বেশ কিছুদিন আগে শিল্পী লায়লার গাওয়া একটি প্রচলিত লোকসংগীত বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। গানের শুরুতে রয়েছে ‘আখ ক্ষেতে ছাগল বন্দি, জলে বন্দি মাছ, নারীর কাছে পুরুষ বন্দি ঘোরায় বারো মাস, সখী গো আমার মন ভালা না, কালার সাথে পিরীত কইরা সুখ পাইলাম না, সখী গো—’ । অনেকে মনে করেন, এটি ভাটি অঞ্চলের একটি আদি গানেরই পরিবর্তিত রূপ। পরবর্তী সময়ে কুদ্দুস বয়াতি দাবি করেন গানটি তার সংগ্রহ ও তার কণ্ঠে প্রথম গাওয়া। যেখানে বলা হয়, ‘আক্কেলে ছাগল বন্দি জালে বন্দি মাছ, নারীর হাতে পুরুষ বন্দি ঘুরে বারো মাস, সখী গো আমার মন ভালা না।’ ২০২৫ সালে রাজনৈতিক স্মৃতিবিজড়িত জুলাই মাসে এসে আরবি নতুন বছরের তথা নতুন মহররম মাসের নতুন চাঁদ দর্শনে নবউদ্যমে জেগে ওঠা চাঁদাবাজদের উত্তাল ও উদ্দাম নৃত্য দেখে মনে হয়, এ সময়ে ভাটি অঞ্চলের প্রবাদপুরুষরা বেঁচে থাকলে তাদেরও হয়তো আক্কেল গুড়ুম হতো। তারা হয়তো গাইতেন ‘চাঁদার মাঝে সমাজ বন্দি, নিত্যনতুন সাজ, চাঁদাবাজরা চালায় সমাজ গোটা বারো মাস, সখী গো,— ব্যবসায়ীদের মন ভালা না, জুলাই মাসে রক্ত দিয়াও সুখ পাইলাম না, সখী গো—।’
ছাত্রজীবনে অ্যাইম ইন লাইফ বা ভবিষ্যতে কী হতে চাও বিষয়ে রচনা লেখার সময় প্রায় সবাই ডাক্তার কিংবা ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার কথা লিখতাম। কেউ কখনো ড্রোন ডিজাইনার, ড্রোন অপারেটর, কনটেন্ট ক্রিয়েটর, সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার, ওয়েব পেজ ডেভেলপার কিংবা ডাটা অ্যাডমিনিস্ট্রেটর হওয়ার কথা লিখতাম না। বস্তুত তখন এমন পেশার কথা আমরা চিন্তাও করতাম না। তবে আজ এমন পেশাই বাস্তবতা। ভবিষ্যতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বন্যায় প্রচলিত অনেক পেশাই ভেসে যাবে বা তলিয়ে যাবে। আর নিত্যনতুন এমন সব পেশা আসবে, যার কথা হয়তো আমাদের ছাত্রছাত্রীরা দূরে থাক তাদের ভবিষ্যৎ সিলেবাস প্রণেতাদের ভাবনাতেও নেই। তবে কারও ভাবনায় থাকুক আর না থাকুক একটা পেশা ছিল আছে এবং থাকবে, তা হলো—চাঁদাবাজি।
দুই অক্ষরের ছোট্ট নাম চাঁদা। নামে ছোট হলেও ক্ষমতায় অনেক শক্তিশালী এই চাঁদা। জল, স্থল ও আকাশ পথে এই চাঁদার জয়জয়কার। এমনকি মাটির নিচে টানের কিংবা আন্ডারগ্রাউন্ড মেট্রোলাইন নির্মাণ করতেও চাঁদা দিতে হয়। সবাই জানে, পৃথিবীতে সবচেয়ে লম্বা আইনের হাত। এ নিয়ে যাত্রা, নাটক ও সিনেমায় বহু সংলাপ আছে। তবে ভুক্তভোগীরাই কেবল জানেন চাঁদাবাজদের হাত আইনের হাতের চেয়েও অনেক বেশি লম্বা। এত লম্বা যে, চাঁদাবাজরা চাঁদও স্পর্শ করতে পারে। এমন একটা গল্প আছে চাঁদাবাজ ও চাঁদকে নিয়ে। তিন চাঁদাবাজের মধ্যে নিজেদের ক্ষমতার নিয়ে বড়াই হচ্ছিল। প্রথমজন বললেন, আমেরিকার প্রেসিডেন্টও তাকে চাঁদা দিয়ে হোয়াইট হাউসে রোজ প্রবেশ করেন। দ্বিতীয় চাঁদাবাজ বললেন, ১৯৬৯ সালে অ্যাপেলো ১১ নভোযান থেকে চাঁদে নামার আগে নিল আর্মস্ট্রং ও অলড্রিনও তাকে চাঁদা দিয়ে এবং তার পায়ে কদমবুচি করে চাঁদে পা ফেলেছিলেন। এসব দেখে মিটমিটিয়ে হাসছিলেন তৃতীয় ব্যক্তি। তিনি বললেন, জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকির লোকজন চাঁদা দেননি বলে তার দাদা অ্যাটম বোমা ফেলেছিলেন সেই শহর দুটির ওপর। এমন চাঁদাবাজ দাদার বংশধর সে। বাকিটা কাজের মধ্য দিয়েই পরিচয় হবে।
বাংলাদেশ বিশেষত ঢাকার চাঁদাবাজরা এমন গালগল্পে বিশ্বাস করে না। তাদের রয়েছে ডাইরেক্ট অ্যাকশন নেওয়ার মতো একেকটি ব্র্যান্ড নেম এবং অদ্ভুত সব নাম। অতি সম্প্রতি খালেদা জিয়ার নকল কণ্ঠ টেলিফোনে শুনেই এক ব্যবসায়ীর ব্যাংকের মাধ্যমে ২৬ কোটি টাকা চাঁদা প্রদানের খবর প্রকাশিত হয়েছে। তবে চাঁদাবাজ কী ব্র্যান্ড বা নাম ব্যবহার করে এহেন কর্মসাধন করেছিলেন, তা অবশ্য খবরে আসেনি।
খবরে চাঁদাবাজদের বেশ কিছু বিশেষায়িত নাম প্রায়ই পাওয়া যায়। দেহের গঠন নিয়ে এমন কিছু নামের উদাহরণ হলো—লম্বা লতিফ, নাটা নান্টু, বাট্টু বাদল, হাত কাটা হাতেম, ট্যারা তারেক, কালা কাশেম, ল্যাংড়া লিয়াকত ইত্যাদি। পণ্যের সঙ্গে অনেক সময় চাঁদাবাজদের ব্র্যান্ডিং হয়। যেমন মুরগি মিলন, ঝুট ঝন্টু, বালু বাদল, ডিশ দেওয়ান, ময়লা মাসুম, সোনা শফিক, তেনা তারেক ইত্যাদি। কখনো আবার নামের পাশে একটি এলাকার নামও শোভা পায় যেমন সুইডেন আসলাম, বরিশাইল্লা বাবর, কুট্টি কাদের, গোপালি বেনজির, ফেনী হাজারী ইত্যাদি। কর্ম বা বংশগুণেও চাঁদাবাজ হয়। যেমন মোল্লা মাসুদ, রিকশা রফিক, ইয়াবা ইয়াকূব, দালাল দুলাল, বস্তা বশির, আলু আলমগীর, পিএস পলাশ, ব্রিফকেস বারেক ইত্যাদি।
চাপাবাজদের কাজের ফিরিস্তি বলে শেষ করার মতো নয়। নিয়মিত মাসোহারার বিনিময়ে নির্মাণকাজের জন্য নির্ধারিত এলাকার নিরাপত্তা, উচ্চমূল্যে পণ্য সরবরাহ, নিজেদের লোককে চাকরি দিতে বাধ্য করা, বড় নেতাদের সংবর্ধনা, তাদের জন্য হোন্ডা, গুন্ডা, ব্যানার, বাস ও পিকআপ নিয়ে শোভাযাত্রা, টেন্ডার ঠেকানো, জমি দখল ও পুনরুদ্ধার, পোস্টার লাগানো, সর্বোপরি ভোটের সময় ভজঘট—এমন সব কাজের কাজি একজন চাঁদাবাজ। তাইতো তাদের কথায় এত ঝাঁজ। তাদের কথা না শুনলে মাথায় পড়ে বাজ। পটপরিবর্তনে পাল্টে যায় তাদের সাজ। এক্ষেত্রে চাঁদাবাজদের নেই কোনো লাজ। বিচরণ করে তারা কাপড়ে না ফেলে ভাঁজ। বালুমহাল, ট্রাক স্ট্যান্ড, বাস স্ট্যান্ড, টেম্পো স্ট্যান্ড, বড় বড় আড়ত, পাইকারি বাজার চাঁদাবাজদের প্রিয় বিচরণক্ষেত্র। চাঁদাবাজদের বদৌলতে বিভিন্ন জেলা নানাভাবে ব্র্যান্ডিং হয়ে থাকে। যেমন চাঁদপুরের বালু, সিলেটের পাথর, পার্বত্য জেলার কাঠ, কক্সবাজারের ইয়াবা, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ফেনসিডিল, খুলনার গোলপাতা, সাভার, নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুরের ঝুট, পুরান ঢাকার ভাঙাড়ি চাঁদাবাজদের নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত হয়।
অনেকটা স্থায়ী ঠিকানার মতো চাঁদাবাজদের দল একটাই। আর সেটি হলো সরকারি দল। তবে নতুন দল বা শক্তি সরকার গঠন করলে তারা তো আর বেইমানি করতে পারে না। তাই সরকারি দলেই থেকে যায়। দল আসে, দল যায়। চাঁদাবাজদের সরকারি দলেই দেখা যায়। এক্ষেত্রে কে সরকার গঠন করল, সেটা কোনো বিবেচ্য বিষয় নয়। চাঁদাবাজরা সদা সর্বত্র সরকারি দলেই রয়। তারা সব সরকারে ছিল, আছে এবং থাকবে। হঠাৎ যদি কোনো অরাজনৈতিক শক্তি সরকার গঠন করে তখন কী হবে? এর-ও সমাধান বের করেছে চাঁদাবাজরা। তখন ভবিষ্যতে যারা আসবে বলে মনে হয়, তাদের নামেই চলবে চাঁদাবাজি। দল যার যার, চাঁদাবাজ সরকারের। ধরা পড়লে সর্বোচ্চ বহিষ্কার। ততদিনে নিজেকে কানাডা কিংবা দুবাইয়ে আবিষ্কার। হিসাবটা খুব পরিষ্কার।
চাঁদার সঙ্গে বাঙালির সখ্য জন্মের পর থেকেই। ছোটবেলা আকিকা কিংবা খাতনার নামে মা-বাবাই শুরু করে প্রথম চাঁদাবাজি। ভিনদেশি সংস্কৃতি অনুসরণে ইদানীং আবার বেবি শাওয়ার কিংবা সাত মাস গর্ভে থাকা শিশুর জন্যও চাঁদাবাজি হয়। এই শিশুরা একটু বড় হলেই চড়ুইভাতি করার জন্য চাঁদা তুলে। ঈদে চাঁদে সেলামি পাওয়ার নামেও চলে চাঁদাবাজি। আর বিয়ে-শাদিতে গেট কিংবা বাসর ঘরের দরজা পেরোতে চাঁদাবাজি বাঙালি সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে আছে। স্কুল ও কলেজ কর্তৃপক্ষ যত নামে চাঁদা তুলে, তার ফিরিস্তিও বেশ বড়। আজ পিকনিক তো কাল স্পোর্টস, পরশু উন্নয়ন এরপর ভিআইপি পরিদর্শন। চাঁদা লেগে আছে গোটা সন (বছর)। কে করবে তার প্রতিকার? জেলা প্রশাসক? এল আর (লোকালি রেইজড) ফান্ডের নামে সেখানে চলে অনেক বড় কারবার!
চাঁদার ক্ষেত্রে চোখ বন্ধ করে চলাই প্রশাসনের ধর্ম। সরকারি অনুষ্ঠানে আসে সামান্য অনুদান। মন্ত্রীরা চায় বড় আয়োজন। অনেক লোক—অনেক আপ্যায়ন। অনুষ্ঠান বা পরিদর্শন শেষে চৌদ্দগোষ্ঠীর জন্য উপঢৌকন। কিন্তু কে দেবে অর্থের জোগান? উত্তর একটাই—চাঁদা তোলার করো আয়োজন।
চাঁদার বিরুদ্ধে হয়েছিল বেশ কিছু নাটক। মইন ইউ নাকি ছিলেন ব্যবসায়ীদের থেকে চাঁদা নেওয়ার ঘটক। এ নিয়ে সংসদেও কথা হয় ব্যাপক। এরপর ছিল না আর কোনো চমক। শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির সাক্ষী ছিল একদল ব্যবসায়ী। কিছুই হলো না স্থায়ী। সবকিছু হারিয়ে গেল, কেউ হলো না দায়ী। সবার ওপরে চাঁদা সত্য, চাঁদাই চিরস্থায়ী।
যতই তুমি দাও ধিক, চাঁদাবাজি চলবেই ঠিক। চূর্ণ-বিচূর্ণ হোক চৌদিক। চাঁদাবাজদের কিছুই হবে না, হাসবে তারা খিক খিক। চাঁদাবাজরা বলছে আমায় কলম তোর থামা। সানডে মানডে ক্লোজ হোক, এটা কি চাও মামা?
লেখক: অবসরপ্রাপ্ত মেজর, গবেষক, বিশ্লেষক ও কলামিস্ট
ইমেইল: [email protected]
মন্তব্য করুন