গত ২২ এপ্রিল জম্মু-কাশ্মীরের পেহেলগামে বন্দুকধারীদের হামলায় ২৬ জন বেসামরিক নাগরিক নিহত হন। এর পরিপ্রেক্ষিতে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে বসবাসকারী কথিত ‘অনুপ্রবেশকারীদের’ ধরতে অভিযান শুরু করে দেশটির কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। ‘অবৈধ অভিবাসী’ সন্দেহে বিভিন্ন রাজ্যে গ্রেপ্তার বাংলা ভাষাভাষীদের উড়োজাহাজে করে বাংলাদেশ সীমান্ত এলাকায় আনা হয়। এরপর তাদের তুলে দেওয়া হয় বিএসএফের হাতে। আর বিএসএফ সময় ও সুযোগ বুঝে বাংলাদেশে ঠেলে পাঠিয়ে দিচ্ছে তাদের। ৭ মে প্রথম দফায় খাগড়াছড়ি জেলার মাটিরাঙ্গা ও পানছড়িতে ৬৬ ও কুড়িগ্রাম সীমান্ত দিয়ে আরও ৩৬ জনকে দিয়ে শুরু হওয়া ‘পুশইন’ এখনো অব্যাহত রয়েছে। ২২ সীমান্ত জেলা দিয়ে ঠেলে পাঠানো হতভাগ্যদের সংখ্যা দুই হাজার ছাড়িয়ে গেছে। এর মধ্যে ১১০ জনকে ভারতীয় হিসেবে শনাক্ত করেছে বিজিবি। তাদের মধ্যে ১০৬ জনকে ভারতে পুশব্যাক করা হয়েছে। এ ছাড়া রয়েছে বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাও। প্রায় প্রতিদিনই বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে বাংলাভাষী মুসলিম নাগরিকদের বাংলাদেশে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া সুন্দরবন এলাকা দিয়ে ৭৮ জনকে পুশব্যাক করা হয়। যাদের কেউ কেউ পুশইনের পর বিএসএফের বিরুদ্ধে নির্যাতনের অভিযোগ করেন। আইনি প্রক্রিয়া ছাড়া ভারতীয়সহ অন্যান্য দেশের নাগরিকদের বাংলাদেশে জোর করে ঠেলে দেওয়ার ঘটনায় সে দেশের মানবাধিকার সংগঠনগুলো এরই মধ্যে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে। তবে মোদি সরকার বিষয়টি এখনো আমলে নেয়নি বলে অভিযোগ রয়েছে।
বাংলাদেশের কূটনীতিকরা বলছেন, ‘পুশব্যাক করে পাঠিয়ে দেওয়া যায়। তাতে লাভ কী হবে? মানুষগুলোর শুধু কষ্ট বাড়বে। এটা তো সমাধান নয়। একটা প্রতিক্রিয়া জানানো হবে মাত্র। কাজেই এখানে কূটনৈতিক ব্যবস্থাপনা ও আলোচনা ছাড়া সমাধান সম্ভব নয়।’ পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন বলেছেন, “ভারত থেকে ‘পুশইন’ বাস্তবিক অর্থে ঠেকানো সম্ভব নয়। এ নিয়ে দেশটিকে একাধিক চিঠি দিয়ে ঘটনাকে ‘গভীর উদ্বেগজনক’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। আমরা বলছি এটি যাতে পদ্ধতি অনুযায়ী হয়।” বিজিবি কর্মকর্তারা বলছেন, যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ না করে পুশইনের ঘটনায় পতাকা বৈঠকের মাধ্যমে মৌখিক ও লিখিতভাবে বিএসএফের কাছে জোরালো প্রতিবাদ জানানো হচ্ছে সবসময়। সংবেদনশীল সীমান্ত এলাকায় বিজিবি উচ্চ সতর্কতায় রয়েছে। নজরদারি এবং টহল জোরদার করা হয়েছে। এ ছাড়া স্থানীয়দেরও এ ব্যাপারে সজাগ থাকতে অনুরোধ করা হয়েছে। কিন্তু বিএসএফ পুশইন বন্ধ করেনি। এ ছাড়া বাস্তুচ্যুত মিয়ানমারের নাগরিকদের বাংলাদেশে ঠেলে না দিয়ে তাদের আদিনিবাস মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর অনুরোধ জানানো হয়। কিন্তু কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।
সীমান্তে পুশব্যাক বা পুশইন আসলে একটা পদ্ধতি। ধরা পড়া ব্যক্তিদের অন্য দেশের সীমান্তে ঠেলে দেওয়া হয়ে থাকে। এ প্রক্রিয়ার কোনো আইনি স্বীকৃতি নেই। এটি আন্তর্জাতিক অভিবাসন ও মানবাধিকার আইন অনুযায়ী বিতর্কিত। অনেক ক্ষেত্রে অবৈধ হিসেবে বিবেচিত হয়। আন্তর্জাতিক আইনে ‘পুশইন বা পুশব্যাকের’ কোনো নির্দিষ্ট সংজ্ঞা নেই। তবে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এবং হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বহুবার দক্ষিণ এশিয়ার সীমান্তে ‘পুশইন’ প্রক্রিয়াকে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘন হিসেবে অভিহিত করেছে। ২০১৮ সালে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলেছিল, ‘ভারতের পুশব্যাক নীতিতে আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘিত হয়। এতে মানুষ রাষ্ট্রবিহীন হওয়ার ঝুঁকিতে পড়ে।’ ভারতের দিক থেকে যেটা পুশব্যাক, বাংলাদেশের চোখে সেটাই পুশইন। একে আন্তর্জাতিক আইন এবং মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন হিসেবে দেখছেন মানবাধিকার কর্মীরা। অন্যদিকে বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশের ওপর চাপ সৃষ্টির নতুন কৌশল হিসেবে ‘পুশইন’ চলছে। এ সুযোগে ভারত বড় ধরনের অপরাধীদেরও পাঠাতে পারে বলে শঙ্কা রয়েছে। যাদের পুশইন করা হচ্ছে, তাদের পরিচয় শনাক্ত খুব জরুরি।
ঠেলে পাঠানো বাংলাদেশিদের অধিকাংশই নিম্ন আয়ের মানুষ। তারা বিভিন্ন সময়ে কাজের খোঁজে অবৈধ পথে ভারতে পাড়ি জমিয়েছিলেন। দশকের পর দশক সেখানে বিভিন্ন রাজ্যে ছোটখাটো কারখানা ও ইটভাটায় শ্রমিক বা দিনমজুর হিসেবে কাজ করতেন। তাদের মধ্যে কেউ কেউ সেখানে বিয়ে করেছেন। ভারতে সন্তানাদিও জন্মগ্রহণ করেছে। তাদের নাগরিকত্বসহ বিভিন্ন বিষয়ে জটিলতা সৃষ্টি হওয়ার শঙ্কা থেকে পুশইন করা হচ্ছে বলে মনে করছেন তারা। সম্প্রতি ভারতের পুলিশের হাতে আটকের পর জেলে বন্দি ছিলেন অনেকে। তারপর বিএসএফ সদস্যরা তাদের বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেন। হাত ও চোখ বেঁধে সীমান্ত এলাকায় নিয়ে আসা হয়। পরে হাত ও চোখের বাঁধন খুলে সুকৌশলে বাংলাদেশে পুশইন করা হয়। তারা আরও জানান, তাদের পরিচিত হিন্দু ধর্মাবলম্বী অনেক বাংলাদেশির ভারতীয় পরিচয়পত্র, আধার কার্ড, প্যান কার্ড সবই রয়েছে। ধর্মীয় পরিচয়ের কারণে পুশইন ঠেকাতে পারছে অনেক বাংলাদেশি। স্বধর্ম ও সুসম্পর্কের কারণে অনেক ভারতীয় বাংলাদেশি হিন্দুদের রক্ষায় সহযোগিতা করছেন। কিন্তু বাংলাভাষী মুসলমানদের ঝুঁকি দিন দিন বাড়ছে। এমনকি আসামের মুসলিমরাও বাংলাদেশে পুশইনের শিকার হচ্ছেন।
সম্পর্কের ব্যাপারটা আসলে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। গত বছর বাংলাদেশে জুলাই অভ্যুত্থান সংঘটিত হওয়ার পর থেকেই ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি ঘটতে থাকে। তাদের সঙ্গে অতি সুসম্পর্কে থাকা ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারের পতন সহজভাবে মেনে নিতে পারেনি পৃষ্ঠপোষক মোদি প্রশাসন। উপরন্তু, বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারপ্রধান ড. মুহাম্মদ ইউনূসের একের পর এক সাহসী মন্তব্যে দ্রুত দূরত্ব বাড়তে থাকে। ভারতীয় গদি মিডিয়ার অব্যাহত খিস্তিখেউড়ে দূরত্বকে আরও কণ্টকিত করে তোলে। দুই দেশের জনগণের দীর্ঘদিনের আত্মীয়তার ঐতিহাসিক সম্পর্ক প্রশ্নবিদ্ধ হয় রাজনৈতিক কূটচালে। এর মধ্যে পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হয় কাশ্মীর হামলার ঘটনায়। বাংলাদেশিদের সঙ্গে যোগ হয় মুসলিম পরিচয়। দুইয়ে মিলে শত্রুজ্ঞানে বাংলাদেশি তাড়ানোর অভিযানে নামে নিষ্ঠুরতায় অমিত তেজি শাহ বাহিনী। তারা ভারতজুড়ে বীরবিক্রমে খুঁজে বেড়ায় নিরীহ, শ্রমজীবী বাংলাদেশি এবং বাংলাভাষী মুসলিম। অন্যদিকে, আশ্রয়ের দুয়ার খুলে দেয় পতিত আওয়ামী লীগ সন্ত্রাসী, লুটপাটকারী, অর্থ পাচারকারীদের জন্য। একই সঙ্গে দ্বিমুখী নীতি নেয় ভারত সরকার। আওয়ামী লীগের বিনা ভোটের কোনো কোনো সংসদ সদস্য ভারতীয় নাগরিক বলেও অভিযোগ পাওয়া যায়। সেখানে তাদের আধার কার্ড, বাড়িঘর, ব্যবসা-বাণিজ্য, পাচার করা অর্থ সুরক্ষা দেয় ভারত। শত শত আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীকে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় সীমান্ত পার করে নিজ দেশে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়েছে তারা। ভারতের মতো বিশাল গণতান্ত্রিক দেশ এসব কারণে বিশ্বে নিন্দিত হচ্ছে। নিজ দেশে মোটামুটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানে বাধ্য হলেও, বাংলাদেশের জনগণের সঙ্গে এ নিয়ে মশকরা করেছে।
ভারত তাদের হাতের পুতুল করে রেখেছিল পুতুলের মা শেখ হাসিনাকে। ‘সম্পর্কের কারণে এটা হতেই পারে’—আপাতদৃষ্টিতে এ আপ্তবাক্যের আড়ালে অনৈতিক লেনদেন প্রতিষ্ঠা করে রেখেছিল গত দেড় দশক; লোকদেখানো নির্বাচিত সরকার। কিন্তু অনির্বাচিত, কর্মবীর, অন্তর্বর্তীকালীন ইউনূস সরকার কী করছে? বৈষম্যবিরোধী বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখিয়ে বড় বড় প্রকল্প নিয়ে ব্যস্ত রয়েছে। সমুদ্র (সমুদ্রবন্দর), আকাশ (তথ্যপ্রযুক্তি ও স্টারলিংক), সীমান্তের মতো বিশাল বিশাল স্থায়ী ব্যাপারে মনোযোগ সাময়িক সরকারের। অথচ দরিদ্র মানুষ দেশে উপযুক্ত কাজ না পেয়ে অবৈধ পথে ভারত যায় দিনমজুরি করতে। সেখানে নিষ্ঠুরভাবে নিগৃহীত হয়ে দেশে ফেরে। এ তো ভীষণ লজ্জার বিষয়। ভারতবিরোধী বড় বড় কথা বলে সস্তা বাহবা পাওয়া যেতে পারে। কিন্তু স্বনির্ভর না হতে পারলে তো ভারত মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হবে। এটা বোঝার জন্য রকেট সায়েন্সের জ্ঞান লাগে না। রাজনৈতিক সরকার গরিব-দুঃখীদের শুধু মিছিল-মিটিংয়ে চায়। তাদের ভাগ্যোন্নয়নে কাজ করে না। বড় বড় ব্যবসায়ীর স্বার্থ দেখে। এরকম বদনাম প্রচলিত আছে রাজনৈতিক দলগুলোর বিরুদ্ধে। নির্দলীয় ও মেধাবী সরকারের বার্ষিক প্রতিবেদন পেশ করার সময় হয়ে এলো। তারা কি সবার কথা বলতে পেরেছে বছরজুড়ে? গণমাধ্যমইবা কতটুকু গণমুখী ভূমিকা রাখল ফ্যাসিস্টমুক্ত পরিবেশে? শুরুতে গণমাধ্যমে গুরুত্ব পেয়েছে পুশব্যাকের খবর। এখনো প্রায় প্রতিদিন ঘটছে পুশইন-পুশব্যাক। কোনো কোনো কাগজে কখনো কখনো ভেতরের পাতায় সিঙ্গেল কলামে অনাদরে ঠাঁই পায় এ খবর। অথচ, অমানবিক এই ঠেলাঠেলির দ্রুত সমাধানের জন্য ভারতের সঙ্গে আলোচনার সম্পর্ক জরুরি। ভারতের সঙ্গে আওয়ামী লীগের মতো নতজানু পররাষ্ট্রনীতি নয়। আবার আবেগের আতিশয্যে অপেশাদার আচরণও করা যাবে না। চোখে চোখ রেখে মর্যাদাপূর্ণ কূটনীতি প্রতিষ্ঠা করতে হবে। শেষদিকে নিরীহ শ্রমিকদের বাদ দিয়ে গণহত্যার আসামিদের পুশব্যাকের দাবি জোরালো করা উচিত সরকারের। জ্বলন্ত জুলাইয়ের পর আসছে রক্তবৃষ্টির আগস্ট। জবাবদিহির জন্য কতটা তৈরি নতুন বাংলাদেশ?
লেখক: হেড অব নিউজ, আরটিভি
মন্তব্য করুন