চট্টগ্রামের সন্দ্বীপে চিকিৎসা না পেয়ে চট্টগ্রাম শহরের পথে রওনা দিয়েছিল ৯ বছরের শিশু আবদুর রহমান। কিন্তু আড়াই ঘণ্টা ধরে সাগর পাড়ি দিতে গিয়েই মাঝপথে মায়ের কোলেই থেমে যায় তার জীবন।
জানা যায়, সপ্তাহখানেক ধরে জ্বর ও শারীরিক জটিলতায় ভুগছিল আবদুর রহমান। প্রথমে স্থানীয় ডাক্তারের চিকিৎসা নেওয়া হয়। তবে অবস্থার উন্নতি না হওয়ায় সোমবার (০৭ জুলাই) বিকেলে তাকে সন্দ্বীপ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যান পরিবারের সদস্যরা।
সেখানকার চিকিৎসক দ্রুত চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পরামর্শ দেন। সন্ধ্যার আগেই শিশুটিকে নিয়ে পরিবারের সদস্যরা ছুটে যান গুপ্তছড়া ঘাটে। বিকেল ৫টা থেকে টানা সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত নৌযানের অপেক্ষায় থাকেন তারা। কিন্তু সাগর উত্তাল থাকায় মিলছিল না কোনো নৌযান।
ওই সময় ঘাটে উপস্থিত ছিলেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাও। তিনিও নৌযান ব্যবস্থা করার চেষ্টা করেন। অবশেষে সন্ধ্যা ৭টা ১০ মিনিটে পাওয়া যায় একটি ছোট ‘লাল বোট’, যা মূলত উপকূল এলাকায় ব্যবহৃত হয় যাত্রী নামানোর জন্য। ঝুঁকি নিয়েই তাতে উঠতে হয় আবদুর রহমানকে।
ছোট নৌকাটি যখন গভীর সাগরে এগোতে থাকে, তখন ভারি বর্ষণ ও ঢেউয়ের ধাক্কায় পরিস্থিতি ভয়াবহ হয়ে ওঠে। ভিজে যাচ্ছিল মায়ের কোলে থাকা শিশুটি, ধীরে ধীরে নিস্তেজ হয়ে পড়ছিল সে। রাত সাড়ে ৯টার দিকে নৌকাটি সীতাকুণ্ডে পৌঁছায়। কিন্তু তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে।
নৌকা ভেড়ার পর সীতাকুন্ডের একটি হাসপাতালে নেওয়া হয় তাকে। চিকিৎসকেরা জানান, হাসপাতালে আনার আগেই আবদুর রহমানের মৃত্যু হয়।
মারা যাওয়া আবদুর রহমান উপজেলার বাউরিয়া ইউনিয়নের মোহাম্মদ মানিকের ছেলে। মৃত্যুর খবর এলাকায় পৌঁছানোর পর শোক ছড়িয়ে পড়ে। মঙ্গলবার সকালে লাশ বাড়িতে নেওয়া হয়। দুপুরে দাফন সম্পন্ন হয়।
শিশুটির ফুফাতো ভাই ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী মো. মাইন উদ্দীন জানান, ‘স্থানীয় ডাক্তার প্রথমে ওষুধ দিয়ে অপেক্ষা করতে বলেন। কিন্তু পরে অবস্থা খারাপ হলে সোমবার চারটার দিকে উপজেলা হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখান থেকে রেফার করার পর কোনো দেরি না করে মাসহ পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা ছুটে যান ঘাটে। কিন্তু দুই ঘণ্টার অপেক্ষা করেও তারা কোনো নৌকা পাচ্ছিলেন না। অবশেষে ছোট একটা বোটে উঠতে বাধ্য হন। পথে বোট এমনভাবে দুলছিল যে প্রায় উল্টে যাওয়ার মতো অবস্থা হয়েছিল। সে সময় ভারী বৃষ্টিতে ভিজতে থাকা আবদুর একেবারে নিস্তেজ হয়ে যায়।’
বৈরী আবহাওয়ায় সঠিক সময়ে চিকিৎসা না পেয়ে রোগী মৃত্যুর ঘটনা সন্দ্বীপে এটাই প্রথম নয়— প্রায়ই এমন ঘটে থাকে। দ্বীপবাসীদের দীর্ঘদিনের দাবি—জরুরি মুহূর্তে রোগী পারাপারে বিশেষ নৌযান ও স্বাস্থ্যসেবা জোরদার করা হোক।
এ বিষয়ে সন্দ্বীপ উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. মানস বিশ্বাস কালবেলাকে বলেন, ‘শিশুটির মলদ্বার দিয়ে রক্তক্ষরণ হচ্ছিল, জ্বর ছিল। এ ধরনের রোগের চিকিৎসা দেওয়া আমাদের এখানে সম্ভব না। তাই প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে চট্টগ্রামে পাঠানো হয়েছিল।’
জরুরি অবস্থায় রোগী পারাপারের ব্যবস্থা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘নৌ অ্যাম্বুলেন্সের জন্য কয়েক বছর ধরে বলা হচ্ছে। কিন্তু কোনো ব্যবস্থা হচ্ছে না।’
সন্দ্বীপ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মংচিংনু মারমা কালবেলাকে বলেন, ‘ছেলেটির মৃত্যুর খবরটি আমি শুনেছি। এটা অত্যন্ত বেদনাদায়ক। আমি এ উপজেলায় নতুন যোগদান করেছি। বৈরি আবহাওয়ায় রোগী পারাপারের জন্য নৌযানের বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করব।’
মন্তব্য করুন