ফিলিস্তিন এখন আর শুধু একটি ভৌগোলিক সীমানার নাম নয়। এটি হয়ে উঠেছে বৈশ্বিক মানবতার আয়না, যেখানে প্রতিটি রাষ্ট্র ও জনগণের নৈতিক অবস্থান প্রতিফলিত হচ্ছে। গত কয়েক দশক ধরে ফিলিস্তিনি জনগণ তাদের স্বাধিকার, স্বাধীনতা ও রাষ্ট্রীয় পরিচয়ের জন্য সংগ্রাম করে যাচ্ছে। তারা চায় একটি স্বাধীন রাষ্ট্র, যেখানে তারা নিরাপদে বসবাস করতে পারবে—যেখানে শিশুরা স্কুলে যেতে পারবে, যেখানে বৃদ্ধরা ভোরের আজানে ঘুম ভাঙার পর নিশ্চিন্তে হাঁটতে পারবে। এই চাওয়ার মধ্যে কোনো সন্ত্রাস নেই, বরং রয়েছে ন্যায্যতার আকুতি। আর সেই চাওয়াকে আজ বিশ্বের বহু রাষ্ট্র সম্মান জানাচ্ছে।
২০২৫ সালের আগস্ট পর্যন্ত জাতিসংঘ ও অন্যান্য কূটনৈতিক সূত্র অনুযায়ী, ১৪৬টি দেশ আনুষ্ঠানিকভাবে ফিলিস্তিনকে একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। এই তালিকায় রয়েছে চীন, রাশিয়া, ভারত, দক্ষিণ আফ্রিকা, ব্রাজিল, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, তুরস্ক, সৌদি আরব, মিশর, বাংলাদেশসহ এশিয়া, আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের অধিকাংশ রাষ্ট্র। অর্থাৎ, ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি প্রদানকারী দেশের মধ্যে জাতিসংঘের সদস্যদের একটি বড় অংশই অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
অন্যদিকে, পশ্চিমা বিশ্বের প্রভাবশালী কয়েকটি রাষ্ট্র যেমন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স ও জার্মানি—এখনো আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয়নি। তবে সেই অবস্থানেও পরিবর্তনের ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। ২০২৪-২৫ সালের মধ্যে স্পেন, আয়ারল্যান্ড ও নরওয়ে ফিলিস্তিনকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে ইউরোপে এক নতুন কূটনৈতিক বার্তা পাঠিয়েছে। এ ছাড়া স্লোভেনিয়া, বেলজিয়াম ও মাল্টার মতো দেশ থেকেও ইতিবাচক অগ্রগতি দেখা গেছে।
এ ধারাবাহিক স্বীকৃতি কোনো সাধারণ কূটনৈতিক প্রক্রিয়া নয়, এটি একটি স্পষ্ট বার্তা। আজ ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেওয়া মানে হচ্ছে একটি নির্যাতিত ও অবরুদ্ধ জাতির পাশে দাঁড়ানো, নিপীড়নের বিপরীতে মানবতার পক্ষে অবস্থান নেওয়া। এটা এখন আর শুধু রাজনৈতিক কৌশল নয়, এটা হয়ে উঠেছে এক অনিবার্য নৈতিক দায়িত্ব।
২০২৫ সালের শুরুতে কংগ্রেসম্যান রো খান্নার নেতৃত্বে ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রগতিশীল কিছু নেতাকর্মী প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাছে একটি উন্মুক্ত চিঠি প্রেরণ করেন। এ চিঠিতে তারা যুক্তরাষ্ট্রকে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেওয়ার এবং ইসরায়েলের মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে স্পষ্ট অবস্থান নেওয়ার আহ্বান জানান। এ আহ্বান শুধু রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া নয়, বরং মার্কিন সমাজের ভেতরে নৈতিক ও মানবিক সচেতনতার এক নতুন দিক উন্মোচনের প্রতীক। গ্যালাপ জরিপে দেখা যাচ্ছে, তরুণ প্রজন্মের একটি বড় অংশ ফিলিস্তিনের স্বতন্ত্র রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পক্ষে। এদিকে, জিউয়িশ ভয়েস ফর পিস (শান্তির পক্ষে ইহুদি কণ্ঠ) এবং ইফনটনাউ (যদি এখন নয়, তবে কখন?) মতো প্রগতিশীল ইহুদি সংগঠনগুলো গাজার ওপর ইসরায়েলের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে।
এমনকি বিগত বাইডেন প্রশাসনের সময়েও ইসরায়েলের আগ্রাসনের নীতির বিরোধিতা জানিয়ে একাধিক কূটনীতিক ও প্রশাসনিক কর্মকর্তার পদত্যাগ ও প্রতিবাদ লক্ষণীয়, যা মার্কিন কূটনৈতিক ইতিহাসে এক বিরল ও উল্লেখযোগ্য ঘটনা।
এ প্রেক্ষাপটে ফিলিস্তিন ইস্যু যুক্তরাষ্ট্রের শুধু মধ্যপ্রাচ্যের একটি জটিল সংকট নয়, বরং দেশটির অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক ও নৈতিক বিতর্কের এক গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। এটি ইঙ্গিত দেয় যে, মার্কিন পররাষ্ট্রনীতি কৌশলগত স্বার্থের পাশাপাশি মানবিক মূল্যবোধকেও সমান গুরুত্ব দিতে শুরু করেছে, যা ভবিষ্যতে মধ্যপ্রাচ্যের সংঘাতে নতুন দিকনির্দেশ করতে পারে। আর সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ বক্তব্য এসেছে ইসরায়েল থেকেই। মোসাদের সাবেক প্রধান তামির পারদো স্বীকার করেছেন, ইসরায়েল ফিলিস্তিনিদের ওপর ‘অ্যাপারথেইড’ শাসন প্রয়োগ করছে। অর্থাৎ, এটি এক ধরনের বর্ণবাদী ও বৈষম্যমূলক শাসনব্যবস্থা।
একজন সাবেক গোয়েন্দা প্রধানের মুখ থেকে এমন স্পষ্ট ও সরাসরি স্বীকারোক্তি আসা নিছক রাজনৈতিক মতামত নয়; এটি নিষ্ঠুর বাস্তবতার অক্ষরে অক্ষরে স্বীকৃতি, যা ইসরায়েলের বর্তমান নীতির গভীরতা ও জটিলতা বোঝাতে গুরুত্বপূর্ণ।
জাতিসংঘ বহু আগেই স্পষ্ট ঘোষণা করেছে—১৯৬৭ সালের সীমানার ভিত্তিতে একটি স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনই একমাত্র গ্রহণযোগ্য ও স্থায়ী সমাধান। আন্তর্জাতিক আইনও নির্ধারণ করে দিয়েছে, দখলকৃত ভূখণ্ডে কোনো বসতি স্থাপন সম্পূর্ণ অবৈধ এবং তা সংঘর্ষ ও বিরোধের মূল কারণ। এই নীতিগুলোই বিশ্ব শান্তি ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার মাপকাঠি হিসেবে বিবেচিত হওয়া উচিত। কিন্তু এতদিন ধরে আন্তর্জাতিক আইনের এ ব্যাখ্যাকে অগ্রাহ্য করে ফিলিস্তিনের ওপর চলেছে আগ্রাসন, অবরোধ, গণহত্যা; যা এক প্রকার বৈধতার ছত্রছায়ায় ঘটেছে।
আজ প্রশ্ন একটাই—যে অবৈধতা দখলদারিত্বের নাম নিচ্ছে, তার বিরুদ্ধে কি বিশ্ব বিবেক সত্যিই দাঁড়াবে? যা এখন বিশ্বমঞ্চে ঘটছে, তা আর শুধু রাজনৈতিক বিতর্ক নয়; এটা এক প্রকার নৈতিক বিদ্রোহ। ফিলিস্তিন প্রশ্নে অবস্থান নেওয়া এখন আর কোনো নিরপেক্ষতা নয়, বরং ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়ানোর সাহসিকতা। এটা শুধু মুসলিম বিশ্ব কিংবা আরব জাতির ইস্যু নয়। এটা হিন্দু, খ্রিষ্টান, ইহুদি, নাস্তিক—সব বিশ্বাসের মানুষের মানবিক অবস্থানের প্রশ্ন। গাজার ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকে পড়া যে শিশুটি, তার কোনো ধর্ম নেই। তার একটাই পরিচয়—সে একজন মানুষ। আর সেই মানুষকে রক্ষা করা মানে, নিজের মানবিক সত্তাকেই সম্মান করা। ফিলিস্তিনের ন্যায্য অধিকারে স্বীকৃতি দেওয়া মানে হচ্ছে—আমরা স্পষ্টভাবে বলছি, আমরা অন্যায়ের পক্ষে নই। এটি শুধু কূটনৈতিক অঙ্গীকার নয়, এটি আমাদের নৈতিক দায়। এই মুহূর্তে, ব্যক্তিগতভাবে, সামাজিকভাবে ও রাষ্ট্রীয়ভাবে—আমরা যে যেখানে আছি, সেখান থেকেই এ ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়ানো প্রয়োজন। ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেওয়ার অর্থ—একটি অবরুদ্ধ জাতির দিকে মানবতার হাত বাড়ানো, এক নির্মম ইতিহাসের প্রতি বিবেকবান জবাব। এটাই সময়, বিশ্ব বিবেক সত্যি কি সেই উচ্চতায় উঠবে, নাকি এই নির্যাতনের দায় নিয়েই নীরব থাকবে? সিদ্ধান্তটা এখন আমাদের সবার।
লেখক: দুবাই প্রতিনিধি, দৈনিক কালবেলা
মন্তব্য করুন