মোহাম্মদ আনোয়ার
প্রকাশ : ২২ মে ২০২৫, ১২:০০ এএম
আপডেট : ২২ মে ২০২৫, ০৭:৫৯ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

শুধু জ্বালানি নয়, প্রযুক্তিও এখন ক্ষমতার মানদণ্ড

শুধু জ্বালানি নয়, প্রযুক্তিও এখন ক্ষমতার মানদণ্ড

রিয়াদ-দোহা-আবুধাবি—মাত্র ছয় দিনের এ সফরেই মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প একাধিক বৈশ্বিক বার্তা ছুড়ে দিয়েছেন। ২০২৫ সালের মে মাসে দ্বিতীয় দায়িত্বকাল শুরু করার পর এ সফরকে বিশ্লেষকরা দেখছেন ‘নতুন বিশ্ব বিন্যাসের সূচক’ হিসেবে। সফরটি ছিল শুধু আনুষ্ঠানিকতার বাইরেও অনেক কিছু—এটি ছিল শক্তি, প্রযুক্তি ও কৌশলের এক কৌতূহলোদ্দীপক সংমিশ্রণ, যা মধ্যপ্রাচ্যকে কেন্দ্র করে বিশ্বশক্তির ভারসাম্য পুনর্গঠনের লক্ষ্যে নেওয়া এক দূরদর্শী পদক্ষেপ।

যুক্তরাষ্ট্রের কৌশল: শুধু মিত্রতা নয়, প্রযুক্তিনির্ভর আধিপত্য প্রতিষ্ঠা। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এই সফরের মাধ্যমে চারটি মূল উদ্দেশ্য নিয়ে অগ্রসর হয়েছেন—মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন প্রভাব পুনরুদ্ধার, ইরান-চীন জোটের প্রতিপক্ষ হিসেবে প্রযুক্তিকেন্দ্রিক জোট গঠন, মার্কিন প্রতিরক্ষা ও বেসামরিক শিল্পের বাজার সম্প্রসারণ, উপসাগরীয় দেশগুলোর ‘ভিশন ২০৩০’ বাস্তবায়নে আমেরিকান অংশীদারত্ব নিশ্চিত করা। বিশেষজ্ঞদের মতে, এটি শুধু একটি সফর নয়, বরং এক ‘প্রযুক্তিকেন্দ্রিক ভূ-কূটনৈতিক বিপ্লব’—যার চালকের আসনে এখন প্রযুক্তির পরাশক্তিরা।

সফরসঙ্গী ছিলেন বিশ্ব প্রযুক্তি ও শিল্পনেতারা। ট্রাম্পের সফরে ছিল নজরকাড়া এক প্রতিনিধিদল—যাদের উপস্থিতি গোটা সফরের গুরুত্ব আরও বাড়িয়ে তোলে: ইলন মাস্ক (Tesla, SpaceX, xAI), স্যাম অল্টম্যান (OpenAI), জেনসেন হুয়াং (Nvidia), সানদার পিচাই (Alphabet Inc.), ল্যারি এলিসন (Oracle), ড্যারিও আমোডেই (Anthropic), তাদের উপস্থিতি প্রমাণ করে দিয়েছে—এ সফর ছিল শুধু রাজনৈতিক নয়, বরং ‘টেক ডিপ্লোম্যাসি’র এক যুগান্তকারী অধ্যায়।

সৌদি আরব: জ্বালানি থেকে AI অবকাঠামোতে প্রবেশ

মধ্যপ্রাচ্য সফরের প্রথম রাষ্ট্র সৌদি আরবে গত ১৩ মে পৌঁছান প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। সেখানে তিনি প্রাথমিকভাবে ২০০ বিলিয়ন ডলারের চুক্তি স্বাক্ষর করেন। তবে দেশটির যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান জানিয়েছেন, এ চুক্তির পরিমাণ ১ ট্রিলিয়ন ডলারে উন্নীত হতে পারে।

চুক্তির আওতায় রয়েছে: স্মার্ট সিটি উন্নয়ন, পারমাণবিক শক্তি প্রযুক্তি স্থানান্তর, Tesla–Aramco সৌর ও হাইড্রোজেন এনার্জি প্রকল্প।

রাজনৈতিক বিশ্লেষণ: সৌদি-মার্কিন সম্পর্কের নতুন সংজ্ঞা দাঁড়াচ্ছে—তেল নয়, এখন ‘টেক-এনার্জি ট্রাস্ট’।

কাতার: প্রতিরক্ষা ও গবেষণায় শক্তিশালী জোট

১৪ মে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প দ্বিতীয় রাষ্ট্র কাতারে পৌঁছে ১.২ ট্রিলিয়ন ডলারের বিশাল চুক্তি সম্পন্ন করেন।

এ চুক্তির মধ্যে অন্তর্ভুক্ত: বোয়িং বিমান ক্রয় ও মেইনটেন্যান্স চুক্তি, আল-উদেইদ সামরিক ঘাঁটির সম্প্রসারণ, Nvidia ও Qatar Research Fund-এর যৌথ AI গবেষণা কেন্দ্র।

বিশ্লেষণ: কাতার এখন শুধু কূটনৈতিক মধ্যস্থতাকারী নয়, AI গবেষণার নতুন হাব হতে চলেছে।

সংযুক্ত আরব আমিরাত: প্রযুক্তি, মহাকাশ ও সাইবার শক্তির প্রতীক, ১.৪ ট্রিলিয়ন ডলারের প্রযুক্তি, অবকাঠামো ও প্রতিরক্ষা চুক্তি, বিশ্বের বৃহত্তম AI Data Center নির্মাণ (Google, Oracle, Microsoft), Lunar Robotics Project (OpenAI & UAE Space Agency), Oracle-Dubai Cybersecurity অংশীদারত্ব।

বিশ্লেষণ: আমিরাত এখন ‘Digital OPEC’ গঠনের রূপকার—যেখানে তেল নয়, ডেটা ও সাইবার নিরাপত্তাই আসল সম্পদ।

বিশ্ব অর্থনীতি ও ভূরাজনীতির বার্তা: যুক্তরাষ্ট্র এখন সামরিক কূটনীতি থেকে প্রযুক্তি-কূটনীতিতে রূপান্তরিত হচ্ছে, চীন ও রাশিয়ার প্রতিপক্ষ হিসেবে একটি ‘AI-Alliance Bloc’ গড়ে তুলছে, উন্নয়নশীল দেশগুলোর কাছে মার্কিন পুঁজির নতুন ভাষ্য—‘Tech with Trust’।

বাংলাদেশের জন্য বার্তা: এখনই প্রস্তুতির সময়

এ সফরের ফলে বাংলাদেশের সামনে এসেছে নতুন সম্ভাবনার দরজা, তবে প্রস্তুতির ঘাটতি থাকলে তা হারিয়ে যেতে পারে।

করণীয়

এক. দক্ষ জনশক্তি রপ্তানি: প্রযুক্তি ও নির্মাণ খাতে প্রশিক্ষিত জনবল প্রস্তুত রাখা জরুরি। দুই. রপ্তানি বহুমুখীকরণ: ইঞ্জিনিয়ারিং, পরামর্শসেবা, স্মার্ট টেক্সটাইল ও আইটি সলিউশনের বাজার ধরতে হবে।

তিন. কূটনৈতিক ভারসাম্য: ভারত-চীন-যুক্তরাষ্ট্র-GCC’র সঙ্গে সুষম সম্পর্ক বজায় রাখতে হবে।

চার. প্রযুক্তি বিনিয়োগ: হাইটেক পার্ক, AI ইনকিউবেটর এবং সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্ব গড়ে তুলতে হবে।

মধ্যপ্রাচ্যের বুকে নতুন এক বৈশ্বিক বিন্যাসের সূচনা: প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাম্প্রতিক মধ্যপ্রাচ্য সফর বাস্তবতাকে নতুনভাবে উপস্থাপন করেছে—বিশ্ব এখন এক বৈপ্লবিক রূপান্তরের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হচ্ছে, যেখানে ভূরাজনীতি, প্রযুক্তি এবং অর্থনৈতিক কৌশল একত্রে সংজ্ঞায়িত করছে আগামী দিনের নেতৃত্ব কাঠামো। এ সফর শুধু কূটনৈতিক সফর ছিল না, এটি ছিল একটি সুপরিকল্পিত ‘Geo-Tech Realignment’-এর ঘোষণা, যেখানে প্রযুক্তিগত সক্ষমতা, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং কৌশলগত জোটই হয়ে উঠছে আধুনিক শক্তির মূল ভিত্তি। তেল নয়, প্রযুক্তিই হচ্ছে নতুন প্রভাব বলয়। অস্ত্র নয়, তথ্য ও উদ্ভাবনই এখন নিরাপত্তার স্তম্ভ। সামরিক ঘাঁটির চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে ডেটা সেন্টার ও গবেষণা হাব।

এই বৈশ্বিক বাস্তবতায় বাংলাদেশের জন্য সময় এসেছে আত্মসমালোচনা ও কৌশল পুনর্গঠনের। আমাদের জানতে হবে—এ পরিবর্তনশীল বিশ্বে আমরা কোথায় দাঁড়িয়ে এবং কোথায় যেতে চাই।

বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় নীতিতে এখন জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে প্রযুক্তিনির্ভর দক্ষ জনশক্তি উন্নয়ন, কৌশলগত অংশীদারত্বে সক্রিয়তা, সাইবার ও তথ্য নিরাপত্তা খাতে বিনিয়োগ এবং উদ্ভাবনভিত্তিক অর্থনীতির দিকে স্পষ্ট রূপান্তর।

প্রস্তুতি না থাকলে আমরা হয়তো এ রূপান্তরের ইতিহাসের একটি অধ্যায় পড়ব, কিন্তু তার নির্মাতা হতে পারব না। এখনই সময় দর্শক না হয়ে নীতিনির্ধারকের ভূমিকা নেওয়ার।

লেখক: দুবাই প্রতিনিধি, দৈনিক কালবেলা

(প্রকাশিত নিবন্ধের বক্তব্য ও দায়িত্ব লেখকদের নিজস্ব)

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

সন্ধ্যায় বিএনপি ও জামায়াতের সঙ্গে বসবেন প্রধান উপদেষ্টা

প্রথম শ্রেণির পৌরসভায় নেই ডাম্পিং স্টেশন

ঈদে হাট কাঁপাতে আসছে ‘লালু সর্দার’ ও ‘কালিয়া’

ছুটির দিনে ঘুরতে গিয়ে খুন হলেন আব্দুল্লাহ

মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রে যুবকের মৃত্যু, পরিবারের দাবি হত্যা

চরে হঠাৎ জোয়ারের পানি, মৃত অবস্থায় ৩৪ গরু উদ্ধার

মার্কিন মালিকানায় গেল দ্য টেলিগ্রাফ

দুপুরের মধ্যে ঢাকাসহ ১১ জেলায় ঝড়ের শঙ্কা

আজ কেমন থাকবে ঢাকার আবহাওয়া 

ঈদুল আজহা : ট্রেনের ৩ জুনের টিকিট বিক্রি আজ

১০

গাজার উত্তরে এখনো খাবার যায়নি, আরও মৃত্যু ৭৬

১১

২৪ মে : কী ঘটেছিল ইতিহাসের এই দিনে

১২

২৪ মে : আজকের নামাজের সময়সূচি

১৩

হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে প্রতারণার ফাঁদ, অতঃপর

১৪

‘যারা আজ সবচেয়ে বেশি শিক্ষিত, তারাই মাকে দূরে রাখতে চায়’

১৫

চট্টগ্রামে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের নেতার পদত্যাগ

১৬

চবি তেপান্তর সাহিত্য সভার নেতৃত্বে আবদুল মোমেন-রিয়াদ উদ্দিন

১৭

বৈষম্যবিরোধী সমন্বয়কদের দুগ্রুপের সংঘর্ষে আহত ৪

১৮

সৈকতে পড়ে আছে মৃত ডলফিন, ছড়াচ্ছে দুর্গন্ধ

১৯

পতেঙ্গা সৈকতে গোলাগুলি, ঢাকাইয়া আকবরসহ গুলিবিদ্ধ ২

২০
X