জুলাই অভ্যুত্থানের আগে ১৫ বছরে ছাত্রলীগসহ আওয়ামী লীগের অন্যান্য সংগঠনের সন্ত্রাসীদের হামলা ও তৎকালীন সরকারের নির্দেশে রাষ্ট্রীয় বাহিনীর হাতে নিহতদের তালিকা প্রস্তুতের নির্দেশ দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তালিকা, এরপরই না বিচার। কিন্তু চব্বিশের ফোনালাপে প্রমাণিত অপরাধ থেকে কি রক্ষা মিলবে? শেখ হাসিনা বা তার দলের কেউ এখন পর্যন্ত হত্যাযজ্ঞ বা তাদের অন্য কোনো অপরাধের জন্য অনুশোচনা করেননি। কোনো দুঃখ, আফসোস বা ভুল স্বীকারের বালাই নেই। বরং, যা করেছেন ঠিকই করেছেন। ভবিষ্যতে সুযোগ পেলে আরও করার অভিপ্রায়। দোর্দণ্ড ক্ষমতাকালে ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে আলজাজিরার শিরোনাম ছিল ‘অল দ্য প্রাইম মিনিস্টার্স মেন’। পঁচিশে এসে ‘হাসিনা-জুলাইর ৩৬ দিন’।
কাতারভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম আলজাজিরায় প্রচারিত ‘অল দ্য প্রাইম মিনিস্টার্স মেন’ নামের অনুসন্ধানী প্রতিবেদন নিয়ে তুমুল বিতর্ক চলেছে ওই সময়। তখনকার সরকার আলজাজিরার প্রতিবেদনটি মিথ্যা-বানোয়াট, কল্পকাহিনি বলে উড়িয়ে দিয়েছে। হাইকোর্ট থেকে টেলিকম কর্তৃপক্ষকে আলজাজিরার প্রতিবেদন ইন্টারনেট থেকে সরিয়ে ফেলার আদেশও দেওয়া হয়েছিল। আলজাজিরার ওই প্রতিবেদনটিতে ছিল শেখ হাসিনা এবং তার ঘনিষ্ঠজনদের ঘিরে বিভিন্ন অভিযোগ ও অনিয়মের চিত্র। ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়, সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদ এবং অন্য প্রভাবশালী ব্যক্তির কার্যকলাপও বাদ যায়নি। এবারের প্রেক্ষিত ভিন্ন। সময়-বিষয়বস্তুও ভিন্ন।
এবার এখন পর্যন্ত বলা হয়নি, এটি একটি ডকুড্রামা। এসব বলার লোকও এখন মাঠে নেই। কেউ পলাতক, ফেরারি। কেউ জেলে। কেউবা নিরুদ্দেশ-দেশান্তরী। আলজাজিরার এবারের প্রতিবেদনে নিশ্চিত করেছে, চব্বিশের জুলাই আন্দোলন দমনে ছাত্রলীগকে পরিচালনা করেছেন শেখ হাসিনা নিজেই। হেলিকপ্টার থেকে মারণাস্ত্র ব্যবহারের নির্দেশ দেওয়ার কথা তিনি ফজলে নূর তাপসকে বলেছেন। তাপস কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য তাকে অনুরোধ করার সময়েই তিনি বলেন, নির্দেশ আগেই দেওয়া হয়ে গেছে। তিনি তার এসএসএফের কর্মকর্তাকেও ব্যক্তিগতভাবে নির্দেশ দিয়ে বিজিবির একটি দলে যুক্ত করে দিয়েছিলেন। সেনাবাহিনীর সামগ্রিক চেইন অব কমান্ডের কারণে যা প্রায় অসম্ভব একটা কাজ। কিন্তু তিনি সবকটি বাহিনীকেই তার ব্যক্তিগত বাহিনী হিসেবে ব্যবহারের ক্ষমতা অর্জন করেছিলেন বলেই এমনটি ঘটেছে।
ঢাকা উত্তরের মেয়র আতিকের মাধ্যমে লন্ডনের মেয়র সাদেক খানকেও তিনি তার ভাষ্য প্রচারের কাজে লাগাতে চেয়েছিলেন। বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূতদের কাছে তিনি তার সরকারের বয়ান পৌঁছে দিয়েছিলেন, যাতে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের যৌক্তিকতা কেউ গ্রহণ না করে। সালমান রহমান শহীদ আবু সাঈদের মৃত্যু সম্পর্কে মিথ্যা ব্যাখ্যা প্রস্তুতের দায়িত্ব নিয়েছিলেন। তিনি জানতেন তার ফোন রেকর্ড করা হয় এবং সে জন্য তিনি অনেক ফোন ব্যবহার করতেন। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের কাছে এ-সংক্রান্ত তথ্য-সাবুদ দেওয়া হয়েছে। এর পরও শেখ হাসিনার অন্ধ অনুসারীরা তাকে সবসময় দায়মুক্তি দিয়ে যাবে। বলবে এগুলো ভুয়া-বানোয়াট। শেখ হাসিনার আমলই ভালো ছিল—এমন ন্যারেটিভ তৈরিতে তো তারা সচেষ্টই।
আলজাজিরার অনুসন্ধানী ইউনিটের উদ্ধার করা ফোনালাপে আন্দোলন চলাকালে শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ মহলের কথোপকথন, সিদ্ধান্ত ও দমননীতির বিস্তারিত তথ্য উঠে এসেছে। প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে, টানা তিন সপ্তাহের সেই আন্দোলনে কমপক্ষে ১ হাজার ৫০০ জন নিহত এবং ২৫ হাজারের বেশি আহত হন। চব্বিশের ১৮ জুলাইয়ের একটি অডিও রেকর্ডিংয়ে শেখ হাসিনা ঢাকা দক্ষিণের সাবেক মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপসকে বলতে শোনা যায়, ‘আমার নির্দেশ তো আগেই দেওয়া হয়ে গেছে। আমি পুরোপুরি ওপেন অর্ডার দিয়ে দিয়েছি। এখন ওরা মারবে, যেখানে পাবে সেখানে গুলি করবে। আমি তো এতদিন থামিয়ে রেখেছিলাম। আমি ছাত্রদের নিরাপত্তা নিয়ে ভাবছিলাম।’ তার নিজের গোয়েন্দা সংস্থার রেকর্ড করা আরেকটি কলে তাকে বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে হেলিকপ্টার ব্যবহার করার বিষয়টি স্পষ্ট করে বলতে শোনা গেছে। তিনি বলেন, ‘যেখানে তারা কোনো জটলা দেখছে, সেটা ওপর থেকে—এখন তো ওপর থেকেই হচ্ছে।’ মানবতাবিরোধী অপরাধ বিচারের উদ্দেশ্যে গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রধান কৌঁসুলি মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম জানান, এ অভিযানের কোড নাম ছিল ‘অপারেশন ক্লিন ডাউন’।
অভিযানে ড্রোন ব্যবহার করা হয়েছিল। যখন অনেক বিক্ষোভকারী একসঙ্গে জড়ো হতো, তখন তারা তাদের হত্যা করার জন্য সেখানে হেলিকপ্টার পাঠানো হতো। আন্দোলনের প্রতীক হয়ে ওঠা ছাত্র আবু সাঈদের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হয়ে উঠলে গোটা বিষয়টি ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা চলে। আবু সাঈদের পরিবারকে হুমকি দিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে টেলিভিশনে সাক্ষাৎ করানো হয়। আবু সাঈদের ময়নাতদন্ত রিপোর্ট সংগ্রহে তৎপর ছিলেন শেখ হাসিনার উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান। আরেকটি অডিও রেকর্ডিংয়ে তাকে পোস্টমর্টেম করা হয়েছে কি না, তা বলতে শোনা যায়। এরপর তিনি জানতে চান, ‘রংপুর মেডিকেল কলেজের কেন আমাদের পোস্টমর্টেম রিপোর্ট দিতে সময় লাগছে। লুকোচুরি কে খেলছে—রংপুর মেডিকেল?’ রংপুর মেডিকেল কলেজের চিকিৎসক রাজিবুল ইসলাম বলেছেন, ‘আবু সাঈদের পোস্টমর্টেম রিপোর্ট আমাকে পাঁচবার লিখতে হয়েছে। আমি প্রতিবার রিপোর্ট লিখি, যখন জমা দিতে যাই পুলিশের মনমতো হয় না। আমার মনে হয়েছে, সরকারের সর্বোচ্চ মহল থেকেই আবু সাঈদের রিপোর্টকে ট্যাম্পারিং করার সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হয়েছে।’ সরকারের পক্ষ থেকে ইন্টারনেট বন্ধের উদ্যোগের কথাও এসেছে প্রতিবেদনটিতে। নির্দেশ জারি হয়েছিল, যেন সহিংসতার রক্তাক্ত চিত্র আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে না পৌঁছায়। এর প্রমাণ মিলেছে ফাঁস হওয়া গোপন সরকারি নথিতে। যেখানে শেখ হাসিনা প্রতিবাদরত শিক্ষার্থীদের ওপর ‘মারাত্মক অস্ত্র ব্যবহার’ করতেই নির্দেশ দেননি; জারি করেছিলেন ‘একটি খোলা আদেশ’—‘যেখানেই পাওয়া যাবে সেখানেই গুলি করার’।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল অনুসারে, কয়েক সপ্তাহ ধরে রক্তাক্ত বিক্ষোভ এবং সরকারি বাহিনীর নৃশংস অভিযানে প্রায় ১ হাজার ৪০০ জন নিহত এবং ২০ হাজারেরও বেশি আহত হওয়ার পর সাড়ে ১৫ বছর ধরে বাংলাদেশ শাসনকারী হাসিনা ২০২৪-এর ৫ আগস্ট পদত্যাগ করেন এবং ভারতে পালিয়ে যান। আলজাজিরার প্রচারিত অডিওতে এআই কারসাজি হয়েছে কি না, যাচাইয়ের জন্য ফরেনসিক বিশেষজ্ঞদের মাধ্যমে রেকর্ডিংগুলো বিশ্লেষণ করা হয়েছে এবং ভয়েস ম্যাচিংয়ের মাধ্যমে কল করা ব্যক্তিদেরও শনাক্ত করা হয়েছে। শেখ হাসিনা এবং আরও দুই কর্মকর্তাকে ১০ জুলাই অভিযুক্ত করা হয়েছিল এবং আগস্টে বিচার শুরু হওয়ার কথা রয়েছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রধান প্রসিকিউটর তাজুল ইসলামের মতে, শেখ হাসিনাও জানতেন যে, তার বক্তব্য রেকর্ড করা হচ্ছে। কিছু ক্ষেত্রে অন্য পক্ষ বলেছেন... ‘টেলিফোনে এ বিষয়ে আলোচনা করা উচিত নয়।’ কিন্তু শেখ হাসিনার কাছ থেকে উত্তর ছিল, ‘হ্যাঁ, আমি জানি, আমি জানি, আমি জানি, আমি জানি, এটি রেকর্ড করা হচ্ছে, কোনো সমস্যা নেই।’
এ ধরনের কথায় শেখ হাসিনা অন্যদের জন্য অনেক গভীর খাদ খনন করেছেন। একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী প্রবীণ সৈনিকদের পরিবারের জন্য রাষ্ট্রীয় চাকরি সংরক্ষণের জন্য হাইকোর্ট একটি অজনপ্রিয় কোটা ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তনের পর ২০২৪ সালের জুনে ছাত্র বিক্ষোভ শান্তিপূর্ণভাবেই শুরু হয়। অনেক শিক্ষার্থী মনে করেন, এ ব্যবস্থা ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ দলের সমর্থকদের পক্ষে, যারা স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিল। সিভিল সার্ভিসে অনেক চাকরি যোগ্যতার ভিত্তিতে দেওয়া হয়নি। ১৬ জুলাই রংপুরের উত্তরাঞ্চলীয় শহরে পুলিশ ছাত্র বিক্ষোভকারী আবু সাঈদকে গুলি করে হত্যা করে। জুলাইয়ের আন্দোলনের ক্ষেত্রে তার মৃত্যু একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড় ছিল, যা জাতীয়ভাবে প্রতিবাদের জন্ম দেয় এবং বিক্ষোভকে তীব্র করে তোলে। হাসিনার মিত্র এবং উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের একটি গোপন ফোন রেকর্ডিংয়ে, তাকে সাঈদের পোস্টমর্টেম রিপোর্ট নিয়ে তাগাদা দিতে শোনা যায়। সেখানেই সালমান রহমান পুলিশের তখনকার আইজি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন, রিপোর্টের কী অবস্থা?
সাঈদের মৃত্যুর ১২ দিন পর তার পরিবারকে ঢাকায় বিমানে পাঠানো হয় শেখ হাসিনার সঙ্গে একটি টেলিভিশন অনুষ্ঠানের জন্য। সেখানে জড়ো করা ৪০টি পরিবারই ছিল বিক্ষোভে দেখামাত্র গুলিতে নিহত হওয়া। আবু সাঈদের বাবা মকবুল হোসেন গণভবনের কথা উল্লেখ করে বলেছেন, ‘তারা আমাদের আসতে বাধ্য করেছিল; নইলে তারা হয়তো অন্যভাবে আমাদের নির্যাতন করত।’ সাঈদের বোন সুমি তাৎক্ষণিকই শেখ হাসিনাকে বলেছিলেন, ‘ভিডিওতে দেখানো হয়েছে যে, পুলিশ তাকে গুলি করেছে। এখানে তদন্ত করার কী আছে? এখানে আসাটা ভুল ছিল।’
দেখামাত্র গুলির নির্দেশনা চব্বিশেই প্রথম নয়। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে হাজার হাজার প্রগতিশীল (জাসদসহ) নেতাকর্মীকে হত্যা নিয়ে অনেক কথা রয়েছে। খুলনার এক জনসভায় বঙ্গবন্ধু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে নকশাল দেখামাত্র গুলির নির্দেশ দিয়েছিলেন। এর জবাবে ন্যাপ সভাপতি (আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি) মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী পল্টনে জনসভায় বলেছিলেন, ‘মুজিবর, নকশাল কি কারও কপালে লেখা থাকে?’ শেখ হাসিনার গোপন ফোনালাপের নিষ্ঠুর নির্দেশাবলিগুলোও এভাবে মিথ্যা হয়ে থাকতে পারে। বাকিটা ভবিষ্যৎ।
লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট
ডেপুটি হেড অব নিউজ, বাংলাভিশন
মন্তব্য করুন