বাংলাদেশসহ বিশ্বব্যাপী কৃষি খাতে নারীর অবদান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। টেকসই কৃষি নিশ্চিত করতে হলে নারীর সক্রিয় অংশগ্রহণ ও সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ অগ্রাহ্য করার সুযোগ নেই। জলবায়ু পরিবর্তন এবং খাদ্য নিরাপত্তার মতো বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় টেকসই কৃষি একটি জরুরি অনুষঙ্গ। এ প্রক্রিয়ায় নারীরা বীজ সংরক্ষণ, জৈবসার প্রস্তুত, মিশ্র চাষাবাদ এবং ক্ষুদ্র প্রাণিসম্পদ পালনের মাধ্যমে নীরব কিন্তু কার্যকর ভূমিকা পালন করে আসছেন। তবে দুঃখজনক হলেও সত্য, নারীরা এখনো প্রশিক্ষণ, আধুনিক প্রযুক্তি, কৃষি উপকরণ এবং সম্পদের ন্যায্য সুযোগ থেকে বঞ্চিত।
ইকোফেমিনিজম: নারী ও প্রকৃতির যৌথ সংগ্রাম
বিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে, বিশেষ করে সত্তরের দশকের শুরুর দিকে, বিশ্বজুড়ে দুটি গুরুত্বপূর্ণ আন্দোলন গড়ে ওঠে—একটি পরিবেশবাদী আন্দোলন এবং অন্যটি নারীবাদী আন্দোলন। নারী ও প্রকৃতি যেন একই উৎস থেকে উদ্ভূত দুটি সত্তা, যাদের অভ্যন্তরীণ অনেক বৈশিষ্ট্য একে অন্যের সঙ্গে মিলে যায়। প্রকৃতির প্রতি নারীর সহজাত মমত্ববোধ এ দুটি আন্দোলনের মধ্যে একটি গভীর সম্পর্ক স্থাপন করে। একসময় দেখা গেল, এ দুটি আন্দোলনের লক্ষ্য এক—পুরুষতন্ত্রের আধিপত্য ও নিপীড়ন থেকে মুক্তি। এ থেকেই জন্ম নেয় নারীবাদের নতুন ধারা—ইকোফেমিনিজম বা পরিবেশ নারীবাদ।
ইকোফেমিনিজমের ভিত্তি অনেক পুরোনো হলেও একে স্পষ্টভাবে প্রকাশ করতে সময় লেগেছে। ১৯৭৪ সালে ফরাসি নারীবাদী লেখক ফ্রাসোয়াঁ দ্যুবন তার ‘Le Féminisme ou la Mort’ (নারীবাদ নাকি মৃত্যু) গ্রন্থে প্রথমবারের মতো ইকোফেমিনিজম শব্দটি ব্যবহার করেন। এ মতবাদ বিশ্বাস করে যে, প্রকৃতি ও নারীর ওপর পুরুষতান্ত্রিক শোষণের প্রক্রিয়া একই ধরনের এবং এটি রোধ করতে হলে উভয়ের মুক্তির জন্য একসঙ্গে লড়াই করতে হবে।
জে ওয়ারেন পুরুষতান্ত্রিক ব্যবস্থার সৃষ্ট দ্বৈত মূল্যবোধকে এ নিপীড়নের জন্য দায়ী করেন। তার মতে, বিশ্বজুড়ে পুরুষতান্ত্রিক ধারণা প্রকৃতি ও নারীর ওপর আধিপত্য বিস্তার করতে চায়, যা উভয়ের জন্যই ক্ষতিকর। পুরুষতন্ত্র নারী এবং প্রকৃতির ওপর শোষণ ও শাসন চালিয়ে গেলেও নারীদের আবেগপ্রবণ ও দুর্বল হিসেবে চিত্রিত করে তাদের ক্ষমতাহীন রাখার চেষ্টা করে।
নারীর বহুস্তরীয় ভূমিকা: উৎপাদক থেকে ব্যবস্থাপক
নারী ও প্রকৃতির সম্পর্ককে আরও সুস্পষ্টভাবে বোঝার জন্য কয়েকটি দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ করা যেতে পারে—উৎপাদক, ব্যবস্থাপক, সংগ্রাহক, ভোক্তা এবং লোকজ্ঞান অর্জনকারী হিসেবে নারী। কৃষির আদিলগ্ন থেকেই নারীরা উৎপাদনের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত। বাংলাদেশের গ্রামীণ নারীরা তাদের আঙিনায় সবজি বাগান, ঔষধি ও ফলদ গাছ লাগিয়ে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করেন। তারা কৃষিকাজে পরিবেশ দূষণ ও জমির উর্বরতা নষ্ট সম্পর্কে সচেতন থাকেন।
সংগ্রাহক হিসেবে নারীরা জৈবশক্তি হিসেবে জ্বালানি সংগ্রহ করেন, যা খড়, ছন, শুকনো পাতা, গাছের শুকনো ডাল ও গোবর ইত্যাদির মাধ্যমে পূরণ করা হয়। গ্রামীণ নারীরা প্রতিদিন গড়ে পাঁচ ঘণ্টা জ্বালানি সংগ্রহ করেন। নারীরা বনভূমি থেকে খাদ্য সংগ্রহ করেন এবং গৃহপালিত পশুর খাদ্যের এক বড় অংশ প্রাকৃতিক উৎস থেকে আহরণ করেন। এ ছাড়া উন্নয়নশীল দেশগুলোতে নারীরা পানি সংগ্রাহক ও ব্যবস্থাপক হিসেবেও কাজ করেন।
ভোক্তা হিসেবে নারীরা পরিবেশ থেকে সংগৃহীত বিভিন্ন খাদ্যদ্রব্য পরিবারের চাহিদা মেটানোর জন্য ব্যবহার করেন। নারী পরিবেশ ব্যবস্থাপনার বিভিন্ন পর্যায়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন, যা প্রযুক্তিগত, অর্থনৈতিক ও সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে গুরুত্বপূর্ণ। তাদের লোকজ্ঞান, যা দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতার মাধ্যমে অর্জিত, পরিবেশ সংরক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
ইকোফেমিনিজম স্বনির্ভর কৃষির ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেয়। কৃষির সূচনা নারীদের হাত ধরে এবং সেই সময় মাতৃতান্ত্রিক সমাজে নারীদের নেতৃত্বেই কৃষিকাজ পরিচালিত হতো। কিন্তু সময়ের পরিবর্তনে কৃষির নিয়ন্ত্রণ পুরুষদের হাতে চলে যায় এবং এটি বাণিজ্যিক কোম্পানিমুখী হয়ে ওঠে। তবে বর্তমানে গ্রামীণ নারীরা জৈব সার ও বীজ সংরক্ষণে বিশেষ মনোযোগ দিচ্ছেন।
পরিবেশবান্ধব লোকজ্ঞান ও দুর্যোগে নারীর দক্ষতা
দুর্যোগ মোকাবিলায় নারীর বিচক্ষণতা ও দূরদর্শিতা পরিবারের জন্য সহায়ক হয়। তারা খাদ্য সংরক্ষণ, পশুপাখির দেখভাল এবং দুর্যোগকালে জরুরি খাদ্য ও জ্বালানি সংরক্ষণের জন্য পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, নদীভাঙন ও জলোচ্ছ্বাসের মতো দুর্যোগের সময় নারীরা খাদ্য, পোশাক, পানি এবং জ্বালানির সংস্থান করে পরিবারকে রক্ষা করেন। দুর্যোগ-পরবর্তী সময়ে রোগবালাই থেকে পরিবারের সদস্যদের নিরাপদ রাখতে তারা ভেষজ ওষুধ সংরক্ষণ করেন।
নারী কৃষকের পরিসংখ্যান ও নেতৃত্বে উত্থান
গবেষণার তথ্যমতে, দেশের শ্রমশক্তিতে জড়িত নারীদের ৬৬ শতাংশই গ্রামীণ নারী। কৃষিতে নারীর অংশগ্রহণ দিন দিন বাড়ছে। ২০১৭ সালের কৃষি জরিপ অনুসারে, বিগত ১৫ বছরে কৃষিতে নারীর অংশগ্রহণ ১০৮ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে, যেখানে পুরুষদের অংশগ্রহণ কমেছে ২ শতাংশ। এর একটি বড় কারণ হলো গ্রামীণ পুরুষদের অর্থনীতির অন্যান্য খাতে স্থানান্তর। ফলে নারীরা কৃষিকাজে আরও বেশি জড়িত হচ্ছেন। এটাই আমাদের খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধির অন্যতম কারণ।
নারীরা কৃষিতে স্মার্ট হয়ে উঠছেন, সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন এবং সক্ষম হচ্ছেন নেতৃত্ব দিতে। ফলে দেশের খাদ্য উৎপাদন বাড়ছে এবং নিশ্চিত হচ্ছে খাদ্য নিরাপত্তা। নারীর এ দায়িত্বশীলতা ও দক্ষতা পরিবেশবান্ধব এবং টেকসই কৃষির বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
স্বীকৃতি ও নীতিগত সহায়তা জরুরি
নারীর দক্ষতা, দায়িত্ববোধ ও পরিবেশবান্ধব চিন্তাভাবনা টেকসই কৃষির অন্যতম ভিত্তি। এ সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে প্রয়োজন লক্ষ্যভিত্তিক প্রশিক্ষণ, আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারে দক্ষতা তৈরি, সহজ শর্তে অর্থায়ন এবং নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে নারীদের সক্রিয় অংশগ্রহণ। নারীদের শ্রম ও ভূমিকার যথাযথ মূল্যায়ন করে যদি পরিকল্পিতভাবে প্রাতিষ্ঠানিক সুবিধা ও প্রযুক্তিগত সহায়তার সুযোগ বিস্তৃত করা যায়, তাহলে দেশের কৃষিব্যবস্থা আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক, পরিবেশবান্ধব ও জলবায়ু সহনশীল হয়ে উঠবে।
লেখক: পরিবেশ ও নারী অধিকারকর্মী
মন্তব্য করুন