নির্বাচনী প্রতীক হিসেবে ‘শাপলা’ না পেলে রাজনৈতিক লড়াই করবে জাতীয় নাগরিক পার্টি—এনসিপি। গত রোববার প্রধান নির্বাচন কমিশনার নাসির উদ্দিনের সঙ্গে দেখা করার পর প্রেস ব্রিফিংয়ে এ ঘোষণা দেন এনসিপির মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী। তিনি দাবি করেন, ‘শাপলা ছাড়া আমাদের বিকল্প অপশন নেই।’ একই দিন সন্ধ্যায় নির্বাচন কমিশনার আব্দুর রহমানেল মাছউদ বলেছেন, এখনই শাপলা প্রতীক হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে না। যে কোনো দল যে কোনো প্রতীক চাইতে পারে। তবে, নির্বাচন কমিশনের তপশিলে এ প্রতীক নেই। এনসিপি দল হিসেবে নিবন্ধন পেলে এসব পর্যালোচনা করে দেখা হবে।’ এর আগে প্রতীক হিসেবে ‘শাপলা’কে নির্বাচন পরিচালনা বিধিমালার তপশিলভুক্ত না করার বিষয়ে নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে নির্বাচন কমিশন। তখন তিনি বলেন, ‘জাতীয় প্রতীক শাপলা ও জাতীয় পতাকার বিষয়ে সুস্পষ্ট আইনে বলা রয়েছে। সংবিধানে এর উল্লেখ আছে। এ দুটির মর্যাদা অক্ষুণ্ন রাখার জন্য আইন করা হয়েছে। একটা বিধিমালা রয়েছে। কোনো ব্যাপারে জাতীয় ফুল, জাতীয় পাখির বিষয় সুনির্দিষ্ট নেই।’
গত ৯ জুলাই এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেন, নির্বাচনী প্রতীক হিসেবে শাপলা বাদ দেওয়ার ক্ষেত্রে ইসির ব্যাখ্যা গ্রহণযোগ্য নয়। নতুন রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন পেতে বাধা তৈরির অভিযোগও করেন তিনি। আর দলটির উত্তরাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম বলেন, ‘শাপলা যদি রাজনৈতিক দলের প্রতীক হিসেবে স্বীকৃতি না পায়, তাহলে ধানের শীষও প্রতীক হিসেবে গ্রহণযোগ্য হওয়া উচিত নয়। শাপলা জাতীয় প্রতীকের একটি অংশ। একইভাবে ধানের শীষ, পাটপাতা এবং তারকাও জাতীয় প্রতীকের অংশ। আর যদি মার্কা দেখেই ভয় পান তাহলে সেটা আগে থেকেই বলেন!’ তবে, শাপলা নিয়ে অনড় মনোভাব দেখালেও সম্প্রতি উত্তরাঞ্চল সফরে দলটির একাধিক নেতা মার্কা দেখে ভোট না দিতে আহ্বান জানিয়েছেন।
গত ২২ জুন দল নিবন্ধনের আবেদন করে এনসিপি। তারা দলীয় প্রতীক হিসেবে ‘শাপলা’ চেয়ে আবেদন করে। বিকল্প প্রতীক হিসেবে ‘কলম’ ও ‘মোবাইল ফোন’ চায়। এদিকে, নির্বাচনে ব্যবহৃত দলীয় প্রতীক পরিবর্তনের জন্য নির্বাচন কমিশনে আবেদন করেছে নাগরিক ঐক্য। বর্তমান প্রতীক ‘কেটলি’র পরিবর্তে ‘শাপলা’ চেয়েছে। ২ জুলাই প্রধান নির্বাচন কমিশনারের সঙ্গে দেখা করে তারা এ আবেদন করে। একই সঙ্গে তারা জানায়, ২০১২ সালে তাদের শাপলা প্রতীক দেওয়া হয়নি। তখন কমিশনের যুক্তি ছিল, কমিশনের গেজেটভুক্ত প্রতীকের তালিকায় শাপলা নেই। এটি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের জাতীয় প্রতীকের সাদৃশ্য। তাই তাদের প্রতীকটি দেওয়া যাচ্ছে না। এখন শাপলা নিয়ে দুই নাগরিকের (জাতীয় নাগরিক পার্টি ও নাগরিক ঐক্য) মধ্যে টানাটানি হচ্ছে। এনসিপির লড়াইয়ের হুংকারের বিপরীতে মাহমুদুর রহমান মান্নার নাগরিক ঐক্য সুবিচার প্রত্যাশা করছে। এ ক্ষেত্রে কোনো বৈষম্যের শিকার হতে চায় না তারা।
বর্তমানে নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধিত দলের সংখ্যা ৫০। ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনে এ সংখ্যা বাড়তে চলেছে। এরই মধ্যে নির্বাচন কমিশনে ১৪৭টি নতুন রাজনৈতিক দল নিবন্ধনের জন্য আবেদন করেছে। বর্তমানে নির্বাচন পরিচালনা বিধিমালার সংশ্লিষ্ট বিধিতে প্রতীক বরাদ্দ রয়েছে ৬১টি। সম্প্রতি বরাদ্দ নেই এমন তিনটি প্রতীক—সোনালি আঁশ, কেটলি ও ঈগল তিনটি দলকে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। নির্ধারিত প্রতীকগুলোর মধ্যে অবশিষ্ট রয়েছে কলার ছড়ি, কুমির, কুড়াল, খাট, তবলা, তরমুজ, দাবাবোর্ড, দালান, বাঁশি, বেঞ্চ, বেলুন, শঙ্খ ও স্যুটকেস—এই ১৩টি। নিবন্ধনের জন্য আবেদন করেছে এমন অনেক দল নির্ধারিত এসব প্রতীকের বাইরেও কিছু প্রতীক বরাদ্দ চেয়েছে। ১৯৭২ সালের নির্বাচন পরিচালনা বিধিমালার সংশ্লিষ্ট বিধিতে সংসদ নির্বাচনের জন্য ৭৩টি প্রতীক নির্ধারণ করা ছিল। এগুলো নিয়েই চারটি সংসদ নির্বাচন সম্পন্ন হয়। কিন্তু বড় ধরনের বিপত্তি বাধে পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময়। সে সময় ১১১টি রাজনৈতিক দল বা জোট নির্বাচন কমিশনের কাছে প্রতীক বরাদ্দের জন্য আবেদন জানায়। ওই সময় নির্বাচন কমিশনে দল নিবন্ধনের বাধ্যবাধকতা না থাকায় যে কোনো দল বা জোটের নির্বাচনে অংশগ্রহণের সুযোগ ছিল। রাজনৈতিক দল বা জোটের সঙ্গে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের চাহিদা বিবেচনায় নিয়ে তৎকালীন নির্বাচন কমিশন নতুন করে ১৪০টি প্রতীক নির্ধারণ করে। এর মধ্যে ৯০টি প্রতীক রাখা হয় রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য আর ৫০টি প্রতীক রাখা হয় স্বতন্ত্র প্রার্থীদের জন্য।
প্রতীকের এ পরিসংখ্যানের আড়ালে আছে হাস্যরসের নানা দেশি-বিদেশি আখ্যান। বিধানসভা নির্বাচন ঘিরে ২০১৩ সালে ভারতের মধ্যপ্রদেশের রাজনীতি ব্যাপক উত্তপ্ত হয়ে পড়ে। প্রধান দুই প্রতিপক্ষ কংগ্রেস ও বিজেপি প্রায় প্রতিদিনই একে অন্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে নির্বাচন কমিশনে। ইন্দোরের অদূরে এক গ্রামে কংগ্রেস আবিষ্কার করল বিশাল পুকুরভর্তি পদ্ম ফুল। আর পুকুর পাড়ের স্কুলটাই ভোটকেন্দ্র। তারা কমিশনের কাছে দাবি জানায়, ভোট গ্রহণের আগে পুকুরকে পদ্মশূন্য করতে হবে। কেননা, পদ্ম বিজেপির প্রতীক। মানুষ পুকুরভর্তি পদ্ম দেখে বিজেপিতে ভোট দিতে বাড়তি আগ্রহ পেয়ে যেতে পারে। জবাবে বিজেপি নির্বাচন কমিশনকে বলল, কমিশন যেন কংগ্রেসের নেতাকর্মীদের হাতের কবজি ঢেকে রাখতে আদেশ দেয়। কারণ, ‘হাত’ কংগ্রেসের নির্বাচনী প্রতীক। এই বিবাদে নির্বাচন কমিশন কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। প্রতীক নিয়ে এমন বিবাদ, বিড়ম্বনার নজির আরও আছে ভারতে। আম আদমি পার্টি সৃষ্টির পর প্রথম নির্বাচনে তারা দলীয় প্রতীক ঝাড়ু চেনাতে, রাস্তাঘাট ঝাঁট দেওয়ার কর্মসূচি নিয়েছিল। হাজার হাজার ঝাড়ু কিনে সাধারণ মানুষের মধ্যে বিতরণ করে তারা। বিজেপি ও কংগ্রেস, দুই দলই অরবিন্দ কেজরিওয়ালের পার্টির বিরুদ্ধে কমিশনে নালিশ করেছিল তখন।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান দুই দলের নির্বাচনী প্রতীকের ইতিহাস তো খুবই কৌতুকময়। ব্যঙ্গ কার্টুনের মাধ্যমে ডেমোক্রেটদের ‘গাধা’ ও রিপাবলিকদের ‘হাতি’র উৎপত্তি। দুটি কার্টুনই এঁকেছিলেন টমাস ন্যাস্ট। ১৮২৪ সালের যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে চার প্রার্থীই ছিলেন ‘ডেমোক্রেটিক-রিপাবলিকান’ দলের। সেখানে একজন প্রার্থী ছিলেন অ্যান্ড্রু জ্যাকসন। ‘ডামি প্রার্থী’ হিসেবে প্রার্থিতা দেওয়া হলেও সাবেক এই মিলিটারি জেনারেল প্রায় ৪২ শতাংশ ভোট পান। কেউ একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পাওয়ায় দ্বিতীয় ধাপে যায় নির্বাচন। পরে বাকি প্রার্থীদের কূটকৌশল তাকে বঞ্চিত করে। বিষয়টি ভালোভাবে নেয়নি জ্যাকসন ও তার সমর্থকরা। তারা ‘ডেমোক্রেটিক পার্টি’ নামে নতুন রাজনৈতিক দল খোলেন। ক্ষমতাসীন ডেমোক্রেটিক-রিপাবলিকান পার্টির মূল্যবোধ নিয়ে প্রশ্ন তোলা শুরু করেন। এ সময় ক্ষমতাসীন দল ও তাদের গণমাধ্যম জ্যাকসনকে নিয়ে হাসিঠাট্টা শুরু করে। তাকে ‘জ্যাকঅ্যাস’ বলে সম্বোধন করে। এমনকি গাধার ব্যঙ্গচিত্রের মাধ্যমে জ্যাকসন ও তার অনুসারীদের ইঙ্গিত করে পত্রিকাগুলো। জ্যাকসন সেই ‘অ্যাস’ বা গাধাকেই বানান তার দলের প্রতীক। এ প্রতীক নিয়েই ১৮২৮ সালের নির্বাচনে ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্টকে হারান জ্যাকসন।
ডেমোক্রেটিকদের উত্থানের ফলে বিলুপ্ত হয়ে যায় ‘ডেমোক্রেটিক-রিপাবলিকান’ পার্টি। পরে ডেমোক্রেটিক পার্টি থেকে বেরিয়ে আসা আব্রাহাম লিংকন এবং দাসপ্রথাবিরোধী হুইগরা মিলে গড়ে তোলেন নতুন রাজনৈতিক দল ‘রিপাবলিকান পার্টি’। ষাটের দশকে লিংকনের ক্ষমতালাভ এবং গৃহযুদ্ধের মাধ্যমে দাসপ্রথা বিলুপ্তির পর রিপাবলিকান পার্টি বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। তাদের ভোটার সংখ্যাও বেড়ে যায়। ১৯৭৪ সালে ন্যাস্ট তার কার্টুনে ‘রিপাবলিকান পার্টি’কে একটি বিশাল ‘হাতি’ রূপে দেখান। সেখান থেকেই হাতিকে দলীয় প্রতীক হিসেবে বেছে নেয় রিপাবলিকান পার্টি।
এই উপমহাদেশে নির্বাচনী প্রতীক বাছাইয়ের ক্ষেত্রে জাতীয় ঐতিহ্য ও জীবনঘনিষ্ঠ জিনিসকেই বরাবর বেছে নিয়েছেন রাজনীতিবিদরা। অতিপরিচিত ও সহজে উচ্চারিত শব্দের দিকেই ঝোঁক বেশি। নিরক্ষর ভোটারও যাতে ব্যালট পেপার দেখেই চিনতে পারে। এটাই রাজনৈতিক দলের লক্ষ্য থাকে। কিন্তু, শুধু মার্কাই সব নয়। দলের বৈশিষ্ট্য ও নেতার চরিত্র দেখেও প্রতীক জনপ্রিয় হয়। ‘ধানের শীষ’-এর পরিবর্তে ‘গমের শীষ’ বা ‘নৌকা’র বদলে ‘জাহাজ’ জনপ্রিয় হয়নি। মার্কা নিয়ে অতীতেও কামড়াকামড়ি কম হয়নি। কিন্তু, জনগণ পাশে না থাকলে দম বা দাম কোনোটাই পাওয়া যায় না। দল নিবন্ধন হওয়ার আগেই শাপলা প্রতীক ব্যবহার করছে এনসিপি। এ নিয়ে বৈষম্যের আশঙ্কা করছে ফ্যাসিস্টের হাতে নির্যাতিত নাগরিক ঐক্য। কেননা, তারা শাপলা চেয়ে আগে আবেদন করেছে। শাপলা না পেলে অন্যদের ঐতিহ্যবাহী প্রতীকও থাকা উচিত নয় বলাটা অনুচিত। এ যেন দাদার মুখে দাড়ি দেখে শিশু নাতির আড়ি। অভ্যুত্থানের এক বছরের মাথায় অংশগ্রহণকারীদের মাঝে বিভেদ দেখে ভবিষ্যৎ নিয়ে ভীতসন্ত্রস্ত সাধারণ মানুষ। তবু, তারা এখনো আশা করে নিরপেক্ষ, সুষ্ঠু জাতীয় নির্বাচনের। আর সেজন্য ছোটখাটো স্বার্থ ত্যাগ করতে পারবে জীবনবাজি রাখা বিপ্লবীরা।
লেখক: হেড অব নিউজ, আরটিভি
মন্তব্য করুন