বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে সবচেয়ে আলোচিত প্রশ্ন হলো—আগামী জাতীয় নির্বাচনে বিএনপির সম্ভাব্য অগ্রগতি কতটুকু? বিশেষ করে ২০২৪ সালের জুলাইয়ে ঘটে যাওয়া গণআন্দোলনের পর দেশে একটি অবাধ, নিরপেক্ষ ও প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচনের আশা উঁকি দিচ্ছে, যার প্রেক্ষাপটে এ প্রশ্নটি আরও তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠেছে। বিএনপির অনেক নেতা যেখানে প্রকাশ্যে ৯০ শতাংশ আসনে বিজয়ের আত্মবিশ্বাসের দাবি করছেন, সেখানে নবাগত ছাত্র-রাজনৈতিক দল এনসিপির নেতারা পাল্টা বিশ্লেষণে বলছেন, বিএনপি বড়জোর ৫০ থেকে ১০০টি আসন পেতে পারে। এ বিতর্কের মধ্যে রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনা, সামাজিক বাস্তবতা এবং আঞ্চলিক রাজনৈতিক ডায়নামিকস—সবকিছুকে ছাপিয়ে ‘পরিস্থিতি’ শব্দটিই হয়ে উঠছে নির্ধারক ফ্যাক্টর।
গত ২৮ জুন চরমোনাই পীরের নেতৃত্বে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আহ্বানে আয়োজিত মহাসমাবেশে জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় নাগরিক পার্টিসহ (এনসিপি) কয়েকটি ইসলামপন্থি দল ‘আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বমূলক (PR)’ পদ্ধতির দাবি তোলে। যদিও বাংলাদেশের সাংবিধানিক কাঠামো ও নির্বাচন পরিচালনার প্রচলিত রীতির আলোকে এ পদ্ধতি এখনই বাস্তবায়নযোগ্য কি না আলোচনার বিষয়; তথাপি এ প্রস্তাব একটি নতুন রাজনৈতিক ন্যারেটিভ তৈরি করার চেষ্টা বলেই বিবেচিত হচ্ছে। বিশেষ করে, বিএনপির ‘সুইং ভোটার’ বা নিরপেক্ষ ভোটারদের মনোজগতে একটি প্রভাব ফেলতেই এ কৌশল ব্যবহার হচ্ছে—এটি অস্বীকার করা যাবে না।
এ প্রেক্ষাপটে বিএনপি তাদের অবস্থান স্পষ্ট করেছে—তারা ‘ফার্স্ট-পাস্ট-দ্য-পোস্ট (FPTP)’ ব্যবস্থাকেই সমর্থন করছে এবং এটিকে তারা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত, দ্রুত ফলপ্রসূ ও প্রত্যক্ষ গণমতের প্রতিফলনকারী একটি ভোটিং মেকানিজম হিসেবে তুলে ধরছে। তাদের মতে, এ ব্যবস্থার মাধ্যমেই একটি গ্রহণযোগ্য ও সময়োপযোগী নির্বাচন সম্ভব।
কিন্তু বাস্তব রাজনীতিতে আরও বড় প্রশ্ন দাঁড়ায়—যদি আওয়ামী লীগ নির্বাচন বর্জন করে কিংবা নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় সক্রিয় অংশগ্রহণ না করে, তাহলে বিএনপির বিজয় কতটা অর্থবহ হবে? এবং তারা আসলে কার সঙ্গে নির্বাচন করতে প্রস্তুত?
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, বিএনপির সামনে এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত সিদ্ধান্ত হলো—এনসিপি বা জামায়াতের মতো রাজনৈতিক শক্তিগুলোর সঙ্গে প্রকাশ্য জোট না গড়ে, বরং আদর্শিকভাবে ঘনিষ্ঠ ও মধ্যপন্থি দলগুলোর সঙ্গে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনভিত্তিক ঐক্য গড়ে তোলা। এতে যেমন দলটির ‘ন্যাশনাল একসেপ্টেবিলিটি’ অক্ষুণ্ণ থাকবে, তেমনি ‘আনুপাতিক ভোট ব্যবস্থার’ নামে নির্বাচনী বিলম্বের মতো যে কোনো কৌশল মোকাবিলা করা সম্ভব হবে।
এ ছাড়া তারেক রহমানের নেতৃত্বে বিএনপির অন্যতম চ্যালেঞ্জ হলো—দলীয় শৃঙ্খলা ও মাঠপর্যায়ের নিয়ন্ত্রণ। লন্ডন থেকে পরিচালিত এই রাজনৈতিক কাঠামো বাস্তব পরিস্থিতিতে কতটা কার্যকর হচ্ছে—সে প্রশ্ন এখনো বহাল। দলের একাংশে কোন্দল, চাঁদাবাজি, এমনকি সহিংসতার অভিযোগও রয়েছে, যা বিএনপির রাজনৈতিক ভবিষ্যতের জন্য একটি বড় হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে, বিশেষত তরুণ ভোটারদের মাঝে গঠিত হওয়া নতুন আশা-ভরসার প্রেক্ষাপটে।
তথ্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ২০০৮ সালের নির্বাচনে বিএনপি ৩২.৫% ভোট পেয়েও মাত্র ৩০টি আসনে জয়লাভ করেছিল। অন্যদিকে, আওয়ামী লীগ ৪৮.৪% ভোটে পেয়েছিল ২৩০টি আসন। এতে বোঝা যায়—ভোটের শতকরা হার ও আসনপ্রাপ্তির মধ্যে সরল সম্পর্ক নেই; বরং সুষ্ঠু নির্বাচনী ব্যবস্থাপনাই ফলাফল নির্ধারণে মুখ্য ভূমিকা রাখে।
অতএব, বিএনপির ৯০ শতাংশ আসনের প্রত্যাশা আপাতদৃষ্টিতে অতিরঞ্জিত মনে হলেও ১৫০ থেকে ১৭০টি আসন পাওয়া অসম্ভব নয়—যদি নির্বাচন সত্যিকার অর্থেই অবাধ ও নিরপেক্ষ হয়।
এ মুহূর্তে বিএনপির সবচেয়ে বড় শক্তি হতে পারে একটি সাহসী রাজনৈতিক ন্যারেটিভ, যা দমননীতি সত্ত্বেও টিকে থাকার প্রতিচ্ছবি। তবে তা কেবল প্রতিরোধ দিয়ে নয়, দায়িত্বশীলতা, পরিকল্পনা ও অংশগ্রহণমুখী কৌশলের মাধ্যমে।
ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে যদি একটি স্বচ্ছ, অংশগ্রহণমূলক এবং আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন সম্ভব হয়—তাহলে প্রথমবারের মতো বহু ভোটার তাদের প্রকৃত রাজনৈতিক মতপ্রকাশের সুযোগ পাবেন। তখনই বোঝা যাবে, বিএনপি কতটা জনপ্রিয়, আওয়ামী লীগ ছাড়া নির্বাচন কতটা অর্থবহ, জামায়াত ও এনসিপির বাস্তব উপস্থিতি কতখানি এবং নতুন প্রগতিশীল দলগুলোর গ্রহণযোগ্যতা আদৌ তৈরি হয়েছে কি না।
রাজনীতিতে গালভরা বক্তব্যের চেয়ে বেশি জরুরি হলো বাস্তব প্রস্তুতি, নীতিভিত্তিক অবস্থান এবং জনমুখী প্রতিশ্রুতি। কে কয়টি আসন পাবে বা কে জামানত হারাবে—এসব নিয়ে আলোচনা চলতেই থাকবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত দেবে জনগণ, ব্যালটের মাধ্যমে। আর সেই রায়কে গ্রহণযোগ্য করতে হলে চাই একটি অবাধ, প্রতিযোগিতামূলক এবং সব অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন।
তবে যদি আগামী নির্বাচন আওয়ামী লীগবিহীন হয়, তাহলে বিএনপির জন্য অতীতের শিক্ষা বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। কীভাবে জনপ্রিয়তার চূড়ায় থেকেও আওয়ামী লীগ জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল, সেই অভিজ্ঞতা বিশ্লেষণ করে বিএনপিকে তার রাজনৈতিক নীতি ও সাংগঠনিক কৌশল নির্ধারণ করতে হবে। তাহলেই দলটি আস্থার প্রতিদান দিতে পারবে এবং দেশ পেতে পারে একটি কার্যকর, টেকসই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা।
সবশেষে, যদি আমরা সত্যিই গণতন্ত্রকে রক্ষা করতে চাই, তাহলে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতার লোভ পরিহার করে ক্ষমতার ভারসাম্য ও রাজনৈতিক অংশীদারত্ব নিশ্চিত করাই এখন সময়ের দাবি। পরস্পরের বিরুদ্ধে কথার লড়াই নয়; বরং নিজেদের গ্রহণযোগ্যতা জনতার কোর্টে তুলে দেওয়াই হতে পারে গণতন্ত্রের নতুন সূচনা। আর সেই কোর্টের নামই—ভোটার।
লেখক: দুবাই প্রতিনিধি, দৈনিক কালবেলা
মন্তব্য করুন