আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেট উপস্থাপনের অব্যবহিত পূর্বে আমার কলামে প্রশ্ন রাখতে চাই: বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নামে সংগঠিত ছাত্রছাত্রীদের গণঅভ্যুত্থানের ফসল হিসেবে গঠিত বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের প্রস্তাবিত আগামী বাজেটে শিক্ষা খাত ও স্বাস্থ্য খাতের বরাদ্দ কি তাৎপর্যপূর্ণভাবে বাড়ানো হবে; নাকি গতানুগতিক ধারা অব্যাহত রাখা হবে? বৈষম্য নিরসনের নামে যে সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তাদের কথা ও কাজে আদতেই চরম বৈষম্যমূলক শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতের গ্রহণযোগ্য সংস্কার শুরু হবে কি না সেটার প্রথম ‘অ্যাসিড টেস্ট’ হতে চলেছে আগামী বাজেটে শিক্ষা খাতের বরাদ্দকে কমপক্ষে জিডিপির ৩ শতাংশে উন্নীত করা এবং স্বাস্থ্য খাতের বরাদ্দকে কমপক্ষে ২ শতাংশে উন্নীত করা হচ্ছে কি না, সে প্রশ্নটি। ইউনেস্কোর মতে, জিডিপির কমপক্ষে ৬ শতাংশে উন্নীত করতে হবে শিক্ষা খাতের বাজেট-বরাদ্দ, আর স্বাস্থ্য খাতের বরাদ্দকে ক্রমান্বয়ে বাড়িয়ে জিডিপির ৫ শতাংশে নিয়ে যেতে হবে। এর বিপরীতে বাংলাদেশের বর্তমান বাস্তবতা হলো, ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে শিক্ষা খাতের বাজেট-বরাদ্দ জিডিপির মাত্র ১.৭০ শতাংশ এবং স্বাস্থ্য খাতের বরাদ্দ জিডিপির ১ শতাংশেরও কম। সেখান থেকে এক লাফে ইউনেস্কো-প্রস্তাবিত স্তরে এই দুই খাতের বরাদ্দকে বাড়ানো যাবে না, কিন্তু এ-ব্যাপারে সরকারের সত্যিকার কমিটমেন্ট আছে কি না, তারই প্রমাণ মিলবে শিক্ষা খাতের বরাদ্দকে আগামী বাজেটেই জিডিপির ১.৭০ শতাংশ থেকে ৩ শতাংশে বৃদ্ধির প্রস্তাব এবং স্বাস্থ্য খাতের প্রস্তাবিত বাজেট-বরাদ্দকে কমপক্ষে জিডিপির ২ শতাংশে উন্নয়ন। এই ‘অ্যাসিড টেস্টে’ উতরাতে না পারলে প্রমাণিত হবে যে, বৈষম্য-নিরসন এই সরকারের শুধুই ‘বাত্ কা বাত্’। এক লাখ আটচল্লিশ হাজার পাঁচশ সত্তর বর্গকিলোমিটার আয়তনের একটি দেশে কমপক্ষে সাড়ে সতেরো কোটি মানুষ বাস করছে বর্তমান বাংলাদেশে, যার মানে এটা বিশ্বের সর্বোচ্চ ঘনবসতিপূর্ণ বৃহৎ দেশ। এখানে শিক্ষা খাতে সরকারি বরাদ্দ এখনো জিডিপির ১.৭০ শতাংশ—এই লজ্জা আমরা কোথায় রাখি?
বৈষম্যের মধ্যে গুরুত্বের দিক থেকে সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য পায় আয় ও সম্পদবৈষম্য। কিন্তু, এই দুটো বৈষম্যের আঁতুরঘর হলো শিক্ষায় বৈষম্য ও স্বাস্থ্যব্যবস্থার বৈষম্য। ১৯৭২ সালে স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের প্রথম বাজেট দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুর সরকারের অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ। ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরের ওই বাজেটে শিক্ষা খাতের বাজেট বরাদ্দ ছিল ২১.১৬ শতাংশ—বাজেটের সর্বোচ্চ খাতওয়ারি বরাদ্দ। তখনকার যুদ্ধবিধ্বস্ত অর্থনীতির বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে শিক্ষা খাতে এত বেশি ব্যয়-বরাদ্দ যে সরকারের জন্য কতবড় চ্যালেঞ্জ ছিল, তা এখন চিন্তাও করা যাবে না, অথচ শিক্ষা ও মানব উন্নয়নকে বঙ্গবন্ধুর অর্থনৈতিক দর্শনের কেন্দ্রীয় ফোকাসে ন্যস্ত করার এ সিদ্ধান্ত নিঃসন্দেহে প্রমাণ করে যে, বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ বাংলাদেশে জনগণকে দ্রুত শিক্ষিত করে গড়ে তোলাই যে উন্নয়নের মূল দর্শন হতে হবে, সে বিষয়টি বঙ্গবন্ধু এবং তার সরকারের নীতিনির্ধারকরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন। বঙ্গবন্ধু সরকারের শেষ বাজেট ১৯৭৫-৭৬ অর্থবছরের বাজেটেও শিক্ষা খাতের প্রতি বঙ্গবন্ধুর অগ্রাধিকার প্রদানের বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। দুঃখজনক হলো, বঙ্গবন্ধুকে সপরিবার হত্যা করার পর ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর ক্ষমতাসীন সমরপ্রভু জিয়াউর রহমান ১৯৭৬-৭৭ অর্থবছরের বাজেটে শিক্ষা খাতের সরকারি ব্যয়-বরাদ্দকে টেনে ১১ শতাংশের নিচে নামিয়ে এনেছিলেন। ওখান থেকে গত তিপ্পান্ন বছরে শিক্ষা খাতের সরকারি বাজেট-বরাদ্দকে আর বাড়ানো যায়নি—বাজেটের ১২ শতাংশের নিচে বা আশপাশে অবস্থান করছে এই বরাদ্দ। সর্বোচ্চ ঘনবসতিপূর্ণ দেশের সরকারগুলোর এহেন লজ্জাজনক দৃষ্টিভঙ্গির কারণেই স্বাধীনতা অর্জনের ৫৪ বছর পরও দেশের সাক্ষরতার হার বর্তমানে ৭৫ শতাংশ, ২৫ শতাংশ মানুষকে আজও ‘সাক্ষর’ করে তোলা যায়নি। অথচ, ভিয়েতনাম তাদের শতভাগ মানুষকে সাক্ষরতা দিতে সময় নিয়েছে মাত্র ২৫ বছর। ১৯৭৫ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যুদ্ধে জিতে যে দেশের উন্নয়নযাত্রা সূচিত হয়েছিল, সেখানে ২০০০ সালেই শতভাগ জনগণকে শুধু সাক্ষরতা নয়, আধুনিক কারিগরি শিক্ষায় দীক্ষিত করে তুলেছে ভিয়েতনাম। সেজন্যই আজ ভিয়েতনামকে বলা হচ্ছে ‘ইকোনমিক মিরাকল’ ঘটানো দেশ।
শিক্ষা সম্পর্কে ১৯৭২ সালের সংবিধানের অঙ্গীকার বিধৃত হয়েছে ১৭ নম্বর ধারায়, যা নিম্নরূপ:
“রাষ্ট্র (ক) একই পদ্ধতির গণমুখী ও সার্বজনীন শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য এবং আইনের দ্বারা নির্ধারিত স্তর পর্যন্ত সকল বালক-বালিকাকে অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষাদানের জন্য, (খ) সমাজের প্রয়োজনের সহিত শিক্ষাকে সংগতিপূর্ণ করিবার জন্য এবং সেই প্রয়োজন সিদ্ধ করিবার উদ্দেশ্যে যথাযথ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ও সদিচ্ছাপ্রণোদিত নাগরিক সৃষ্টির জন্য, (গ) আইনের দ্বারা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নিরক্ষরতা দূর করিবার জন্য কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন।”
উপরে উল্লিখিত অঙ্গীকার মোতাবেক দেশের প্রাথমিক পর্যায়ের মাদ্রাসা শিক্ষা ও ইংরেজি মিডিয়াম শিক্ষাকে ধাপে ধাপে মূল ধারার প্রাথমিক শিক্ষার ‘একক মানসম্পন্ন’ কারিকুলামে নিয়ে আসাই সরকারের সাংবিধানিক দায়িত্ব। এই সাংবিধানিক অঙ্গীকার বাস্তবায়নের জন্য বঙ্গবন্ধুর সরকার ১৯৭২ সালেই পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষাকে অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক ঘোষণা করার পাশাপাশি দেশের সকল প্রাথমিক স্কুলকে জাতীয়করণ করেছিল। ১৯৭৪ সালে কুদরত-ই খুদা শিক্ষা কমিশনের যে প্রতিবেদনটি সরকার গ্রহণ করেছিল তাতে ওই বাধ্যতামূলক, অবৈতনিক ও একক মানসম্পন্ন প্রাথমিক শিক্ষাকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত বর্ধিত করার প্রস্তাব ছিল। জাতির দুর্ভাগ্য, কুদরত-ই খুদা কমিশনের রিপোর্ট সরকার গ্রহণ করেছে মর্মে সরকারি গেজেট প্রকাশিত হওয়ার আগেই ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু নিহত হয়েছিলেন। ওই রিপোর্টের সুপারিশগুলো ১৯৭৫-১৯৯৬ এর ২১ বছরে কোনো সরকারেরই সুবিবেচনা পায়নি, যদিও জিয়াউর রহমান, এরশাদ ও বেগম খালেদা জিয়ার ১৯৯১-১৯৯৬ মেয়াদের সরকার নিজেদের পছন্দমাফিক একাধিক শিক্ষা কমিশন বা কমিটি গঠন করেছে এবং শিক্ষা নিয়ে এন্তার ‘তুঘলকি এক্সপেরিমেন্ট’ চালিয়েছে। এমনকি শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন ১৯৯৬-২০০১ মেয়াদের সরকার কর্তৃক গঠিত ‘শামসুল হক কমিটির’ রিপোর্টেও এ বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়া হয়েছিল। ২০০৯ সালে ক্ষমতায় ফিরে আসার পর শেখ হাসিনার মহাজোট সরকার কর্তৃক প্রফেসর কবির চৌধুরীর নেতৃত্বে গঠিত কমিটির প্রতিবেদনে এই সাংবিধানিক অঙ্গীকারটিকে বাস্তবায়নের সুস্পষ্ট সুপারিশ অন্তর্ভুক্ত হয়েছে, এবং বর্তমানে তা বাস্তবায়নাধীন থাকলেও স্বৈরশাসক হাসিনা এই অঙ্গীকার বাস্তবায়নে মোটেও নিষ্ঠাবান ছিলেন না। দেশে বর্তমানে ১১ ধরনের প্রাথমিক শিক্ষা চালু রয়েছে। শিক্ষাজীবনের শুরুতেই শিশুকে এত ধরনের বৈষম্যমূলক শিক্ষা ব্যবস্থার জালে আটকে ফেলার এহেন নৈরাজ্যকর ব্যবস্থা বিশ্বের আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না। পিতামাতার বিত্তের নিক্তিতে ওজন করে নির্ধারিত হয়ে যাচ্ছে কে কিন্ডারগার্টেনে যাবে, কে সরকারি বা বেসরকারি প্রাইমারি স্কুলে সুযোগ পাবে, কার এনজিও স্কুলে ঠাঁই হবে, আর কাকে এবতেদায়ি মাদ্রাসায় পাঠিয়ে বাবা-মা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলবে যে, ‘লিল্লাহ বোর্ডিংয়ে’ ভাতটা তো অন্তত জুটল! এভাবে সারা জীবনের জন্য ওই শিশুকে বৈষম্যের অসহায় শিকারে পরিণত করে ফেলা তার মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন। বড় হয়ে সে বাবা-মাকে অভিশাপ দেবে কিংবা পরিবারের দারিদ্র্যকে দোষ দেবে তাকে ভুল স্কুলে বা মাদ্রাসায় পাঠানোর জন্য, কিন্তু তখন আর ভুল সংশোধনের কোনো উপায় থাকবে না। এর অন্য পিঠে দেশে ইংরেজি মাধ্যম কিন্ডারগার্টেনের সংখ্যাবৃদ্ধিকেও নাটকীয় বলা চলে। মধ্যবিত্ত, উচ্চ-মধ্যবিত্ত এবং উচ্চবিত্ত পিতামাতারা তাদের সন্তানদের জন্য এখন আর বাংলা মাধ্যম প্রাইমারি স্কুলগুলোকে উপযুক্ত মানসম্পন্ন মনে করছেন না, কিন্ডারগার্টেনে পড়ানোটাই নিয়মে পরিণত হয়ে গেছে গত পাঁচ দশকে। এগারো ধরনের প্রাথমিক শিক্ষা চালু থাকতে দেওয়া কি অসাংবিধানিক নয়? সরকার যদি মনে করে থাকে কিন্ডারগার্টেনের কারিকুলাম আধুনিক ও যুগোপযোগী তাহলে সংবিধানের ১৭ ধারায় প্রদত্ত অঙ্গীকার অনুযায়ী ওটাকেই প্রাথমিক শিক্ষার একক কারিকুলাম করা হবে না কেন?
সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বেশ কয়েকবার বলেছিলেন, অপ্রতুল বাজেট-বরাদ্দ একক মানসম্পন্ন প্রাথমিক শিক্ষার অর্থায়নের পথে প্রধান বাধা। সাবেক অর্থমন্ত্রীর স্বীকারোক্তিতে বর্ণিত সরকারের এই অপারগতা শিক্ষার ব্যাপারে অত্যন্ত দুঃখজনক ও বিপজ্জনক একটি বাস্তবতাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর সরকারের সময় যে সমস্যাটা গৌণ ছিল, তা গত ৫০ বছরে একটা মহাসংকটে পরিণত হয়েছে—এই সংকটটি হাজার হাজার মাদ্রাসার নাটকীয় বিস্তার। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনামলে ঔপনিবেশিক ভারতবর্ষে সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসার মাধ্যমে যে মাদ্রাসা শিক্ষার ধারা প্রচলিত হয়েছিল, সেটাই নানাবিধ পরিবর্তন-পরিবর্ধন-সংস্কারের মাধ্যমে এদেশের আলিয়া মাদ্রাসাগুলোতে অনুসৃত হচ্ছে। দেওবন্দ ঘরানার মাদ্রাসাগুলোতে বাগদাদের আব্বাসীয় শাসনামলের ‘নিজামিয়া কারিকুলাম’ অনুসৃত হচ্ছিল, যা এখনকার কওমি মাদ্রাসাগুলোতেও সামান্য সংস্কার করে চালু রাখা হয়েছে। সাধারণ জনগণের মধ্যে কওমি মাদ্রাসাগুলোর পরিচয় ‘ওহাবি মাদ্রাসা’ হিসেবে। বাংলাদেশে ১৯৭৫ সালের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান এবং এরশাদ মাদ্রাসা শিক্ষাকে রাজনৈতিক প্রয়োজনে বিশেষ পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান করায় গত ৫০ বছরে এদেশে হাজার হাজার মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আবার সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কুয়েত ও কাতারের মতো মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর তেল সম্পদের খুদ-কুঁড়া হিসেবে মাদ্রাসাগুলোতে যে বিদেশি খয়রাত প্রবাহিত হচ্ছে ওই খয়রাতের বড় অংশটাই কওমি মাদ্রাসাগুলো আকৃষ্ট করতে সমর্থ হয়েছে। মাদ্রাসাগুলোতে যেহেতু একই সঙ্গে আবাসিক সুবিধা এবং আহারের ব্যবস্থা থাকে তাই নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তানদের জন্য এগুলোর আকর্ষণ ক্রমবর্ধমান। মাধ্যমিক শিক্ষায়ও চারটি ধারার সমান্তরাল অবস্থান—ইংরেজি মাধ্যমের নানান কিসিমের মহার্ঘ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, মূল ধারার বাংলা মাধ্যম সরকারি স্কুল, বাংলা মাধ্যম বেসরকারি স্কুল এবং কয়েক ধরনের মাদ্রাসা। আমরা এখন ভুলে গেছি যে, বঙ্গবন্ধুর আমলে একটিও নতুন ক্যাডেট কলেজ স্থাপিত হয়নি। বরং কুদরত-ই খুদা কমিশন ধাপে ধাপে ক্যাডেট কলেজগুলোকে মূলধারার মাধ্যমিক শিক্ষার সঙ্গে একীভূত করার সুপারিশ করেছিল, অথচ এখন উল্টো সারা দেশে ও লেভেল/এ লেভেল চালু হচ্ছে যত্রতত্র। এই বিভাজিত ও বৈষম্যমূলক শিক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমে আমরা এক দেশের মধ্যে চারটি পৃথক জনগোষ্ঠী সৃষ্টি করে চলেছি! উচ্চশিক্ষার প্রতি বঙ্গবন্ধুর দরদ প্রতিফলিত হয়েছিল দেশের চারটি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য স্বায়ত্তশাসনের ব্যবস্থা চালু করার মাধ্যমে। ১৯৭৩ সালে প্রথম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ জারি হয়েছিল এবং পরে রাজশাহী, চট্টগ্রাম ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য তিনটি বিশ্ববিদ্যালয় আইন পাস হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর উদ্যোগে। ১৯৭৫ সালের পর ক্রমান্বয়ে ভূলুণ্ঠিত হয়ে চলেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসন, এখন তো সরাসরি বলা হচ্ছে ‘পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়’। এটা মোটেও কাকতালীয় নয় যে, ওই চারটি বিশ্ববিদ্যালয়ের পর গত ৫০ বছরে এদেশের আর কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বায়ত্তশাসন প্রদান করা হয়নি। ১৯৯২ সালে বিএনপি সরকার দেশে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার আইন চালু করার পর গত তেত্রিশ বছরে উচ্চশিক্ষা এখন মহার্ঘ পণ্যে পরিণত হয়েছে। ব্যবসায়ীদের মুনাফাবাজির লোভনীয় ক্ষেত্র এখন শিক্ষাব্যবস্থা। এমতাবস্থায়, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার অনেকগুলো সংস্কার কমিশন গঠন করলেও বোধগম্য কারণে কোনো শিক্ষা সংস্কার কমিশন গঠন করেনি, এ-ব্যাপারে সরকারের কর্তাব্যক্তিদের অবস্থান অত্যন্ত সুচতুরভাবে গোপন রাখা হচ্ছে। সরকারের ওপর জামায়াত-শিবির ও মোল্লা-মৌলভিদের প্রভাব এত বেশি যে, সরকার শিক্ষা ব্যবস্থার বিদ্যমান বৈষম্য নিরসনে খুব বেশি সাহসী পদক্ষেপ নিতে পারবে না। বিশেষত, মাদ্রাসা শিক্ষার বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া বর্তমান প্রেক্ষাপটে অসম্ভব বললে অত্যুক্তি হবে না।
লেখক: সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি এবং একুশে পদকপ্রাপ্ত অর্থনীতিবিদ ও অবসরপ্রাপ্ত প্রফেসর, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
মন্তব্য করুন