এদের একজনও অদেখা-অচেনা-অজানা নয়। অদৃশ্যও নয়। একদম দৃশ্যমান। তবু বাজারে, বিশেষ করে চাল বাজারে চালবাজি করে চলছে অবাধে, ফ্রিস্টাইলে, ড্যাম কেয়ারে। এদের চালবাজিতে এই ভর মৌসুমেও অযৌক্তিকভাবে বাড়ছে চালের দাম। দেশের অস্থিতিশীলতা তাদের কাছে আশীর্বাদের মতো। এ সুযোগে ‘দাম আরও বাড়বে’, এমন গুজবও রটাচ্ছে। গুজবের জেরে বেড়েছে ধান-চালের মজুতপ্রবণতা। অল্প সরবরাহ রেখে, দাম বাড়িয়ে ফায়দা লুটছে এ চালবাজরা। এক বছরে মোটা চাল ব্রি-২৮ প্রতি কেজিতে ৮ টাকা পর্যন্ত বেড়ে বিক্রি হচ্ছে। নাজিরশাইল চালও কেজিতে ১০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। ঈদের পর থেকে এখন পর্যন্ত চিকন চালের দাম বস্তায় ৪০০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। সামনে আরও বাড়বে বলে গুজব চাউর হয়েছে।
বাজারে এখন পুরোনো চাল নেই। পুরো চালই আমন মৌসুমের। প্রকৃতপক্ষে ধান-চালের কোনো সংকট নেই। সরবরাহে ঘাটতি-কমতি নেই। গুদামও চালে ভরা। তারপরও সরবরাহ কমিয়ে চালের দাম চড়ানো হচ্ছে। বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে প্রতিদিনই দাম বাড়িয়ে দিচ্ছে চালের দাম। কৃষক, মিলার, ফড়িয়া ব্যবসায়ী, পাইকারি-খুচরা বিক্রেতা কেউই কথা খোলাসা করছে না। কথা বলছে ইনিয়েবিনিয়ে। আমনের নতুন চাল বাজারে আসার আগ থেকেই দাম চড়ানোর ক্ষেত্রটা তৈরি করেছে তারা। আমন মৌসুমে নতুন চাল বাজারে ওঠার পর রীতিমতো কোপ মারছে। এবার গ্রামাঞ্চলে ব্যাপক প্রচার রয়েছে যে, ভারত ধান-চাল দেবে না, বন্ধ হয়ে যাবে। এজন্য কৃষক, ফড়িয়া ব্যবসায়ীদের মধ্যে ধান কিনে মজুত করার প্রবণতা ভর করেছে।
মোকামেই ধান মেলে না অবস্থা করতে পেরেছে এরা। এর সুবাদে শুরু থেকে এবার ধানের দাম বেশি। গেল এক-দেড় সপ্তাহের ব্যবধানেই প্রতি মণে ৭০ থেকে ৮০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। ধানের দাম বাড়ার কারণে স্বাভাবিক কারণেই চালের দাম বাড়াতে হয়েছে। দেশে চালের বড় মোকাম কুষ্টিয়া, নওগাঁ, দিনাজপুরসহ বড় বড় মোকামেও একই অবস্থা। সংকটের আতঙ্ক তৈরি করে বাজার বাড়ানোর প্রবণতা নতুন নয়। চাল নিয়ে এ প্রবণতা এবার ব্যবসায়ীদের মধ্যে খুব বেশি। আবার দাম বাড়বে এমন গুজব কিছু ব্যবসায়ীও ছড়াচ্ছে, যাতে তারা ভবিষ্যতে ভালো দাম হাতাতে পারে।
মিলমিশ এবং বোঝাপড়ায় এরা এ কাজে ভীষণ অভিজ্ঞ। বিগত সরকারের আমলে হাত পাকানো বা মদদপুষ্ট এ চালবাজরা এখন অধরাভাবেই চালাচ্ছে তাদের ক্রিয়াকর্ম। বাজারে নতুন করে চালের চাহিদা বাড়েনি। পুরোটাই কারসাজি। এর অংশীজন বেড়ে গেছে। নতুন করে বহু মানুষ স্টক বিজনেসে ঢুকেছে। তাদের চোখ খাদ্যপণ্যে। ধান, চাল, গম, ভুট্টাসহ নানা খাদ্যশস্য মজুত করছে। অসাধু ব্যবসায়ীরা সবসময়ই পণ্যের দাম বাড়ানোর পাঁয়তারায় থাকে। সময়-সুযোগ পেলেই তারা দাম বাড়িয়ে দেয়। চালের দাম বাড়ানোর ক্ষেত্রে চালকল মালিক ও ব্যবসায়ী একে অন্যকে দুষলেও আসলে উভয়ই দাম বাড়ানোর প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। তারা সম্মিলিতভাবে সিন্ডিকেট সদস্য। রাজনৈতিক পটপরিবর্তন হলেও তাদের মানসিকতা বদলায়নি। আর খাদ্যপণ্য নিয়ে চালবাজি-কারসাজি তুলনামূলক নিরাপদ। এ ছাড়া সবজি, মাংসসহ অন্যান্য পণ্যের বাজারে যেমন নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করা হয়, চালের বাজারে তেমনটা হয় না। এখানে ভোক্তা অধিকারসহ সরকারের অন্যান্য সংস্থার মনিটরিং দুর্বল। সরকার তাদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। সরকার চালের বাজার নিয়ন্ত্রণে শুল্ক কমিয়েছে, আমদানির অনুমতি দিয়েছে। তবে অনুমতির চার ভাগের এক ভাগ চালও আমদানি হয়নি। কারণ সিন্ডিকেটে মূলহোতাদের বেশিরভাগই আমদানিকারক। কিছু চালকল মালিক, বড় ব্যবসায়ী ও করপোরেট হাউস মিলেছে তাদের সঙ্গে। পাইকার, সরবরাহকারীসহ খুচরা ব্যবসায়ীরা তো সঙ্গী হিসেবে আছেই। পরস্পরের প্রতি দোষারোপের সমান্তরালে তাদের সবারই কিছু অজুহাত আছে। যার পুরোটাই আসলে চাতুরী। পাইকারদের দাবি, বর্তমানে গাড়ি ভাড়া বেড়েছে, ধানের দামও বেড়েছে। এ ছাড়া চালকলে খরচ বেশি পড়ায় দামে প্রভাব পড়েছে।
রাইস মিল মালিকদেরও অজুহাত আছে। তারা বলছে, হঠাৎ চালের সরবরাহ কমার কারণে দাম বেড়েছে। করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো চাষিদের অগ্রিম টাকা দিয়ে চাল কিনে নিচ্ছে। এতে মিল মালিকরা ধান পাচ্ছে না। তাদের হাতে হাতে এমন অনেক অজুহাত। আবহাওয়া ভালো থাকায় এবার ধানের ফলন বেশ ভালো হয়েছে। এতে চালের দাম কমার পরিবর্তে উল্টো দাম চড়ানোর জন্য অজুহাতের অন্ত নেই। চালের দাম বাড়ায় বিপাকে পড়েছে নিম্ন আয়ের খেটে খাওয়া মানুষ। তারা সংঘবদ্ধ নয়। তাদের কোনো সিন্ডিকেট নেই। বোবা কান্নাই তাদের নিয়তি। চালের দাম বাড়ার কারণ সম্পর্কে পুঁজিবাদবিরোধী ‘প্রগতিশীলদের’ একটা বিশ্লেষণ আছে। তারা মনে করে, দেশের চালের বাজারে বড় বড় প্রতিষ্ঠান ঢুকেছে। বিপুল পরিমাণ ধান মজুত করে বাজার নিয়ন্ত্রণের সক্ষমতা তাদের রয়েছে। তারা চাইলেই ব্যাংকের ঋণ পায়। তাদের কারসাজিতেই চালের দাম ভরা মৌসুমেও ঊর্ধ্বমুখী। খুচরা ও পাইকারদের যুক্তি আরেক দিকে। তারা বলছে, অতিরিক্ত দামের জন্য দায়ী মিল মালিকরা। হয়তো কারও কারও কথায় যুক্তি আছে বা সবার কথায়ই যুক্তি আছে। যার যার জায়গায় তারা ভীষণ যুক্তিবাদী। বড় পুঁজি ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে চাল কিনে রাখে গুদামে। সাময়িক মজুতদারিও করে কেউ কেউ।
এর বিপরীত বাস্তবতা হচ্ছে, পরিবারের খাওয়ার অংশটুকু বাদে বোরো মৌসুমের উৎপাদিত ধান আর কৃষকের কাছে নেই। ধান চলে গেছে ফড়িয়া, পাইকার, মজুতদার ও মিলারদের কাছে। আগেও যেভাবে ধানের সব স্তরের মজুতদার ও মিল মালিকরা মিলেমিশে চালের দাম বাড়াতে ভূমিকা রেখেছে, এবারও ঠিক তাই করছে। এবার আরেকটু ব্যতিক্রম। খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখা বোরো মৌসুমকেই টার্গেট করা খুব বাজে বার্তা দিচ্ছে। অন্যান্যবার মৌসুমের ধান ওঠার কয়েক মাস পর ধীরে ধীরে চালের দামটা বাড়ে; এবার যেখানে নতুন ধানের ব্যাপক সরবরাহের মধ্যেই দামটা বাড়তে শুরু করেছে। নমুনা কিন্তু বাজে সিগন্যাল দিচ্ছে।
আমাদের সমাজে ‘মোটা ভাত, মোটা কাপড়’—এ প্রবাদটি বহুল প্রচলিত। কিন্তু মোটা ভাত কিংবা মোটা কাপড় এই দুই-ই মোট জনগোষ্ঠীর উল্লেখযোগ্য অংশের পক্ষে জোগাড় করা কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিগত সরকারের বাণিজ্য, খাদ্য, কৃষি, পরিকল্পনামন্ত্রীসহ অনেক মন্ত্রীই বাজারের সিন্ডিকেটের কারসাজির কথা অকপটে স্বীকার করেছেন এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে সিন্ডিকেট নিয়ে তাদের বক্তব্য যেন ওই স্বেচ্ছাচারী-লুটেরাদের কাছে অসহায় আত্মসমর্পণের মতো মনে হয়েছে। বারবার বিগত সরকারের মদদপুষ্টদের দোষারোপ আর মানুষ শুনতে চায় না। ক্ষমতায় এখন দলীয় সরকার নেই। সেই সূত্রে তাদের দলীয় কর্মী পালনের এজেন্ডা নেই। এ ছাড়া সিন্ডিকেটের হোতাদের হাত কোনোভাবেই আইনের হাতের চেয়ে শক্তিশালী হতে পারে না। সিন্ডিকেটের শিকড় বা গাঁথুনি যত গভীরেই হোক, তা ধরে টান দেওয়া এ সরকারের জন্য কঠিন হওয়ার কথা নয়। কী কারণে চালের বাজার আবার হঠাৎ অস্থির হয়ে উঠল—এ প্রশ্নের জবাব কর্তৃপক্ষের যেমন খুঁজতে হবে, তেমনি অনতিবিলম্বে চালের দাম নিয়ন্ত্রণেও কঠোর কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। অতি মুনাফাখোর ব্যবসায়ীদের প্রতি কোনোরকম অনুকম্পা দেখানো কাম্য নয়। সরকারি গুদামে চালের মজুত পর্যাপ্ত। বাজারেও কোনো সংকট নেই। তারপরও সিন্ডিকেটের কাছে জিম্মি থাকবে কেন সরকার?
চালের দাম আর বাড়বে না বলে কথা দিয়েছেন উপদেষ্টাদের কয়েকজন। তার ওপর বিশ্ববাজারে চালের দাম যখন কমতির দিকে, তখন দেশের বাজার কেন ঊর্ধ্বমুখী, এ প্রশ্নের জবাব নেই। চালের যে মূল্যবৃদ্ধি অযৌক্তিক, তাও বলছেন। তাহলে অ্যাকশনে যেতে সমস্যা কোথায়? উপদেষ্টারা যখন চালের দাম নিয়ে দেশবাসীকে আশ্বস্ত করছেন, তখন প্রকৃত বাজার পরিস্থিতি উঠে এসেছে প্রথম আলোর প্রতিবেদনে। না, উপদেষ্টাদের বয়ান অনুযায়ী শুধু সরু চালের দাম বাড়েনি। বেড়েছে মোটা চালের দামও। উপদেষ্টা বা ধনাঢ্যদের কাছে তিন বা পাঁচ টাকা বৃদ্ধি হয়তো কিছু্ই নয়, কিন্তু গরিব মানুষের জন্য অনেক কিছু। কেন ধরা হচ্ছে না চালবাজ-কারসাজিওয়ালাদের? ২০২২ সালের পরের দুই বছরে ক্রমাগত উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে দেশের মানুষের ক্রয়সক্ষমতা কমেছে, এতে নতুন করে ৭৮ লাখ মানুষ দারিদ্র্যসীমায় এসেছে আর প্রায় ১ কোটি মানুষ দারিদ্র্যের ঝুঁকির মধ্যে এসেছে। এর মধ্যে আগে দরিদ্র ছিল—এমন মানুষের মধ্যে ৩৮ লাখ চরম দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে এসেছে। অর্থাৎ সব মিলিয়ে ১ কোটি ৭৮ লাখ মানুষ নতুন করে হয় দরিদ্র হয়েছে বা দারিদ্র্যের ঝুঁকিতে। ইউএনডিপির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে ৪ কোটি ১৭ লাখ মানুষ চরম দারিদ্র্যের মধ্যে বসবাস করছে। তাদের মধ্যে ৬ দশমিক ৫ শতাংশের অবস্থা গুরুতর। এ অবস্থায় চালের দাম নিয়ন্ত্রণে না আনলে উপরোক্ত অঙ্ক কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে ধারণা করা যায়?
লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট; ডেপুটি হেড অব নিউজ, বাংলাভিশন
মন্তব্য করুন