ফিলিস্তিনের গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসন বন্ধে অতি সম্প্রতি বৈঠক, ঘোষণা ও সরকারি সফরের মতো বেশ কিছু তৎপরতা তীব্র আঞ্চলিক প্রচেষ্টারই ইঙ্গিত বহন করে। গাজা যুদ্ধ বন্ধের লক্ষ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং বেশ কয়েকজন আঞ্চলিক নেতার মধ্যে বৈঠক, যুক্তরাষ্ট্রের ২০-দফা শান্তি পরিকল্পনা, তুর্কি ও আরব কর্মকর্তাদের মধ্যে গভীর কূটনৈতিক যোগাযোগ এবং তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর উপসাগরীয় দেশগুলোতে সফর—এসবের মধ্যে আগামী দিনে তুরস্ক এবং আঞ্চলিক রাষ্ট্রগুলোর কী ভূমিকা হবে বা তারা কী ভূমিকা পালন করতে চলেছে, তার স্পষ্ট লক্ষণ দেখা যাচ্ছে।
সম্প্রতি অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ফাঁকে ট্রাম্প কাতার, সৌদি আরব, তুরস্ক, সংযুক্ত আরব আমিরাত, মিশর, জর্ডান, ইন্দোনেশিয়া এবং পাকিস্তানের মতো বেশ কয়েকটি মুসলিম ও আরব দেশের নেতাদের সঙ্গে রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেছেন। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান এটিকে ‘ফলপ্রসূ’ বলে উল্লেখ করেছেন। অন্যদিকে ট্রাম্প বৈঠকে অংশগ্রহণকারী দেশগুলোকে ব্যাখ্যা করেছেন—‘সেই নেতৃত্ব, যারা এটি করতে পারে (অর্থাৎ গাজায় যুদ্ধের অবসান ঘটাতে)।’
এ বৈঠকের কয়েক দিন পরই মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তার ২০-দফা শান্তি পরিকল্পনা ঘোষণা করেন। এরই মধ্যে ট্রাম্পের সঙ্গে বৈঠকে অংশগ্রহণকারী আটটি দেশ গাজা পরিকল্পনাকে স্বাগত জানিয়ে একটি যৌথ বিবৃতিও দিয়েছে। পাশাপাশি এ পরিকল্পনা চূড়ান্ত করতে সহায়তা করার জন্য প্রকাশ করেছে তাদের প্রস্তুতি। এরদোয়ান ট্রাম্পের নেতৃত্বের প্রশংসা করেছেন। জানিয়েছেন পরিকল্পনার প্রতি তার সমর্থনের কথাও। অন্যদিকে তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাকান ফিদান সৌদি আরব ও কাতারের তার প্রতিপক্ষদের সঙ্গে ফোনে আলোচনা করেছেন।
এ ঘোষণার পর গত মঙ্গলবার তুর্কি, কাতার ও মিশরের কর্মকর্তারা দোহায় বৈঠক করেন যেন ট্রাম্পের প্রস্তাবের প্রতি হামাসকে ইতিবাচক সাড়া দিতে উৎসাহিত করা যায়। তুর্কির জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থার ফিদানের উত্তরসূরি ইব্রাহিম কালিন হামাসের সঙ্গে দোহার মধ্যস্থতা প্রচেষ্টায় যোগ দিতে কাতারে ছিলেন। এরদোয়ান ও ট্রাম্পের মধ্যে বেশ কয়েকটি বৈঠকের পর কালিনের উপস্থিতি এ আলোচনায় তুর্কির আনুষ্ঠানিক অন্তর্ভুক্তিরই প্রতিনিধিত্ব করে। হাকান ফিদান জানান, যুক্তরাষ্ট্রকে ইসরায়েলকে পরিকল্পনা গ্রহণে রাজি করানোর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। আর তুর্কি এবং অন্যান্য আঞ্চলিক প্রভাবশালী নেতৃত্ব ফিলিস্তিনিদের রাজি করানোর ওপর জোর দেবেন।
পর্যবেক্ষকরা লক্ষ করেছেন, হামাস সম্ভবত এ পরিকল্পনাটি গ্রহণ করবে। তবে এই বিকল্প ইসরায়েল পছন্দ না-ও করতে পারে। ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু স্পষ্ট করে বলেছেন, যদি হামাস এ পরিকল্পনা প্রত্যাখ্যান করে, তাহলে তিনি আমেরিকার কাছ থেকে যে যা ইচ্ছা তাই করার গ্যারান্টি পেয়েছেন, তা বাস্তবায়ন করবেন। এ গ্যারান্টির অঙ্গীকার তার নিজের সমর্থকদের কাছেও তার তরফ থেকে ছিল। তারা ভেবেছিলেন যে, হামাস সম্ভবত এ পরিকল্পনাটি প্রত্যাখ্যান করবে। কিন্তু হামাস যদি এটি গ্রহণ করে তবে কী হবে? তখনই নেতানিয়াহুর জন্য অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি কঠিন হয়ে উঠতে পারে, কারণ গাজায় গণহত্যার যুদ্ধের মাধ্যমে তিনি যে সমর্থন অর্জন করেছিলেন, তা হারাতে পারেন।
যদিও এ পরিকল্পনাটি ফিলিস্তিনিদের জন্য নিখুঁত নয়, তবুও এটি গাজায় রক্তপাত বন্ধ করার শেষ সুযোগ বলে মনে হচ্ছে। এ ছাড়া এই অঞ্চলের প্রায় সব রাষ্ট্রই এটা চায়। তুর্কি ও অন্যান্য আঞ্চলিক রাষ্ট্রগুলোর জন্য মার্কিন শান্তি পরিকল্পনার প্রতি সমর্থন যে বোঝাপড়াকে প্রতিফলিত করে, তা হচ্ছে—‘খারাপ শান্তির সমঝোতা একটি চলমান যুদ্ধের চেয়ে ভালো।’ এ কারণেই সব অনিশ্চয়তা সত্ত্বেও ট্রাম্পের শান্তি পরিকল্পনা সবার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, গাজার জনগণের ওপর বোমাবর্ষণ, গণস্থানচ্যুতি এবং অনাহার বন্ধ করার জন্য এ অঞ্চলের জন্য আর কোনো বিকল্প নেই।
এ ছাড়া পরিকল্পনাটির গভীর তাৎপর্য রয়েছে। কেননা গ্যারান্টার হিসেবে প্রথমবারের মতো সব আঞ্চলিক রাষ্ট্র গাজায় সামরিক উপস্থিতির মাধ্যমে সহায়তা করবে। পাশাপাশি জেগেছে তাদের তহবিল প্রতিষ্ঠার আশাও। আঙ্কারা ও অন্যান্য আঞ্চলিক রাষ্ট্র পরিকল্পনাটি দেখছে ‘সতর্ক আশা’সহ যুদ্ধবিরতির দিকে প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে। ফলে এ পর্যায়ে, তারা কূটনীতির স্বার্থ এবং শান্তির পথে অগ্রগতির জন্য এ সংকীর্ণ, তবে উন্মুক্ত জানালার প্রতি তাদের সমর্থন বাড়িয়ে দিচ্ছে।
আবারও বলছি, এ পরিকল্পনাটি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, এটিই প্রথমবারের মতো মার্কিন প্রশাসন একটি প্রস্তাব নিয়ে এসেছে এবং আঞ্চলিক সমর্থন চেয়েছে। ট্রাম্প ইসরায়েলের আগে আরব ও ইসলামী দেশগুলোর সঙ্গে এ পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা করতে চেয়েছেন।
আঞ্চলিক নেতাদের সঙ্গে ট্রাম্পের বৈঠকের একটি দিক ছিল যে, ট্রাম্প তাদের গাজার জন্য তথাকথিত আন্তর্জাতিক স্থিতিশীলতা বাহিনীতে সৈন্য প্রেরণের জন্য অনুরোধ করেন। তবে মার্কিন পরিকল্পনার অন্যান্য অনেক বিষয়ের মতো, এ বাহিনী সম্পর্কে বেশ কয়েকটি প্রশ্নের উত্তর এখনো অজানাই রয়ে গেছে। কোন দেশগুলো অবদান রাখবে এবং কত সৈন্য নিয়ে যাবে? কোন দেশ এটির নেতৃত্ব দেবে? এসব গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের উত্তর প্রয়োজন।
আপাতত তুরস্ক, আরব উপসাগরীয় রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে মূলত সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কাতার, মিশর ও জর্ডানকে শান্তি পরিকল্পনার মূল অংশ হিসেবে দেখা হচ্ছে। এ প্রত্যেকটি রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব রয়েছে। তুরস্ক ও কাতার হামাসকে রাজি করানোর জন্য নিজেদের অবস্থানে রেখেছে। মিশর ও সংযুক্ত আরব আমিরাত গাজায় পুনর্গঠন এবং মানবিক ত্রাণ কীভাবে পরিচালনা করা যায়, তার ওপর মনোনিবেশ করেছে। সৌদি আরব এ রাষ্ট্রগুলোর কূটনীতিকদের একত্রিত করতে একটি কূটনৈতিক শক্তি হিসেবে তার অবস্থান ব্যবহার করছে। উদাহরণস্বরূপ—সৌদি আরব গত বুধবার আল উলায়ে একটি শীর্ষ সম্মেলনের আয়োজন করেছিল, যেখানে ফিদান সিরিয়া ও অন্যান্য আঞ্চলিক রাষ্ট্রের কর্মকর্তাদের সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন।
এরপর তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী গাজা এবং সিরিয়ার পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করতে সংযুক্ত আরব আমিরাতের উদ্দেশে রওনা হন। এ বৈঠকগুলো এমন ইঙ্গিতই দেয় যে, তুরস্ক ও উপসাগরীয় রাষ্ট্রগুলোর ভূমিকা মূলত একে অন্যের পরিপূরক। প্রকৃতপক্ষে, গাজায় যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে তুরস্ক সংঘাতের বিষয়ে আরব সংস্থাগুলোকে সমর্থন করে আসছে।
ক্রমবর্ধমান তুর্কি-আরব সমন্বয় আঞ্চলিক বিষয়গুলোতে আন্তর্জাতিক দৃষ্টি আকর্ষণ এবং আসন্ন সময়ে ইসরায়েলি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরক্ষা হিসেবে কাজ করার মূল চাবিকাঠি হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে গাজার প্রতি আন্তর্জাতিক দৃষ্টি বাড়াতে ক্রমবর্ধমান তুর্কি-আরব সমন্বয় গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে।
লেখক: তুর্কি রাজনৈতিক বিশ্লেষক। মধ্যপ্রাচ্যের সঙ্গে তুরস্কের সম্পর্কবিষয়ক বিশেষজ্ঞ। নিবন্ধটি মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আরব নিউজের মতামত বিভাগ থেকে ভাষান্তর করেছেন সঞ্জয় হালদার
মন্তব্য করুন