মো. তানজিল হোসেন
প্রকাশ : ১৫ জুলাই ২০২৫, ১২:০০ এএম
আপডেট : ১৫ জুলাই ২০২৫, ০৭:৫৬ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
চারদিক

বর্বরতা ও নৈরাজ্য

ছবি : সংগৃহীত
ছবি : সংগৃহীত

পুরান ঢাকার স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের গেট নম্বর ৩-এর কাছে স্ক্র্যাপ ব্যবসায়ী লাল চাঁদ ওরফে সোহাগকে প্রকাশ্যে কুপিয়ে, পিটিয়ে এবং পাথর ছুড়ে হত্যার ঘটনায় আমরা স্তম্ভিত, শোকাহত ও ক্ষুব্ধ। এটা শুধু একটি খুন নয়, বরং আমাদের সমাজের মানবিকতা, আইন ও শৃঙ্খলার চরম অবক্ষয়ের প্রতীক।

বাংলাদেশের সংবিধানের ৩১ অনুচ্ছেদ বলছে, “প্রত্যেক নাগরিকের জীবনের সুরক্ষা, স্বাধীনতা ও সম্পদের সুরক্ষা আইনের দ্বারা নিশ্চিত করা হবে।” সংবিধানের ৩২ অনুচ্ছেদ আরও স্পষ্ট করে জানায়, “কোনো ব্যক্তিকে আইনের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত প্রক্রিয়া ব্যতীত জীবনের বা ব্যক্তিগত স্বাধীনতার হরণ করা যাবে না।” অর্থাৎ, বিচারবহির্ভূত হত্যা সংবিধান পরিপন্থি—এর কোনো রাজনৈতিক পরিচয়, পেশাগত পরিচয় বা সামাজিক পরিচয় থাকতে পারে না। খুনির একটাই পরিচয়—সে খুনি।

বাংলাদেশ দণ্ডবিধি ১৮৬০ এর ধারা ৩০২ অনুসারে, হত্যাকাণ্ডের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং অর্থদণ্ড হতে পারে। অথচ আমরা দেখতে পাই, রাজনৈতিক প্রভাব, দুর্বল তদন্ত এবং দীর্ঘসূত্রতার কারণে বহু হত্যাকাণ্ড বিচারহীন থেকে যায়। গণপিটুনি, প্রকাশ্য খুন এবং বিচারবহির্ভূত সহিংসতার সংস্কৃতি যদি দমন না করা যায়, তাহলে আমরা যে রাষ্ট্রে বসবাস করছি, তা আইনশৃঙ্খলার রাষ্ট্র নয়, বরং জনতার রোষ এবং ক্ষমতার দাপটের ওপর দাঁড়ানো এক নৈরাজ্যের রাষ্ট্র।

মানবাধিকার ও নাগরিক স্বাধীনতা রক্ষা করা প্রতিটি রাষ্ট্রের মৌলিক দায়িত্ব। বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক মানবাধিকার ঘোষণাপত্র ১৯৪৮ এর স্বাক্ষরকারী, যেখানে বলা হয়েছে, “প্রত্যেক ব্যক্তির জীবনের অধিকার, স্বাধীনতা এবং ব্যক্তিগত নিরাপত্তার অধিকার রয়েছে” (Article 3)। এ ধরনের নৃশংস হত্যাকাণ্ড সেই অঙ্গীকারেরও চরম লঙ্ঘন।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এমন বর্বরতার শাস্তি কঠোরভাবে কার্যকর করা হয়। উদাহরণস্বরূপ, যুক্তরাষ্ট্রের বেশিরভাগ অঙ্গরাজ্যে ইচ্ছাকৃত হত্যার জন্য মৃত্যুদণ্ড বা আজীবন কারাদণ্ড হয়; সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ায় হত্যাকাণ্ডের জন্য স্বয়ংক্রিয় মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়; যুক্তরাজ্যে যদিও মৃত্যুদণ্ড নেই, সেখানে আজীবন কারাদণ্ড হয় এবং কয়েক দশক ধরে পর্যবেক্ষণ থাকে। কেন এমন ঘটনায় বিচার প্রক্রিয়া ধীর, কেন রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত হতে পারে না, তা নিয়ে প্রশ্ন তোলা জরুরি।

এ ঘটনার সামাজিক প্রেক্ষাপটও গুরুত্বপূর্ণ। লাল চাঁদ সোহাগ ছিলেন একটি স্ক্র্যাপ ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের নেতা, যার সঙ্গে স্থানীয় প্রতিদ্বন্দ্বীদের সংঘাত ছিল। এখান থেকে বোঝা যায়, ক্ষুদ্র ব্যবসা পর্যায়ে রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা, চাঁদাবাজি এবং আধিপত্য বিস্তারের যে সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে, তা শুধু অর্থনৈতিক ক্ষতি নয়, প্রাণঘাতী সহিংসতায় পরিণত হচ্ছে। এর দায় প্রশাসন, রাজনীতি, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং আমাদের সবার।

আমরা যদি এ হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে সোচ্চার না হই, তাহলে আমরা নিজেরাই সামাজিক নিরাপত্তার ভিত কাঁপিয়ে তুলব।

কিছু দাবি উত্থাপন করতে হবে:

১. সব আসামিকে গ্রেপ্তার করতে হবে এবং দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে বিচার কার্যক্রম চালাতে হবে। দীর্ঘসূত্রতা ন্যায়বিচারকে হত্যা করে; ২. রাজনৈতিক পরিচয় ও পৃষ্ঠপোষকতা যাচাই করে সব ধরনের প্রভাবমুক্ত তদন্ত নিশ্চিত করতে হবে; ৩. আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিষ্ক্রিয়তা ও দায়িত্বহীনতার জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে; ৪. গণমাধ্যম, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং নাগরিক সমাজকে একসঙ্গে গিয়ে সহিংসতা প্রতিরোধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে; ৫. মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধা এবং আইনশৃঙ্খলার প্রতি আস্থা পুনর্গঠনের জন্য রাষ্ট্রকে দৃঢ় অবস্থান নিতে হবে।

আজ আমরা যদি চুপ থাকি, কাল আমাদের, আমাদের সন্তানদের, আমাদের ছাত্রদের—কারও জীবন নিরাপদ থাকবে না। সমাজে শান্তি আনতে হলে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা ছাড়া কোনো পথ নেই। আসুন, সবাই মিলে বলি—কোনো খুনির রাজনৈতিক পরিচয় নেই, খুনির পরিচয় একটাই, সে খুনি। তার বিচার হোক, তার শাস্তি হোক, মানবিক রাষ্ট্রের উপযুক্ত পথে।

মো. তানজিল হোসেন

সহযোগী অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

সিরিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা কমাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র   

আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া ৪২ জনকে স্ট্যান্ড রিলিজ

 ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ‘তুই’ বলায় তুমুল সংঘর্ষ, শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা বর্জন

আগামী ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের বিকল্প নেই : গণতন্ত্র মঞ্চ 

চার দেশে বন্যায় ১৫০০ মৃত্যুর পর নতুন আতঙ্ক

সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকদের ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ স্থগিত

শাহজালালে ‘এয়ারপোর্ট মিনি ফায়ার এক্সারসাইজ-২০২৫’ সম্পন্ন

বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম

ইউএনও হলেন লাক্স সুন্দরী সোহানিয়া

তারেক রহমানের ৩১ দফায় বদলে যাবে শরীয়তপুর : নুরুদ্দিন আহাম্মেদ অপু

১০

এরশাদ-হাসিনা কারও সঙ্গেই আপস করেননি খালেদা জিয়া : মিল্লাত

১১

মান্নাকে ইসলামী ব্যাংকের চূড়ান্ত নোটিশ, আইনি ব্যবস্থার হুঁশিয়ারি

১২

সব দল ইসলামের পতাকাতলে সমবেত হবে ইনশাআল্লাহ : অধ্যাপক মুজিবুর

১৩

মনোনয়নের খবর শুনে উচ্ছ্বাস, কিছুক্ষণ পর বিএনপি নেতার মৃত্যু

১৪

জুলাই গণঅভ্যুত্থানে হত্যা / সাবেক বিচারপতি-হুইপসহ ১৫৬ জনের বিরুদ্ধে আদালতে চার্জশিট

১৫

ইসলামের বিষয়ে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে : ধর্ম উপদেষ্টা

১৬

ববি উপাচার্য দপ্তরে ‘মুলা’ ঝুলিয়ে প্রতীকী প্রতিবাদ

১৭

ধেয়ে আসছে তীব্র শীত, দফায় দফায় শৈত্যপ্রবাহ

১৮

‘বাকসু’ নিজেদের রাখতে বিএম কলেজ শিক্ষার্থীদের হুঁশিয়ারি

১৯

নিবন্ধন পেতে যাচ্ছে ২ রাজনৈতিক দল

২০
X