ড. দানিয়া কোলেইলাত খাতিব
প্রকাশ : ০১ জুলাই ২০২৫, ১২:০০ এএম
আপডেট : ০১ জুলাই ২০২৫, ০৮:৩২ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

নেতানিয়াহুর যুদ্ধে সমর্থন চিরস্থায়ী হবে না

নেতানিয়াহুর যুদ্ধে সমর্থন চিরস্থায়ী হবে না

ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যকার যুদ্ধের শীর্ষ পর্যায় ছিল জুন মাসের ১৩ থেকে ২৪ তারিখ। এই ১২ দিনের ভেতর ইসরায়েলি বাহিনী গাজায় ৮৭০ জন ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছে। অথচ এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনা আন্তর্জাতিক শিরোনামগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য জায়গা করে নিতে পারেনি। গণমাধ্যমগুলোর দৃষ্টি সম্পূর্ণভাবে ইসরায়েল-ইরান যুদ্ধে আবদ্ধ ছিল। এ সুযোগ তেল আবিব খুব কৌশলের সঙ্গে কাজে লাগিয়েছে। গাজায় চলমান গণহত্যা থেকে বিশ্ববাসীর নজর সরিয়ে নিতে ইরানের সঙ্গে যুদ্ধকে সফলভাবে পুঁজি করেছে ইসরায়েলের সরকার। তবে এ কথা সত্য যে, ইসরায়েলের পক্ষে পশ্চিমা বিশ্বের দৃঢ় সমর্থন কায়েম করে রাখাটা ক্রমেই মুশকিল হয়ে পড়ছে। বর্তমানে পশ্চিমা নেতৃত্ব আর জনমতের বিপরীতে দাঁড়াতে হচ্ছে তাদের।

গাজায় চালানো অবৈধ হামলা বন্ধ করার প্রস্তাব এড়িয়ে যাওয়ার জন্য ইসরায়েলের প্রয়োজন ছিল বিশ্ববাসীর নজর অন্যদিকে ধাবিত করা। ফিলিস্তিনিদের ওপর ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী যে আক্রমণ চালিয়েছিল, তার জন্য তাদের জনসমক্ষে ঘোষিত উদ্দেশ্য ছিল আটককৃত ইসরায়েলি নাগরিকদের উদ্ধার করা। কিন্তু সময় যত গড়াচ্ছে, ততই এ বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে উঠছে যে, এই আক্রমণের প্রকৃত লক্ষ্য ছিল ফিলিস্তিনি জনগণদের জাতিগত নির্মূলীকরণ। তবে এর পেছনে প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিগত স্বার্থ রয়েছে। সেটা হলো ইসরায়েলে তার রাজনৈতিক ক্ষমতা বজায় রাখা এবং যুদ্ধাপরাধ ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে আন্তর্জাতিক আদালতের সাজা এড়িয়ে যাওয়া। যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন সম্প্রতি মন্তব্য করেছেন, ‘নেতানিয়াহুর টিকে থাকার জন্য অন্তহীন যুদ্ধই একমাত্র পথ।’ তিনি আরও বলেন, ‘নেতানিয়াহুকে থামানো এখন ডোনাল্ড ট্রাম্পের দায়িত্ব।’

পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে ইসরায়েলের যে ঐতিহাসিক সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক, তাতে ধীরে ধীরে ফাটল ধরতে শুরু করেছে। ট্রাম্প দ্বিতীয় দফায় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছেন বিশ্বব্যাপী যুদ্ধ বন্ধ করার ‘চিরন্তন অঙ্গীকার’ নিয়ে। কিন্তু নেতানিয়াহুর সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে গেলে, সেই লক্ষ্য বাস্তবায়ন করা কঠিন হয়ে পড়বে। ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধ থামাতে ট্রাম্প বেশ তৎপর ছিলেন। কিন্তু যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ইসরায়েল তা লঙ্ঘনের অজুহাত দাঁড় করিয়ে ফেলে। এতে ট্রাম্প ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। তিনি উভয়পক্ষকেই একহাত নেন, বলেন, ‘তারা জানে না যে তারা কী ভয়ানক কর্মকাণ্ড করছে।’

নেতানিয়াহুর পরিকল্পনা যে গাজা ও পশ্চিম তীর পুরোপুরি দখল করে নেওয়া, এটা এখন আর কোনো গোপন বিষয় নয়। ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে ভাষণ দিতে গিয়ে তিনি মধ্যপ্রাচ্যের যে মানচিত্র ব্যবহার করেন, তাতে ফিলিস্তিনের কোনো অস্তিত্ব ছিল না। সেখানে গাজা ও পশ্চিম তীর, উভয় ভূখণ্ডকেই ইসরায়েলের অংশ হিসেবে দেখানো হয়েছিল। পরবর্তীকালে ৭ অক্টোবরের হামলা তাকে সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের আদর্শ সুযোগ তৈরি করে দেয়।

ফিলিস্তিনিদের জাতিগত নির্মূলীকরণ চূড়ান্ত লক্ষ্য। এটা শুধু নেতানিয়াহুর সরকারের অভিলাষ নয়, বহু ইসরায়েলি নাগরিকও এমনটাই চায়। ২০২৪ সালের মে মাসে আমেরিকার পেনসিলভানিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটির করা এক জরিপে দেখা গেছে, ইসরায়েলের ইহুদি নাগরিকদের মধ্যে ৮২ শতাংশই গাজা থেকে ফিলিস্তিনিদের নির্মূল করার পক্ষে ভোট দিয়েছে। এই কট্টর অবস্থানের উৎস মূলত ইহুদি জাতির নিষ্ঠুরতা নয়, বরং এর উৎস ইসরায়েলের সরকারের বহু বছর ধরে চালানো ফিলিস্তিনবিরোধী মিথ্যা প্রচারণা। সরকারের দ্বারা প্রচারকৃত বার্তাগুলো বস্তুত ‘লিকুদ পার্টির’ বহিষ্কারবাদী কর্মসূচিকে উৎসাহিত করে। এ মতবাদ ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় মীমাংসার সব পথ রুদ্ধ করে দিয়েছে। ফলে নেতানিয়াহুর যুদ্ধনীতিই এখন জনমানসে জাতীয় নীতিতে রূপ নিচ্ছে। নিজেকে জাতীয় নায়ক হিসেবে দর্শানোর যেই স্বপ্ন বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু লালন করছেন, তা বাস্তবায়ন করতে হলে তাকে এটা নিশ্চিত করতে হবে যেন তার প্রতি ইসরায়েলের সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিকের সমর্থন বজায় থাকে। নেতানিয়াহু বর্তমানে চিন্তা করছেন, সংখ্যাগুরু ইসরায়েলিদের চাহিদা পূরণ করতে পারলে তিনি আন্তর্জাতিক বিচার প্রক্রিয়া থেকে রেহাই পাবেন। কিন্তু এই মুহূর্তে তার এ সর্বনাশা পরিকল্পনা বাস্তবায়নের পথে প্রধান বাধা হলো আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়। বর্তমানে বিশ্বব্যাপী সাধারণ নাগরিকরা তাদের নিজ নিজ দেশের নেতাদের ওপর চাপ সৃষ্টি করছে, যার কারণে এ নেতারা ইসরায়েলের পক্ষে সমর্থন কিছুটা শিথিল করতে বাধ্য হচ্ছে। একবিংশ শতাব্দীতে কেউ প্রকাশ্যে গণহত্যার পক্ষে অবস্থান নিতে পারে না। আর দিন যত গড়াচ্ছে, ফিলিস্তিনিদের ওপর চালানো গণহত্যা ততই স্পষ্ট হয়ে উঠছে। এ ঘটনা আর গোপন রাখা যাচ্ছে না।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যেভাবে গণহত্যা আড়াল করা যেত, বর্তমানের ইন্টারনেটের যুগে তা আর সম্ভব নয়। হিটলার যেভাবে ইহুদিদের ওপর হলোকস্ট চালিয়েছিলেন বা সোভিয়েত নেতা জোসেফ স্টালিন যেভাবে তাতারদের জাতিগতভাবে নির্মূল করেছিলেন, ফিলিস্তিনিদের ক্ষেত্রে বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু সেই পথ অবলম্বন করে পার পাবেন না। কারণ, এখন প্রতিটি ঘটনাই লাইভ সম্প্রচার হয়। ‘আত্মরক্ষার স্বার্থে ইসরায়েল যুদ্ধ করতে বাধ্য হচ্ছে’—এ বয়ান দিয়ে তারা বহুকাল ধরেই নিরীহদের ওপর অত্যাচার চালিয়ে আসছে। কিন্তু এ অজুহাত এখন আর কাজ করছে না। পশ্চিমা বিশ্বের জনগণ এখন স্পষ্টই দেখতে পাচ্ছে যে, ইসরায়েলি বাহিনী গাজার ত্রাণকেন্দ্রের সামনে খাদ্যের জন্য অপেক্ষমাণ অসহায় মানুষদের গুলি করে হত্যা করছে।

ইরানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রকে সংঘাতে জড়ানোর পর নেতানিয়াহু হয়তো এখন ওয়াশিংটনকে আরও নতুন কোনো সংঘাতে জড়ানোর পরিকল্পনা করছেন। যুক্তরাষ্ট্রে ইসরায়েলপন্থি শক্তিশালী লবি রয়েছে, যা রিপাবলিকান ও ডেমোক্র্যাট উভয় দলের ওপর বহুকাল ধরে প্রভাব বিস্তার করে আসছে। রুপার্ট মারডকের মালিকানাধীন ফক্স নিউজের মতো মূল ধারার সংবাদমাধ্যমগুলো বহু আগের থেকেই মার্কিন নাগরিকদের কাছে ইসরায়েলপন্থি দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরে আসছে। এ লবিই আগে ইরাক যুদ্ধের পক্ষে প্রচারণা চালিয়েছিল। ইরানের ওপর হামলা চালানোর ক্ষেত্রে মার্কিন সরকারকে তারাই উদ্বুদ্ধ করেছে। এখন আবার তারাই নেতানিয়াহুর স্বার্থে নতুন নতুন যুদ্ধের পক্ষে যুক্তরাষ্ট্রকে ঠেলে দিতে উদ্যত হচ্ছে। নেতানিয়াহুর এ স্বার্থ উদ্ধারে ইরানের সঙ্গে ইসরায়েলের যুদ্ধটা অত্যন্ত প্রয়োজনীয় হয়ে পড়েছে। তার দরকার এমন এক প্রেক্ষাপট, যেখানে বিশ্ব তাকেই আবার ‘আক্রমণের শিকার’ হিসেবে দেখতে শুরু করবে। গাজায় নিরীহ মানুষদের হত্যা করা, পশ্চিম তীরে বসতি নির্মাণের নামে ফিলিস্তিনিদের তাদের ঘরবাড়ি থেকে উচ্ছেদ করা, এসবের পেছনে ইসরায়েলি সেনাদের ছত্রছায়ায় থাকা চরমপন্থি দখলদারদের ব্যবহার করছেন তিনি। তবে সবকিছু তার পরিকল্পনা মোতাবেক এগোচ্ছে না। মিশর এখনো তাদের আঞ্চলিক নীতিতে দৃঢ় অবস্থান ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছে। গাজা থেকে ফিলিস্তিনিদের সিনাইয়ে স্থানান্তর করার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে তারা। কারণ মিশরের সরকার জানে, একবার শরণার্থী হিসেবে ফিলিস্তিনিদের আশ্রয় দিলে, ইসরায়েল গাজার সম্পূর্ণ দখল নিয়ে নেবে এবং ফিলিস্তিনিদের আর গাজায় প্রবেশ করতে দেবে না। অন্যদিকে, পঞ্চাশ হাজারেরও অধিক ফিলিস্তিনিকে হত্যা করলেও, নেতানিয়াহুর পক্ষে গাজার সমগ্র জনগোষ্ঠীকে নিশ্চিহ্ন করা সম্ভব নয়। ফিলিস্তিনি এক খ্রিষ্টান পাদ্রি একবার আমাকে বলেছিলেন, ‘ওরা আমাদের কাউকে কাউকে মারতে পারবে। কিন্তু আমাদের সবাইকে তো আর মেরে ফেলতে পারবে না।’ তাই সংঘাত সৃষ্টি করে গণহত্যা ঢাকা দেওয়ার এ নীতি শেষ পর্যন্ত নেতানিয়াহুর জন্য বিষফল বয়ে আনবে।

একদিকে যেমন নির্বিচারে যুদ্ধ চালিয়ে পশ্চিমা সমর্থন ধরে রাখা সম্ভব হচ্ছে না, অন্যদিকে ইসরায়েলি বাহিনীকে ব্যবহার করে ফিলিস্তিনি জনগণকে পুরোপুরি নির্মূল করাও ইসরায়েলের সরকারের পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না। স্টিভ ব্যাননের মতো ইসরায়েলপন্থি প্রভাবশালী সাংবাদিকরা যুক্তরাষ্ট্রে প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছেন। তারা জানতে চাচ্ছেন যে, আমেরিকাকে কেন ইসরায়েলের স্বার্থে অহেতুক যুদ্ধে জড়াতে হবে?

বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু শুধু যুদ্ধ শুরু করতে জানেন, শেষ করতে জানেন না। সম্ভবত, তার লক্ষ্য একটাই, যতক্ষণ পর্যন্ত না পুরো ফিলিস্তিনি জনগোষ্ঠী ধ্বংস হচ্ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া। কিন্তু তার এ লক্ষ্য পূরণ হবে বলে মনে হচ্ছে না। সম্ভবত অদূর ভবিষ্যতে এমনটা দেখা যাবে যে, যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েল ও নেতানিয়াহুর অন্যায় কর্মকাণ্ডকে আর সমর্থন দিচ্ছে না। এমনটা ঘটলে নেতানিয়াহু এবং ইসরায়েলের সরকারকে ভয়াবহ পরিণতির সম্মুখীন হতে হবে।

লেখক: কূটনীতিবিদ, যুক্তরাষ্ট্র ও মধ্যপ্রাচ্যের সম্পর্কবিষয়ক বিশেষজ্ঞ। নিবন্ধটি আরব নিউজের মতামত বিভাগ থেকে অনুবাদ করেছেন অ্যালেক্স শেখ

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

‘ভুয়া তথ্য’ রুখতে জাতিসংঘের সহায়তা চাইলেন প্রধান উপদেষ্টা

কালবেলায় সংবাদ প্রকাশের পর সেই বিধবা পেলেন সহায়তা

যুক্তরাষ্ট্রে শিক্ষার্থী ভিসায় সময়সীমা আরোপের উদ্যোগ

তাসকিন-তানজিমে বিধ্বস্ত শ্রীলঙ্কা, কলম্বোতে শুরুতেই টাইগারদের দাপট

মুদি দোকানে মিলল টিসিবির ১৪৪২ লিটার তেল 

বিমানে যাত্রীদের সঙ্গে উঠে গেল সাপ, অতঃপর...

সংসদ নির্বাচনে ৪৮ লাখ ডলার দিচ্ছে জাপান

১২ কেজি এলপিজির দাম কমলো 

সরকারি অফিসে ৫০ ভাগ লোক কাজ করে না : আসিফ নজরুল

গৃহবধূকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণ, শ্রমিক দল-ছাত্রদলের ৩ নেতা বহিষ্কার

১০

নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতায় বিপিসির উদ্বেগ 

১১

ঢাবির মধুর ক্যান্টিনে ‘মুক্তির পাঠাগার’ স্থাপন করল ছাত্রদল নেতা

১২

চলে গেলেন জীনাত রেহানা

১৩

জুলাই গণঅভ্যুত্থানে শহীদদের স্মরণে যুক্তরাষ্ট্রে দোয়া মাহফিল 

১৪

পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে ইরানের বড় ঘোষণা

১৫

ডিম বাছাইকে কেন্দ্র করে দোকানিকে ছুরিকাঘাত

১৬

কাজাখস্তানে প্রকাশ্যে মুখ ঢেকে রাখা নিষিদ্ধ ঘোষণা

১৭

তেজগাঁও থেকে ছিনিয়ে নেওয়া রিয়াল উদ্ধার, আটক ৬

১৮

মাইক্রোবাস-ট্রাকের সংঘর্ষে নিহত ২

১৯

আরেক আ.লীগ নেতার কারাদণ্ড

২০
X