অধ্যাপক ড. মোর্শেদ হাসান খান
প্রকাশ : ০৮ জুলাই ২০২৫, ১২:০০ এএম
আপডেট : ০৮ জুলাই ২০২৫, ০৮:১৬ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

দেশকাঁপানো ৩৬ দিন

দেশকাঁপানো ৩৬ দিন

১৬ বছর ধরে বাংলাদেশ শুধু দুর্নীতিতে পরিপূর্ণ ছিল না—ছিল একটি দমবন্ধ, ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্র। মানুষ কথা বলতে পারত না, চোখ তুলে তাকাতে পারত না, এমনকি বিশ্বাস করত না যে জনগণই রাষ্ট্রের মালিক। সরকার, বিচারব্যবস্থা, আইন—সবকিছু এক বিশাল কারাগারের প্রাচীরে রূপ নিয়েছিল। গণতন্ত্রকে নির্বাসনে পাঠানো হয়েছিল। নির্বাচনের নামে চলেছে প্রহসন আর বিরোধী কণ্ঠস্বরকে রাষ্ট্রদ্রোহী বানিয়ে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। কেউই মুক্ত ছিল না—না ছাত্র, না শিক্ষক, না সাংবাদিক, না সাধারণ নাগরিক।

আমি ছিলাম সেই কারাগারের এক প্রতিবাদী বন্দি। শুধু মতপ্রকাশের অপরাধে আমাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অন্যায়ভাবে অপসারণ করা হয়েছিল। রাষ্ট্রদ্রোহসহ অগণিত কাল্পনিক মামলার বোঝা নিয়ে আমাকে বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়তে হয়। যেদিন আমার বাসা থেকে উচ্ছেদ করা হয়, সেদিন আমার ক্যান্সার আক্রান্ত স্ত্রী কাঁদছিলেন আর আমাদের মেয়ে জানালা দিয়ে নির্বাক তাকিয়েছিল।

সেই বিশ্ববিদ্যালয় আবার জেগে উঠেছিল। কিন্তু আমি, একজন নির্বাসিত শিক্ষক, দূর থেকে অনুভব করছিলাম—এ জাগরণ কেবল ছাত্রদের নয়, আমারও এক ধরনের পুনর্জন্ম। খবরে, ভিডিওতে, ছাত্রদের মুখে শুনছিলাম—টিএসসিতে কিছু ছাত্র দাঁড়িয়ে গেছে নিঃশব্দে। কারও হাতে লেখা পোস্টার—‘আমার সোনার বাংলায়, বৈষম্যের ঠাঁই নাই’; এই একটি বাক্যে যেন সারা দেশের হতাশা, জ্বালা, আশা সবকিছু মিশে ছিল।

৪ জুলাই, যখন আপিল বিভাগ কোটা বহাল রাখে, তখন ছাত্রদের চোখে যে রাগ আর আত্মবিশ্বাস দেখলাম; তা যেন আমার নিজের দৃষ্টিতে ফিরে এলো। ‘বাংলা অবরোধ’ নামে এক স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিরোধের বিস্ফোরণ ঘটল। আমি বহু অবরোধ দেখেছি, কিন্তু এবারকার প্ল্যাকার্ড, দেয়াল লিখন, মুখের স্লোগান, চোখের ভাষা—সব ছিল ভিন্ন। তারা বলছিল, ‘কোটা না মেধা—মেধা, মেধা’, কিন্তু আমি বুঝতে পারছিলাম—এ লড়াই কেবল কোটাবিরোধী নয়, এটি এক লাঞ্ছিত প্রজন্মের আত্মমর্যাদা উদ্ধারের আন্দোলন। এক যুগের বেশি জনগণের ভোটাধিকার ডাকাতি করে অবৈধভাবে রাষ্ট্রক্ষমতা ধরে রাখা প্রধানমন্ত্রী জাতির উদ্দেশে ৭ জুলাই বলেন, ‘এই আন্দোলনের কোনো যৌক্তিকতা নেই।’ আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম। চারদিকে স্লোগান, রাজপথে ছাত্রদের চোখে প্রতিজ্ঞা, শহীদ মিনারে মানুষের ঢল আর তিনি এসবকে বলছেন, অযৌক্তিক? ইতিহাসে যখনই কোনো অবৈধ শাসক এমন মিথ্যা উচ্চারণ করেছেন, তার পরিণতি হয়েছে ভয়াবহ।

১৪ জুলাই শেখ হাসিনা বলেন, ‘যারা কোটা নিয়ে আন্দোলন করছে, তারা রাজাকারদের নাতিপুতি।’ এই কথায় কোনো রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ছিল না—এটি ছিল ইচ্ছাকৃত অপমান। অপমানের শিকার হলো দেশের সবচেয়ে মেধাবী, সাহসী আর সংবেদনশীল প্রজন্ম। একজন অবৈধ শাসক জাতির সন্তানদের বিরুদ্ধে ছুড়ে দিলেন চরিত্রহননের ঘৃণ্য অপবাদ। বিগত বছরগুলোতে বহুবার আমাকে শুনতে হয়েছে ‘রাষ্ট্রদ্রোহী’, ‘দেশদ্রোহী’, ‘গণদুশমন’। কিন্তু এবার দেখলাম, একটি সম্পূর্ণ প্রজন্মকে একযোগে রাজাকার বলা হলো—শুধু তাদের ন্যায্য দাবির কারণে। এই কথার প্রতিক্রিয়া ছিল সর্বব্যাপী, বিশ্ববিদ্যালয়ের দেয়ালে ধ্বনিত হচ্ছিল নতুন স্লোগান: ‘তুমি কে, আমি কে—রাজাকার, রাজাকার! কে বলেছে, কে বলেছে— স্বৈরাচার, স্বৈরাচার!’ আর এক কোণে, এক ছাত্রী দেয়ালে লিখছিল শক্ত হাতে: ‘চাইলাম অধিকার, হলাম রাজাকার!’ এ বাক্যগুলোই হয়ে উঠেছিল আন্দোলনের আত্মপ্রকাশ, এক বিপন্ন প্রজন্মের কণ্ঠস্বর, যাকে রাষ্ট্র চেপে রাখতে চেয়েছিল।

১৫ জুলাই দুপুরে শুরু হয় দমনযজ্ঞ—নেমে আসে রাষ্ট্রের বাহিনী ও ছাত্রলীগের হেলমেট বাহিনী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে ছাত্রীদের ওপর গরম পানি নিক্ষেপ করা হয়, ছেলেদের মাথা ফাটানো হয় লোহার রড দিয়ে। ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা মুখে কাপড় বেঁধে, হাতে অস্ত্র নিয়ে ঘুরছিল; যেন রাজপথে বিচরণ করে বেড়ানো একদল হায়েনা। তারা ঢুকে পড়ে হাসপাতালে—অসহায় চিকিৎসাধীন আহত শিক্ষার্থীদের আবারও আঘাত করে। একজন আহত ছাত্রী রক্তাক্ত মুখে বলেছিল, ‘সুস্থ হয়েই আবার যাব মিছিলে, আমার দাবি ছাড়ব না।’ আমি বুঝলাম, ইতিহাস বদলে যাচ্ছে। এবার আর কেউ মুখ বন্ধ করতে পারবে না।

১৬ জুলাই দুপুরে সামাজিকমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে একটি ভিডিও। একজন ছাত্র—বুক চিতিয়ে, দুহাত তুলে শান্তভাবে দাঁড়িয়ে আছে। সেই নিরস্ত্র ছাত্রকে পুলিশ সরাসরি গুলি করে হত্যা করে। তার নাম আবু সাঈদ। বয়স ২৩। বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্র—কোনো সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিল না। সে ছিল মিছিলের সামনের সারিতে। আমি ভিডিওটি একবার দেখেছিলাম, তারপর আর পারিনি। সাঈদ আমার ছাত্র হতে পারত, সন্তানও হতে পারত। আমি বুঝলাম—এই শাসক শুধু গণতন্ত্র হত্যা করেনি, সত্যিকারের প্রতিবাদকেই রাষ্ট্রদ্রোহী ঘোষণা করেছে।

সেদিন বিকেলে সারা দেশে গর্জে ওঠে ছাত্রসমাজ। আকাশের দিকে ওঠে মুষ্ঠিবদ্ধ হাত। তারা শুধু স্লোগান দেয়নি—তারা প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল। অসীম সাহসী, টগবগে তরুণরা সারা দেশে ছাত্রলীগ-যুবলীগ-হেলমেট লীগের গুলিতে নিহত হয়। চট্টগ্রামে শহীদ হয় ওয়াসিম। প্রতিবাদে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা ছাত্রলীগ নিয়ন্ত্রিত হলগুলো দখল করতে শুরু করে। আমি দেখলাম, যে সংগ্রামের জন্য আমাকে শিক্ষকতা হারাতে হয়েছে, মামলা খেতে হয়েছে, পরিচয় হারাতে হয়েছে—আজকের প্রজন্ম সেই সংগ্রামকে আরও একধাপ এগিয়ে নিয়েছে। আমি হারিয়ে যাইনি—আমার উত্তরসূরিরা যুদ্ধ করছে, বুক ফুলিয়ে, চোখ তুলে। আবু সাঈদের মায়ের আর্তনাদ, ‘তুই মোর ছাওয়াক চাকরি না দিবু না দে, কিন্তু মারলু ক্যানে?’—এই একটি লাইনেই যেন রাষ্ট্রের সব অহংকার, মিথ্যা আর বর্বরতা ভেঙে চুরমার হয়ে যায়।

পরদিন সকাল থেকে দেশজুড়ে হয় গায়েবানা জানাজা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী, সিলেট, চট্টগ্রাম—প্রত্যেকটি ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীরা কালো ব্যানার হাতে, মাথায় কালো কাপড় বেঁধে জড়ো হয়। কেউ কোনো মাইক ব্যবহার করেনি, কেউ দলীয় ব্যানারও তোলে না—তবু শোকের ঘনত্বে বাতাস ভারী হয়ে যায়। একটা নীরবতা ভেদ করে ভেসে আসে কণ্ঠস্বর, ‘শহীদের রক্ত বৃথা যেতে দেব না!’ আরেকদিক থেকে প্রতিধ্বনি ওঠে, ‘ভাই হত্যার বিচার চাই!’ এ যেন শোক নয়, রক্তের প্রতিজ্ঞা।

রাষ্ট্র সহ্য করতে পারল না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি এলাকায়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনারে, জাহাঙ্গীরনগরের অ্যাডমিন ভবনের সামনে আবার নেমে আসে টিয়ার গ্যাস, রাবার বুলেট, রড আর ব্যাটন। সেদিন দুপুরে আসে আরেক নির্দেশ—সব বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হল খালি করে দিতে হবে। শিক্ষার্থীরা তখন জানাজা শেষে ক্যাম্পাসে ফিরছিল, কেউ আহত বন্ধুকে খুঁজছিল, কেউ দুদিন কিছু খায়নি। হঠাৎ মাইকে ঘোষণা—‘হল ছাড়ো। ক্যাম্পাস বন্ধ।’ শুধু ঢাকায় নয়; রাজশাহী, চট্টগ্রাম, খুলনা, বরিশাল, রংপুর—সব বিশ্ববিদ্যালয়ে এ আদেশ একযোগে কার্যকর হয়। এটি ছিল একটি রাষ্ট্রীয় কৌশল—শিক্ষার্থীদের বিচ্ছিন্ন করে আন্দোলনের শিকড় কেটে ফেলার চেষ্টা। সন্ধ্যায় প্রধানমন্ত্রী জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন। স্বজন হারানোর মেকি কান্না। অন্যায়, অপশাসন, নির্যাতন জায়েজ করার চিরাচরিত প্রহসন। (বাকি অংশ আগামীদিন)

লেখক: অধ্যাপক, মার্কেটিং বিভাগ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

চার বছর পর টেস্ট দলে ফিরছেন আর্চার

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ‘জুলাই পুনর্জাগরণ’ অনুষ্ঠান পালনের নির্দেশ

সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান ও তার পরিবারের ৫৭৬ কোটি টাকা ফ্রিজ

ভারতে ঢুকেই স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা গ্রেপ্তার

পলাতক আ.লীগ নেতাকে ধরে পুলিশে দিল স্থানীয় জনতা

পাকিস্তানি অভিনেত্রীর মরদেহ নিতে অস্বীকৃতি বাবার

পানিতে ফেলে যমজ মেয়েকে হত্যা করেন মা 

চব্বিশের পাতানো নির্বাচনে অংশগ্রহণকারীদের নিয়ে ঐক্য নয় : জমিয়ত

ইসরায়েলে র‌্যাগিংয়ের নামে নবীন সেনাদের যৌন নির্যাতন, ৭ সিনিয়র আটক

মুরাদনগরের সেই নারীর ভিডিও ছড়ানোর ‘মূলহোতা’ ৫ দিনের রিমান্ডে

১০

পরিবেশবান্ধব ভাস্কর্যের দাবিতে জেলা প্রশাসককে স্মারকলিপি দিল কক্সবাজার কমিউনিটি অ্যালায়েন্স

১১

এসএসসির ফল প্রকাশে কোনো আনুষ্ঠানিকতা থাকছে না : শিক্ষা মন্ত্রণালয়

১২

ভারি বর্ষণে যমুনায় বাড়ছে পানি

১৩

ভারতীয় যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত, দুই পাইলট নিহত

১৪

সেমির আগে রিয়াল মাদ্রিদের বিমান দুর্ভোগ, প্রস্তুতি নিয়ে চরম বিশৃঙ্খলা

১৫

এরদোয়ানকে অপমান করায় তুরস্কে ইলন মাস্কের চ্যাটবট ব্লক

১৬

মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরে বাংলাদেশ প্রসঙ্গ

১৭

জবির ইসলামের ইতিহাস বিভাগ অ্যালামনাইয়ের সভাপতি খলিল, সম্পাদক মামুন

১৮

বিএমইউতে এআই রোবট দেবে ফিজিওথেরাপি, চালু হচ্ছে কাল

১৯

বিয়ে করতে চান সালমান খান

২০
X