষয় আমলে রাখলে, তা অনেক দিক থেকে টেকসই হতে পারে।

নববর্ষের উদযাপন শুধুই আনন্দ আয়োজন না হয়ে এটাকে আমরা চাইলেই পরিবেশবান্ধব করে তুলতে পারি। যেমন, চাষযোগ্য জমিতে নো-টিল (no-till) চাষাবাদ, বন কম কাটা এবং শহরাঞ্চলে সবুজ স্থান সংরক্ষণ করার মাধ্যমে আমরা উদ্যোগ নিতে পারি। গাছপালা বায়ু থেকে কার্বন ডাইঅক্সাইড গ্রহণ করে। গাছ মারা গেলে, মাটির অণুজীবগুলো সেই গাছগুলোকে পচিয়ে কার্বন ডাইঅক্সাইড আবার বায়ুতে ফেরত পাঠায়। যদি মাটির এমন অবস্থা হয় যেখানে এই পচনপ্রক্রিয়া ধীর গতিতে ঘটে, তাহলে কম পরিমাণ কার্বন বায়ুতে ফিরে যায়। অর্থাৎ, মাটির এই কার্বন নির্গমন হ্রাস করা কিছুটা হলেও সম্ভব। কারণ এতে কার্বন বাতাসে ফেরত যাওয়ার পরিবর্তে মাটিতে সংরক্ষিত থাকে। আর মাটিতে কার্বন সংরক্ষিত হলে তা গ্রিন হাউস গ্যাস বের হওয়াকে কমিয়ে দিতে পারে নানা দিক থেকে।

তবে, এক কথাও ঠিক যে, মাটি ক্ষুদ্র পরিসরে জলবায়ুকে প্রভাবিত করতে পারে। সিক্ত বা ঘন মাটি তাপ ধরে রাখে এবং আশপাশের তাপমাত্রা পরিবর্তন কমায়। অন্যদিকে মাটিতে, শুকনো ও ঢিলা মাটির পরিমাণ বেশি হলে সে ক্ষেত্রে এই প্রবণতা দেখা যায় না। আমরা দেখি যে, মরুভূমিতে দিনের বেলায় তাপমাত্রা ৬০°F পর্যন্ত বেড়ে যেতে পারে। কারণ সেখানকার মাটির আর্দ্রতা কম এবং সেখানকার মাটির কার্বন ধারণ সক্ষমতাও নেই বললে চলে। ওদিকে মাটির প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য কিছু অঞ্চলে অন্যান্য এলাকার তুলনায় বেশি আর্দ্রতা ও তাপ সংরক্ষণের ক্ষমতা দেয় বলে বিজ্ঞানীদের ধারণা।

মৃত্তিকা বিজ্ঞানের গবেষকরা মাটি কতটা বিকশিত হয়েছে, তা বোঝার চেষ্টা করেন মাটির প্রোফাইল দেখে। মাটির প্রোফাইল দেখতে হলে মাটি খুঁড়ে তার বিভিন্ন স্তর—যাকে হরাইজন (horizons) বলা হয়—পর্যবেক্ষণ করতে হয়। যেসব মাটি বেশি বিকশিত, সেগুলোতে বেশি হরাইজন থাকে এবং স্তরগুলো গভীর হয়, তুলনামূলকভাবে কম বিকশিত মাটির চেয়ে। আর্দ্র পরিবেশে পানির মাধ্যমে কাদা ও অন্যান্য খনিজ নিচের দিকে সরে যায়, যাকে বলা হয় লিচিং। এর ফলে E ও B হরাইজন তৈরি হয়। উষ্ণ পরিবেশে রাসায়নিক ও জৈবিক বিক্রিয়া বেশি ঘটে, যা প্যারেন্ট ম্যাটেরিয়ালকে মাটিতে পরিণত করে।

ওদিকে, শুষ্ক জলবায়ুতে, A হরাইজন খুব পাতলা হয়, কারণ সেখানে খুব কম গাছপালা থাকে, যা পচে জৈব পদার্থে পরিণত হতে পারে। C হরাইজন তখনো উপস্থিত থাকে এবং খনিজ পদার্থে পুষ্টি আটকে থাকে, কারণ সেখানে খনিজ পদার্থ ক্ষয় বা লিচিং করার মতো যথেষ্ট পানি থাকে না, ফলে B হরাইজনও গঠিত হয় না। উষ্ণ ও আর্দ্র (উদাহরণস্বরূপ, গ্রীষ্মমণ্ডলীয়) পরিবেশে মাটি এতটাই লিচড হতে পারে যে মাটি থেকে খনিজ পদার্থের মাধ্যমে পুষ্টি পাওয়া যায় না। এ ধরনের মাটি কৃষিকাজ, ঘরবাড়ি নির্মাণ বা অন্যান্য ব্যবহারের জন্য খুব একটা উপযোগী নয়।

যদিও আবহাওয়া জলবায়ুর স্বল্পমেয়াদি অংশ, কিছু নির্দিষ্ট আবহাওয়ার চক্র মাটিকে প্রভাবিত করতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, খরা বা ঝোড়ো আবহাওয়ায় মাটি শুকিয়ে যেতে পারে ও সরে যেতে পারে। মাটি শুকিয়ে গেলে গাছপালার বৃদ্ধি কমে যায়, ফলে মাটির উপরিভাগের স্থিতিশীলতা কমে যায় এবং বেশি ক্ষয় হয়। এই প্রক্রিয়ার চূড়ান্ত রূপ হলো মরুকরণ (desertification)। যেখানে গাছপালার স্থিতিশীল পরিবেশ হারিয়ে যায়, সেখানে মাটিও অস্থিতিশীল হয়ে পড়ে এবং বালির মতো সরে যেতে শুরু করে। বিশ্বব্যাপী ভূমি অবক্ষয়ের ৫০ শতাংশ, এরও বেশি অংশের জন্য এই মরুকরণ দায়ী।

আমাদের নববর্ষ আয়োজনের পরিচিত ইভেন্টগুলো মাটি ও পরিবেশকে প্রভাবিত করছে। মাটি ও পরিবেশের ওপর উৎসবের দুই ধরনের প্রভাব পড়তে পারে। ইতিবাচক ও নেতিবাচক উভয় দিক থেকেই আমাদের নববর্ষ আয়োজন ভূমিকা রাখে।

উৎসব আয়োজনকে পরিবেশবান্ধব করে তুলতে গেলে শুরুতেই আমাদের গুরুত্ব দিতে হবে জৈব উপকরণের ব্যবহারের দিকে। এর মাধ্যমে স্থানীয় শিল্প বিকাশের সুযোগ যেমন সৃষ্টি হবে, তেমনি পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করাও সহজ হবে। বিভিন্ন ঐতিহ্যবাহী উৎসবের মতো নববর্ষের আয়োজনেও কলাপাতা, ফুল, নারকেলের খোলস ইত্যাদি জৈব উপকরণ ব্যবহার করা যেতে পারে। এগুলো সঠিকভাবে সঠিক জায়গায় ডাম্পিং করা হলে মাটির জন্য তা পুষ্টিকর হয়ে উঠতে পারে। উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে পলিথিন ও ওয়ান টাইম প্লাস্টিক প্লেটের বিকল্প হিসেবে কলাপাতা কিংবা পচনশীল কাগজের প্লেট ব্যবহার করা যেতে পারে। পাশাপাশি, উৎসবের আগে ও পরে পরিচালিত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা কর্মসূচি এলাকার পরিচ্ছন্নতা এবং বর্জ্য ব্যবস্থাপনার প্রতি সচেতনতা বৃদ্ধি করে।

নববর্ষের আয়োজনের সময় গাছ লাগানো ও মাটি সংরক্ষণের কাজে উৎসাহ প্রদান করা যেতে পারে। বিশেষ করে ঢাকার মতো শহরগুলোর গ্রাউন্ড ওয়াটার লেভেল নিয়মিত নেমে যাচ্ছে। নববর্ষের আয়োজনের সময় গ্রাউন্ড ওয়াটার রিচার্জ করার উদ্দেশ্যে বিভিন্ন সচেতনতামূলক কর্মসূচি নেওয়া যেতে পারে। বিশেষ করে সারফেস রান অফ কমিয়ে কীভাবে মাটির পানি শোষণের পরিমাণ বাড়ানো যেতে পারে, সে ব্যাপারে সবাইকে সচেতন করা যেতে পারে। একইভাবে বৃষ্টির পানি ধরে রেখে তা ব্যবহারের ব্যাপারেও নববর্ষের আয়োজন থেকে উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে।

অন্য যে কোনো উৎসবের মতো নববর্ষের আয়োজনেও ব্যবহৃত হয় প্রচুর ফুল। ফুলের বর্জ্য থেকে জৈবসার তৈরির উদ্যোগ নিলে তা নববর্ষের আয়োজনকে পরিবেশগত দিক থেকে ইতিবাচক করে তুলতে পারে। এগুলোকে কম্পোস্টে পরিণত করা গেলে, তা পরে জৈব সার হিসেবে মাটিকে সমৃদ্ধ করতে পারবে। বিশেষত, পরিবেশবান্ধব উৎসবের প্রতি সবাই আগ্রহী ও সচেতন হলে প্রাকৃতিক রং, বায়োডিগ্রেডেবল উপকরণ ও টেকসই সাজসজ্জার ব্যবহার বাড়ে এতে করে পরিবেশ ও মাটির ওপর নেতিবাচক প্রভাব বহুলাংশে কমিয়ে আনা সম্ভব।

পহেলা বৈশাখ আমাদের সর্বজনীন উৎসব। এর সঙ্গে বৈসু, সাংগ্রাই, বিজু, বিষু, বিহু, সাংলান, পাতা, সাক্রাই সাংগ্রাইং, চাংক্রানকে যুক্ত করে নববর্ষের আয়োজনকে আমরা সহজেই বিশ্বজনীন সাংস্কৃতিক উদযাপনের রূপ দিতে পারি। আর সেখানে পরিবেশগত ভাবনা যুক্ত হলে তা বৈশাখের আয়োজনকে যেমন টেকসই করবে; তেমনি পরিবেশ সংরক্ষণেও রাখবে কার্যকর ভূমিকা।

লেখক: অধ্যাপক, গবেষক ও ট্রেজারার

বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

চাকরি দিচ্ছে মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক, থাকছে না বয়সসীমা

আর্জেন্টিনার প্রেসিডেন্টকে ইটপাটকেল নিক্ষেপ উত্তেজিত জনতার

আবু সাইদ হত্যা মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ আজ

কেন নিজের ‘বিকিনি’ ছবির পোস্টার ছিঁড়ে ফেলেন শর্মিলা?

বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের ৪ প্রতিনিধি যোগ দিলেন ছাত্রদলে

ধীরে ধীরে খেলে কি সত্যি ওজন কমে?

চীন সফরে কিম-পুতিনসহ ২৬ রাষ্ট্রপ্রধান

বিকেলে ব্যাংকে ঢুকে লুকিয়ে ছিল সহিদুল, রাতে ডাকাতির চেষ্টা

সকালে ঘুম থেকে উঠতে কষ্ট হয়? মেনে চলুন এই ৬ টিপস

মেসি ঝলকে ফাইনালে মায়ামি

১০

চাঁদা না দেওয়ায় গণঅধিকার নেতার হাতে ইউপি চেয়ারম্যান লাঞ্ছিত

১১

মাদকসেবন করে মাতলামি করায় যুবকের কারাদণ্ড

১২

আমাদের কেউ আলাদা করতে পারবে না: সুনীতা আহুজা 

১৩

রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের পদমর্যাদাক্রম নিয়ে পরবর্তী আপিল শুনানি ৪ নভেম্বর 

১৪

শহিদের সঙ্গে প্রেম-বিচ্ছেদের কারণ জানালেন কারিনা

১৫

গাজায় তীব্র রূপ ধারণ করেছে দুর্ভিক্ষ, অনাহারে মৃত্যু ৩১৩ জনের

১৬

রাজধানীতে লরির ধাক্কায় দুমড়ে-মুচড়ে গেল সিএনজি, নিহত ১

১৭

টিয়া পাখি নিয়ে ভিডিও করে বিপাকে শিক্ষিকা 

১৮

গ্রিন কার্ডের আবেদনে আসছে বড় পরিবর্তন

১৯

কেমন থাকবে আজকের ঢাকার আবহাওয়া

২০
X