স্বাভাবিক ও পরিপূর্ণ জীবনের জন্য একজন মানুষের শারীরিক সুস্থতার পাশাপাশি মানসিক সুস্থতাও জরুরি; কিন্তু বেশিরভাগ সময় মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয় উপেক্ষিত থেকে যায়। ফলে দেখা যায়, দীর্ঘদিন মানসিক যন্ত্রণায় ভুগে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হিসেবে অনেকেই নিজেকে শেষ করে দেওয়ার পথ বেছে নেয়। এসব ঘটনা সব স্তরের মানুষের মধ্যেই ঘটতে পারে। তাই মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিতে কাজ করা জরুরি।
২০২৪ সালে আঁচল ফাউন্ডেশনের ৮৮টি বিশ্ববিদ্যালয়ে জরিপের তথ্য অনুসারে, দেশের ৮০ শতাংশ শিক্ষার্থী হতাশায় ভুগছে। এদের মধ্যে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ৮৩.৪ শতাংশ শিক্ষার্থী, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ৭৯.৯ শতাংশ শিক্ষার্থী এবং জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ৬১.৩ শতাংশ শিক্ষার্থী হতাশায় ভুগছে। মূলত ক্লাস, পরীক্ষা, অন্যান্য পড়াশোনার চাপ ও প্রত্যাশিত রেজাল্ট না আসায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর। এ ছাড়া আবাসন সংকট, আর্থিক সংকট, ব্যক্তিগত বা পারিবারিক সম্পর্কের টানাপোড়ন এবং চাকরি বা ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তায় অনেকের মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতি হচ্ছে। স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতির চিত্র অব্যাহত রয়েছে। শুধু যে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতি হচ্ছে, তা নয়। মাধ্যমিক পর্যায়েও শিক্ষার্থীরা মানসিক স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে ভুগছে। এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০২৪ সালে আত্মহত্যা করা ৪৬.১ শতাংশই মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থী। যাদের মধ্যে ৯৪ শতাংশই মানসিক চিকিৎসার ঘাটতি রয়েছে এবং এদের হতাশার মূল কারণ একাডেমিক চাপ, পরীক্ষার ফলাফল খারাপ হওয়া, রাগ-অভিমান ও প্রেমঘটিত।
এই বিশালসংখ্যক শিক্ষার্থীর মানসিক স্বাস্থ্য উন্নতিতে এখনই কাজ করা জরুরি। সর্বপ্রথম, পরিবারের উচিত তাদের সন্তানের মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিতে মনোযোগী হওয়া। এরপর পরিবারের বাইরে একটা বড় সময় শিক্ষার্থীরা তাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কাটায়। এ ক্ষেত্রে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষায় ব্যাপক ভূমিকা পালন করতে পারে; কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক বিষয় হচ্ছে, বেশিরভাগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতন নয়। এমনকি দেশের প্রথম সারির অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে নেই একজন অভিজ্ঞ মনোরোগ বিশেষজ্ঞ, নেই কোনো কাউন্সেলিং সেন্টার বা মানসিক স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র। অথচ একজন শিক্ষার্থীর সুস্থ বিকাশে শারীরিক স্বাস্থ্যের পাশাপাশি মানসিক স্বাস্থ্যের দিকেও নজর দেওয়া উচিত। তাই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উচিত একজন অভিজ্ঞ মনোরোগ বিশেষজ্ঞ নিয়োগ দিয়ে মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য আলাদা সেবাকেন্দ্র স্থাপন করা। পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের আর্থিক সহায়তা প্রদান ও আবাসিক সংকট নিরসন করা। তা ছাড়া শিক্ষার্থীদের পুষ্টিকর খাদ্য সরবরাহ করা। কারণ আমাদের দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর আবাসিক হলগুলোয় মানসম্মত ও পুষ্টিগুণ সম্পন্ন খাবার রান্না ও পরিবেশন করা হয় না। ফলস্বরূপ অপুষ্টিজনিত কারণ থেকেও মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতি হয়। এ ছাড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো মানসিক স্বাস্থ্য উন্নয়নে সভা, সেমিনার বা শিক্ষক-অভিভাবক-শিক্ষার্থীদের নিয়ে মতবিনিময় সভার আয়োজন করতে পারে। সচেতনতামূলক প্রচারণা চালানো এবং মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিতে গবেষণা চালিয়ে এর পেছনে কারণ এবং যুগোপযোগী সমাধান খুঁজে বের করতে পারে। অন্যদিকে মানসিক স্বাস্থ্য ঝুঁকি এড়াতে সহপাঠীরাও অন্যতম ভূমিকা পালন করে। তারা তাদের অন্য সহপাঠীদের বিষন্নতা, ব্যর্থতা ও একাকিত্বকে মজার পাত্র হিসেবে না নিয়ে তাদের প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শন করা এবং তাদের পাশে থাকা। আমাদের দেশে গ্রামাঞ্চলে মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে নানা কুসংস্কার, নেতিবাচক কথা প্রচলিত আছে। ফলে অনেকে নিজের মধ্যে থাকা মানসিক স্বাস্থ্য ঝুঁকিকে এড়িয়ে চলে এবং যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করে না। যার ফলে কখনো কখনো দেখা যায় আত্মবিনাশের মতো অপ্রত্যাশিত ঘটনা। তাই প্রচলিত এসব কুসংস্কার থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। এ ক্ষেত্রে সচেতনতামূলক প্রচারণা ও প্রান্তিক পর্যায় পর্যন্ত স্বল্পমূল্যে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দেওয়াই হবে কার্যকরী পদক্ষেপ।
সর্বোপরি, মানসিক স্বাস্থ্য কখনো উপেক্ষিত হতে পারে না। আগা মীর প্রজন্মের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে পরিবার, রাষ্ট্র আর সমাজের সচেতন নাগরিককে এগিয়ে আসতে হবে। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টা পারে মানসিক স্বাস্থ্য ঝুঁকি থেকে তরুণ প্রজন্মকে রক্ষা করতে।
নুসরাত সুলতানা
শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
মন্তব্য করুন