‘শিলা জলে ভাসি যায়/ বানরে সঙ্গীত গায়।’—এ কি বিশ্বাসযোগ্য? খনা বিশ্বাস করতে বারণ করেছেন। তাহলে কীভাবে বিশ্বাস করা যাবে, সাবেক রাষ্ট্রপতি অ্যাডভোকেট আবদুল হামিদের বিদেশ যাওয়ার বিষয়টি সরকারের কাকপক্ষীও জানে না? হতে পারে, বিলুপ্তপ্রায় কাকপক্ষীকুলকে বাজপাখিরা আগেই বলেছে, ‘কা কা করিবা না, মাথা গুঁজিয়া থাকিবা!’ প্রসঙ্গত, প্রকৃতিতে শকুন এবং কাকসহ উপকারী প্রাণিকুল বিলুপ্তির পথে। কিন্তু ইঁদুর আছে মাশাআল্লাহ মহা দাপটে এবং এর রূপক প্রভাব সমাজ ও রাষ্ট্রের সর্বত্র। উল্লেখ্য, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক গত ১০ মে বলেছেন, ‘আবদুল হামিদের বিদেশে চলে যাওয়ার পেছনে সরকারের কেউ না কেউ অবশ্যই জড়িত।’ সাইফুল হক যাদের দিকে অভিযোগের আঙুল তুলেছেন, তারা হয়তো ইঁদুর প্রজাতির। যে কারণে মানবকুলের দৃষ্টির আড়ালে থাকতে পেরেছে। জানা কথা, প্রকৃতির ইঁদুরের দাপট ঘরে-বাইরে সর্বত্র। আর মানুষের কাছাকাছি বিচরণকারী এ প্রাণীটির নানামুখী বিনাশী ক্ষমতা অসীম। শকুন-কাক-ইঁদুর প্রসঙ্গ থাক।
এ ব্যাপারে কোনোই সংশয় নেই, সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ বাধাহীনভাবেই বিদেশ গিয়েছেন। বলা হচ্ছে, চিকিৎসার জন্য যাওয়া। তবে তিনি যে অন্য কিছু করতে পারবেন না, অথবা করবেন না—সেটা মনে করা নিশ্চয়ই সমীচীন নয়। প্রবচনই তো আছে, ‘রথ দেখা আর কলা বেচা।’ ফলে চিকিৎসার জন্য গেলেও সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের প্রশ্নবিদ্ধ নির্গমনের সঙ্গে রাজনীতির সংশ্রব থাকাটাই স্বাভাবিক। আর তা একমুখী মনে করার কোনো কারণ নেই। নেপথ্যে বহুমুখী বাতাস থাকতে পারে। প্রকৃতির বাতাসও কিন্তু একমুখী বয় না। ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে বাতাসের গতিপথ বদলে যায়। আবার একই ঋতুতেও বদলায় বাতাসের গতিধারা। ঝড়ের সময় তো আর কোনো কথাই নেই। কোনো সংশয় নেই, আমাদের রাজনীতিতে ঝড়ের বাস্তবতা বিরাজমান। এ অবস্থায় সাবেক রাষ্ট্রপতির প্রশ্নবিদ্ধ বিদেশ গমন সংগত কারণেই অনেক প্রশ্নের উদ্রেক করবেই, যা অনেকের জন্য আশার, কারও জন্য হতাশার। তার বিদেশ গমন নিয়ে রাজনীতির পানি বেশ ঘোলা হয়েছে এবং বইছে নানান দিকে।
গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর অনুসারে, সাবেক রাষ্ট্রপতি অ্যাডভোকেট আবদুল হামিদ গত ৭ মে রাত ৩টার দিকে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে ব্যাংককের উদ্দেশে ঢাকা ছেড়েছেন। সঙ্গে গেছেন ছোট ছেলে সাবেক এমপি রিয়াদ আহমেদ ও শ্যালক ডা. নওশাদ খান। সাবেক এ রাষ্ট্রপতি কূটনৈতিক পাসপোর্ট নিয়েই ইমিগ্রেশন সম্পন্ন করেছেন। কিন্তু এ বিষয়টি কেন্দ্র করে সরকারের তরফ থেকে যেসব বয়ান উদগিরণ করা হয়েছে, তা কোনো বিবেচনায় স্বচ্ছ ধারণা দেয় না। গ্রহণযোগ্যতা তো আরও অনেক পরের বিষয়। তবে এ ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে সরকারের ‘কঠোর অবস্থান’ জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে ৯ মে পাঠানো একটি বিবৃতি বলা হয়েছে, ‘ফ্যাসিবাদী সরকারের সাবেক রাষ্ট্রপতি ও হত্যা মামলার আসামি আবদুল হামিদের বিদেশ গমন সম্পর্কে জনমনে ক্ষোভ বিষয়ে সরকার অবগত। এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত সবার বিরুদ্ধে উপযুক্ত আইনগত ব্যবস্থা নিতে সরকার বদ্ধপরিকর রয়েছে।’ এর আগে ৮ মে দিনাজপুরে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেন, ‘তাদের (আবদুল হামিদকে বিদেশে যেতে সহায়তাকারীদের) কোনো অবস্থায় ছাড় দেওয়া যাবে না। আর যদি শাস্তির আওতায় না আনি, তাহলে আমি সে সময় চলে যাব।’ স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার এ ঘোষণার পর ওইদিন রাতে আবদুল হামিদের দেশত্যাগের ঘটনায় কথিত ‘দায়িত্বে অবহেলার’ অভিযোগে ব্যবস্থা গ্রহণ শুরু হয়। এ পর্যন্ত চার পুলিশকে কাট টু সাইজ করা হয়েছে। বলির পাঁঠা! সাবেক রাষ্ট্রপতির বিদেশ গমনের বিষয়ে অতিরিক্ত আইজিপি মতিউর রহমান শেখকে প্রধান করে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটিও গঠন করা হয়েছে। এখানেই শেষ নয়, ১১ মে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় থেকে জানানো হয়েছে, সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের বিদেশযাত্রা নিয়ে সৃষ্ট পরিস্থিতিতে তদন্তের জন্য তিনজন উপদেষ্টা নিয়ে একটি উচ্চপর্যায়ের কমিটি গঠন করেছে সরকার। শিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক সি আর আবরারকে সভাপতি করে এ কমিটিকে ১৫ দিনের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে। তবে জানা কথা, এসব তদন্ত কমিটি শেষতক পর্বতে মূষিকও প্রসব করে না। আর নিশ্চিতভাবে বলা চলে, ১৫ দিনের এমনসব ঘটনা ঘটবে যাতে আবদুল হামিদ ইস্যু গ্ল্যামার হারাবে। আর এরই মধ্যে অনেকটা হারিয়েছেও বলে অনেকেরই ধারণা। বাসররাতে নববধূকে কারিনা মনে হলেও সকালে জরিনা মনে হওয়ার রসিকতার মতো।
প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে, সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের বিরুদ্ধে কিশোরগঞ্জ সদর থানায় গত ১৪ জানুয়ারি একটি মামলা হয়েছে। এ মামলায় ১২৪ জনের নাম উল্লেখ করা আছে। যেখানে এক নম্বর আসামি শেখ হাসিনা, দ্বিতীয় আসামি শেখ রেহানা এবং আসামির তালিকার তৃতীয় আবদুল হামিদ। এরই মধ্যে এ মামলায় ১১ জন এজাহারভুক্ত আসামি এবং ১৩ জন সন্দেহভাজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এদিকে ১০ মে পিলে চমকানো খবর প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক কালবেলায়। রাফসান জানির করা বিশেষ এ রিপোর্টে বলা হয়েছে, “সাবেক রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের বিদেশ যাওয়া ঠেকাতে তিন মাস আগে পুলিশের বিশেষ শাখায় (এসবি) আবেদন করেছিল কিশোরগঞ্জ জেলা পুলিশ। একই সঙ্গে জানানো হয়েছিল ঢাকা মহানগর পুলিশকেও (ডিএমপি)। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর কিশোরগঞ্জের ‘হাই প্রোফাইল’ আসামিদের তালিকা করে জানুয়ারির শেষদিকে এসবির রাজনৈতিক শাখায় আবেদনটি পাঠানো হয়। এ তালিকায় আবদুল হামিদের নাম ছিল ৩৯ নম্বরে।” একই রিপোর্টে আরও বলা হয়েছে, ‘আবদুল হামিদ দেশ ছেড়ে যাওয়ার বিষয়ে বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশন পুলিশ একটি সাধারণ ডায়েরি করেছে। এতে বলা হয়েছে, টিজি ৩৪০ ফ্লাইটে চিকিৎসার উদ্দেশ্যে ব্যাংকক যান আবদুল হামিদ। তিনি ভিআইপি টার্মিনাল দিয়ে ইমিগ্রেশন সম্পন্ন করেন।’ জিডিতে বলা হয়েছে, ‘আবদুল হামিদ ভিআইপি টার্মিনালে আসার পর ওসি ইমিগ্রেশনকে জানানো হয়। তিনি জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থা (এনএসআই) ও ডিরেক্টরেট জেনারেল অব ফোর্সেস ইন্টেলিজেন্সকে (ডিজিএফআই) জানান। এনএসআইর সহকারী পরিচালক সানাউল্লাহ নুরী ও ডিজিএফআইর জিএসও-১ উইং কমান্ডার ফয়সাল অনাপত্তি দেন। এনএসআই ও ডিজিএফ থেকে পাওয়া অনাপত্তির বিষয়টি ওসি ইমিগ্রেশন এসএস ইমিগ্রেশন (অপারেশন), অ্যাডিশনাল ডিআইজি ইমিগ্রেশন ও ডিআইজি ইমিগ্রেশনকে জানানো হয়। অ্যাডিশনাল ডিআইজি ইমিগ্রেশন এসবি চিফের রেফারেন্সে ওসি ইমিগ্রেশনকে আবদুল হামিদের ইমিগ্রেশন সম্পন্ন করার নির্দেশ দেন। ওসি ইমিগ্রেশন সিনিয়র অফিসারদের নির্দেশ, এনএসআই, ডিজিএফআই থেকে পাওয়া অনাপত্তি এবং ইমিগ্রেশন ফরট্র্যাক সিস্টেমে কোনো বিরূপ মন্তব্য না থাকায় ভিআইপি টার্মিনালে কর্তব্যরত ইনচার্জকে ইমিগ্রেশন করার নির্দেশ দেন। টার্মিনাল ইনচার্জ এরপর ইমিগ্রেশন সম্পন্ন করেন।’
উল্লেখ্য, সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুর হামিদকে চুপিচুপি বর্তমান রাষ্ট্রপতি চুপ্পুর মতো ভাবলে চলবে না। ছাত্ররাজনীতির পথে হেঁটে ১৯৭০ সালে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের কনিষ্ঠতম সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন আবদুর হামিদ। তিনি বাংলাদেশের প্রথম গণপরিষদের সর্বকনিষ্ঠ সদস্য ছিলেন। জাতীয় সংসদের স্পিকার থাকাকালে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। এরপর দুই মেয়াদে রাষ্ট্রপতি থাকার বিষয়টি ব্যাপকভাবে আলোচিত বিষয়। নির্বাচনের রাজনীতির তার পথচলা শুরু হয়েছে সরকারি গুরুদয়াল কলেজের ভিপি হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার মধ্য দিয়ে। ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়ন দুই-ই করেছেন আবদুল হামিদ। তাকে বলা হয় ‘ঘুঘু রাজনীতিক’। এই ঘুঘু এখন সরকারে ফাঁদ থেকে অনেক দূরে। আর নাটের গুরু শেখ হাসিনা তো বহু সাঙ্গোপাঙ্গ নিয়ে ৫ আগস্ট থেকে মহাবন্ধুরাষ্ট্র ভারতে আস্তানা গেড়েছেন। সবকিছুই কিন্তু রাজনীতির খেলার মধ্যে পড়ে। যে প্রসঙ্গ বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান যথার্থই ইঙ্গিত করেছেন। ৯ এপ্রিল বাংলাদেশ খ্রিষ্টান ফোরাম আয়োজিত অনুষ্ঠানে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে তিনি বলেছেন, ‘পলাতক স্বৈরাচারের সময়ের একজন সাবেক রাষ্ট্রপতি বিমানবন্দর দিয়ে চলে গেছেন দেশ ছেড়ে। আমরা দেখেছি ৫ আগস্ট আরেকজন দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেছেন। তিনিও অনেকটা এভাবেই পালিয়ে গেছেন। কিন্তু এখন বলা হচ্ছে যে, অন্তর্বর্তী সরকার নাকি তার এ দেশত্যাগের ব্যাপারে কিছুই জানে না। এমন অভিযোগ আছে যে, অন্তর্বর্তী সরকার নানা ইস্যু তৈরি করে ফ্যাসিবাদবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর ঐক্যে হয়তো ফাটল ধরানোর ক্ষেত্র তৈরি করছে। এ ছাড়া তারা পলাতক স্বৈরাচারের সহযোগীদের পুনর্বাসনের ক্ষেত্রও হয়তো তৈরি করতে চাইছেন। এ বিষয়গুলো ঘুরেফিরে মানুষের মনে প্রশ্ন তৈরি করছে।’ মনে করা হয় সংকটের পাহাড় ডিঙানো এবং অথৈ পাথারে জাহাজ চালিয়ে বিএনপির রাজনীতিকে কিনারের কাছাকাছি পৌঁছানোর অসাধ্য সাধনকারী তারেক রহমান গভীরের কথাই বলেছেন। প্রসঙ্গত, আকাশের বিমান মাটিতে অবতরণ এবং সাগরের জাহাজ কিনারে ভেড়ানোর কাজে অনেক ঝুঁকির বিষয় থাকে।
বিমান, জাহাজ ও রাজনীতির গভীরের বিষয় নিয়ে বেশি ঘাঁটাঘাঁটি না করে গ্রামীণ সাধারণ একটি গল্প দিয়ে কলামাটির ইতিটানা যাক। পুরোনো আমলে হাটে নানান দোকানের সঙ্গে দৃষ্টিনন্দন হয়ে ধরা দিত গামলাভর্তি গরম রসগোল্লা। যা ছানা দিয়েই বানানো হতো, চলমান সময়ের মতো আটার গোলার সঙ্গে ছানার মিশেল নয়। কাকডাকা ভোর থেকে শুরু করা রসগোল্লা তৈরির কাজ শেষ হতো দুপুরের দিকে। হাটে লোক সমাগম হতো বিকেল নাগাদ। সকাল থেকে কাজ করে ক্লান্ত এক ময়রা একটু ঘুমিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। শিশুপুত্রকে দায়িত্ব দিলেন মাছি তাড়াবার এবং বেঞ্চিতে ফলি কাত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তার নাসিকা গর্জন শুরু হলো। এ সময় এক লোক এসে শিশুটিকে বলল, আমার নাম ‘মাছি’। এই বলেই সে গপাগপ রসগোল্লা গলাধঃকরণ করতে লাগল। সন্দেহের উদ্রেক হওয়ায় শিশুটি ভয়ে ভয়ে বলল, ‘বাবা, মাছি তো রসগোল্লা খায়!’ ঘুমের ঘোরেই ময়রা বললেন, জোরে জোরে বাতাস কর।’ শিশুটি তাই করল। আর মাছি নামধারণ করে দুষ্ট লোকটি তার কম্ম সেরে চলে গেল। ঘুম থেকে জেগে ময়রার তো কপালে হাত! কিন্তু মনে রাখা প্রয়োজন, খুচরা চালাকিতে সওয়ার হয়ে গ্রাম্য হাটের রসগোল্লা খাওয়া গেলেও রাজনীতিতে এ চালাকি বেশি দিন চলে না, রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে তো নয়ই! প্রশ্ন উঠতেই পারে, ক্ষমতার মসনদে সমাসীন বদখেদমতে হুজুরে আলারা কি ‘কন্ট্রোল্ড ক্যাওয়াজ’ তৈরির কৌশলকেই করেছেন ধ্যানজ্ঞান?
লেখক: জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
মন্তব্য করুন