কালবেলা প্রতিবেদক
প্রকাশ : ২৬ জুলাই ২০২৫, ১২:০০ এএম
আপডেট : ২৬ জুলাই ২০২৫, ০৮:১০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

হালদার দুঃখ

ড. বিভূতি ভূষণ মিত্র
হালদার দুঃখ

হালদা নদী বাংলাদেশের পূর্ব পাহাড়ি অঞ্চলে অবস্থিত। এটি খাগড়াছড়ি ও চট্টগ্রাম জেলায় পড়েছে। এর দৈর্ঘ্য ১০৬ কিলোমিটার ও প্রস্থ ১৩৪ মিটার। এ নদীটি দেখতে সর্পিলাকার। হালদা দক্ষিণ এশিয়ার একমাত্র প্রাকৃতিক প্রজনন ক্ষেত্র। এ নদীতে জোয়ার-ভাটা ঘটে। মিঠা পানির মাছেরা এই নদীতে ডিম ছাড়ে। হালদা পৃথিবীর একমাত্র জোয়ার-ভাটার নদী, যেখানে কার্প জাতীয় মাছ যেমন রুই, কাতলা, মৃগেল, কালবাউশ ডিম পাড়ে। সেই ডিম সংগ্রহ করা হয়। পৃথিবীর আর কোথাও এমন নদী নেই যেখান থেকে মাছের ডিম সংগ্রহ করা হয়। এটি একমাত্র প্রাকৃতিক প্রজনন ক্ষেত্র যেখানে রুই বা কার্প জাতীয় মাছ ডিম পাড়ে আর তা সংগ্রহ করে জেলেরা বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করেন।

চট্টগ্রামের একমাত্র সুপেয় পানির উৎসও এই হালদা নদী। এখান থেকে প্রতিদিন চট্টগ্রাম ওয়াসা ১৮ কোটি লিটার পানি সংগ্রহ করে, যা ৬০ থেকে ৭০ লাখ মানুষের জীবন বাঁচায়। অথচ এই নদীকে সইতে হচ্ছে কত অত্যাচার। এর বুকে এর আগে রাবার ড্যাম বসানো হয়েছে। নদীরপাড়ে গড়ে উঠেছে শিল্পকারখানা। সেখানকার বর্জ্য এসে পড়ছে নদীতে। হাঁস-মুরগির খামার করা হচ্ছে। এমনকি তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের বর্জ্যও পড়ছে এখানে। হালদা নদীতে শুধু অবৈধভাবে মাছই ধরা হয় না, কারেন্ট জাল ও বিষ ব্যবহার করেও ক্ষান্ত নন তারা; প্রতিনিয়ত ঘর-গৃহস্থালি, নদীসংলগ্ন অনেক কলকারখানার বর্জ্য এসে যোগ হয় এখানে। অবৈধ বালু উত্তোলন তো আছেই।

হালদা নদীতে এপ্রিল, মে ও জুন—এই তিন মাসে যে কোনো এক সময় মা মাছেরা ডিম ছাড়ে। হালদায় রুই, কাতলা, মৃগেল ইত্যাদি ভারতীয় অঞ্চলের কার্প জাতীয় মাছের প্রজনন ক্ষেত্র হওয়ায় হাজার হাজার জেলে এখান থেকে ডিম ও পোনা সংগ্রহ করেন। সেগুলো পরে তারা বিক্রি করেন। এই পোনা থেকে আমরা বড় বড় রুই, কাতলা, মৃগেল পেয়ে থাকি। অন্যভাবে বলতে গেলে হালদার কারণেই কোটি কোটি বাঙালির আমিষের চাহিদা পূরণ হচ্ছে। ধারণা করা হয়, হালদা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জাতীয় অর্থনীতিতে ১ হাজার ২০০ কোটি টাকারও বেশি প্রবৃদ্ধি অর্জনে ভূমিকা রাখছে। হালদা রিসার্চ অ্যান্ড ল্যাবরেটরির তথ্যমতে, ২০২৩ সালে হালদা নদী থেকে ১৮ হাজার কেজি কার্প জাতীয় মাছের ডিম সংগ্রহ করা হয়। হালদা থেকে ২০২০ সালে ডিম পাওয়া গিয়েছিল ২৫ হাজার ৫৩৬ কেজি। ২০২১ সালে ডিম পাওয়া যায় ৮ হাজার কেজি। ২০২২ সালে প্রায় ৬ হাজার কেজি। ২০২৩ সালে ৪৩৭ কেজি। হালদা রিভার রিসার্চ ল্যাবরেটরির তথ্যমতে, ২০১৮ সালে ডলফিন পাওয়া গেছে ১৬৭টি, ২০২০ সালে ১২৭টি। গাঙ্গেয় ডলফিন পৃথিবীর বিপন্ন প্রজাতির একটি। পৃথিবীতে এর সংখ্যা মাত্র ১ হাজার ১০০টি। এর মধ্যে হালদায় রয়েছে ১৭০টি।

২০২০ সালে এটিকে বঙ্গবন্ধু মৎস্য হেরিটেজ হিসেবে ঘোষণা করে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে সেখানকার মাছ ও জলজ প্রাণী শিকারে নিষেধাজ্ঞা জারি করে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়। শুধু তাই নয়, ২০১৯ সালে হাইকোর্ট হালদা নদী রক্ষায় একটি কমিটিও গঠন করেন। অবশ্য এসব করেও ঠেকানো যায়নি কারেন্ট জালের ব্যবহার। হালদাকে বাঁচানোর জন্য হাটহাজারীতে ১০০ মেগাওয়াট পাওয়ার প্লান্ট বন্ধ করা হয়। এশিয়ান পেপার মিল বন্ধ করা হয়। নদী রক্ষায় এর চারপাশে আটটি সিসি ক্যামেরা বসানো হলে বেশ কাজে দিলেও কিছু ক্যামেরা নষ্ট হয়ে যাওয়ার পর অবশ্য আগের মতোই মাছ নিধন চলছে। ক্যামেরাগুলো বসানো হয়েছিল ২০২১ সালে। নৌ-পুলিশ এ ক্যামেরা বসিয়েছিল। এগুলো দিয়ে নজরদারি করা যেত প্রায় ১০ কিলোমিটার। ক্যামেরায় কোনো কিছু নজরে এলেই স্পিডবোট দিয়ে পুলিশ অভিযান চালাত। এটি বেশ কাজে দিয়েছিল। এতে মাছ নিধন, বালু উত্তোলন এসব বন্ধ হয়ে যায়।

সম্প্রতি হালদায় আবারও শুরু হয়েছে অবৈধ বালু উত্তোলন। অবৈধভাবে ড্রেজার মেশিন ও পাওয়ার পাম্প বসিয়ে অবাধে সেখানে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। একটি পত্রিকার প্রতিবেদন অনুযায়ী, নারায়ণহাট ইউনিয়নের মাস্টারপাড়া, কুলালপাড়া, ভাঙ্গাপুল, হাঁপানিয়া, নাজিরহাট পৌরসভার নাসির মোহাম্মদ ঘাটের আশপাশ এলাকা, সুয়াবিল মালাকারপাড়া, সমিতির হাট ইউনিয়নের আরবানিয়া সওদাগর ব্রিজ এলাকায় অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। বালু উত্তোলন করে কোনো একটা জায়গায় তা স্তূপ করে রাখা হয়। পরে রাতের বেলায় ট্রাকে করে বিভিন্ন জায়গায় বিক্রি করা হয়। অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের ফলে হালদা নদীর স্বাভাবিক পরিবেশ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এর ফলে মা মাছের প্রজনন কেন্দ্র বিনষ্ট হচ্ছে। এর প্রভাব পড়বে স্থানীয় মৎস্যজীবীদের ওপর। তৌকীর আহমেদ ২০১৭ সালে হালদা নামের একটি সিনেমা পরিচালনা করেছিলেন। এখানে তিনি ক্যামেরাবন্দি করেছিলেন নদীর দূষণ আর হালদার সঙ্গে জড়িয়ে থাকা শত শত জেলের দুখী জীবনের দৃশ্য। এভাবে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন চলতে থাকলে জেলেদের মুখে কখনোই হাসি ফুটবে না। ফুরাবে না হালদা নদীর দুঃখ।

লেখক: শিক্ষক ও গবেষক

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

ডিএমপির সাবেক উপকমিশনার কাজী মনিরুজ্জামান বরখাস্ত

ইরানের মৃত পরমাণু বিজ্ঞানীরা হেঁটে বেড়াচ্ছেন : ইসরায়েল

আটাবে প্রশাসক নিয়োগের প্রতিবাদে সাধারণ সদস্যদের বিক্ষোভ

বগুড়ায় দুদকের গণশুনানি মঞ্চে জুতা নিক্ষেপ

এস এম সুলতান : তুলির রেখায় গ্রামীণ মহাকাব্যের রূপকার

জাল রায় তৈরি  / জামিন মেলেনি খায়রুল হকের 

পিআর পদ্ধতি চালুর দাবিতে আন্দোলনের ঘোষণা জামায়াতে ইসলামীর 

ফের ডলার কিনল বাংলাদেশ ব্যাংক

ইসির প্রাথমিক বাছাইয়ে ১৬ দল উত্তীর্ণ

৪০ হাজার টাকা বেতনে ভিভো-তে কাজের সুযোগ

১০

ঋতুপর্ণাদের পর এবার সাগরিকারাও খেলবে এশিয়ান কাপে

১১

সচিবালয় কর্মচারীদের পদের নাম পরিবর্তনে ৯ যৌক্তিকতা

১২

এনসিপি নেতার বাড়িতে কাফনের কাপড়, চিরকুটে ‘প্রস্তুত হ রাজাকার’ লিখে হুমকি

১৩

যেসব আমলে দ্রুত বিয়ে হয়

১৪

ভিসা হলেও যুক্তরাষ্ট্রে ঢুকতে যাদের ১৫ হাজার ডলার লাগবে

১৫

দৃষ্টিভঙ্গি সংস্কারের মাধ্যমে কল্যাণ রাষ্ট্র গঠন সম্ভব : সালাহউদ্দিন

১৬

হাসিনা-ইউনূস দ্বন্দ্বে আমি ‘বলির পাঁঠা’ হয়েছি : টিউলিপ

১৭

গাজীপুরে যেভাবে হানিট্র্যাপের শিকার হন যাত্রীরা

১৮

সিলেটে গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে একই পরিবারের ৫ জন দগ্ধ

১৯

পায়ের লিগামেন্ট ছিঁড়ে গেছে নিশোর, শুটিং বন্ধ 

২০
X